logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সাংসদরা এখন লুটপাট করছেন বিএনপির আমলেও এটা হয়েছে
০৭ জানুয়ারি, ২০১৪ ২৩:২৯:২৬
image


নির্বাচন পরবর্তী সরকার কেমন হবে? দেশের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বিএনপির আন্দোলন ও জামায়াতের সঙ্গে জোট, নির্বাচন পদ্ধতি কি হওয়া উচিত ইত্যাদি বিষয়ে এই সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান। সাক্ষাৎকারে ছিলেন- হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

ঢাকাটাইমস: বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হয়ে গেল। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

ড. সলিমুল্লাহ খান: প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন বর্তমান নির্বাচন সন্তোষজনক নয়। সেজন্য তিনি বলেছেন বিএনপি যদি নির্বাচনে আসতো তাহলে এটি সন্তোষজনক হতো। তাছাড়া ভোটের ফলাফলও তাই বলছে।

ঢাকাটাইমস: নির্বাচনের পর এখন কী হতে পারে।

সলিমুল্লাহ খান: পরিস্থিতি কয়েক ধরনের হতে পারে। শেখ হাসিনা পাঁচ বছর টিকে থাকতে পারেন কিংবা ষষ্ঠ সংসদের মতো দশম সংসদের মেয়াদ হতে পারে দেড় মাস বা আরও কয়েক মাস বেশি। এ নির্বাচন সব সমস্যার সমাধান দেবে না। সরকার নিজেও বলছে তারা যদি বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে পারে তাহলে আবার নির্বাচন দেবে।

ঢাকাটাইমস: প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিরোধী দল চাইলে একাদশ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এর আগে দুই নেত্রীর মধ্যে ফোনে কথা হয়েছে। মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। এরপরও সমঝোতার কোনো আশা কি আছে?

সলিমুল্লাহ খান: আমি আশার কোনো কারণ দেখি না। কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু তারপরও আমি বলব ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ’৭১ সালের মার্চে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক আলাপ হয়েছিল। তখন ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তারা করাচি ফেরার আগেই অভিযান শুরু হয়ে গেল। সেভাবেই দেখতে হবে। তাই আলোচনা অনেক সময় না হওয়াটাই ভালো। তবে আমি মনে করি সমঝোতা না হলে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।

ঢাকাটাইমস: বিরোধী দলের আন্দোলন কর্মসূচিতে অর্থনৈতিক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখন সরকার ক্ষমতায় গিয়ে কতটা স্বস্তিতে থাকতে পারবে?

সলিমুল্লাহ খান: এটি তো পরিষ্কার। দেশে এখন যে অবস্থা চলছে, যে মাত্রায় সন্ত্রাস, হত্যা, অগ্নিকা- চলছে তাতে যে কোনো ভালো অর্থনীতিও খারাপ হয়ে যাবে। সরকারের ওপর জনগণের আস্থার প্রশ্নটা স্বতন্ত্র। সরকারের ওপর জনগণের পূর্ণ আস্থাও থাকে এবং একদল সন্ত্রাসবাদী লাগাতার সন্ত্রাস করে, রেললাইন উপড়ে ফেলে, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘিœত হয় সেখানে অর্থনীতির অবস্থা তো খারাপ হবেই। সন্ত্রাসী কর্মকা- যদি বন্ধ হয় তাহলে অর্থনীতির অবস্থা স্বাভাবিক হতে পারে। তারপরও যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হতে সময় লাগবে। এর ফলাফল হয়ত পরে দেখা যাবে।

ঢাকাটাইমস: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করতে আওয়ামী লীগ সরকার দরকার বলে অনেকে বলছেন। তাই যদি হয় তাহলে চূড়ান্ত সমঝোতায় আরও কতটুকু সময় লাগতে পারে?

সলিমুল্লাহ খান: খালেদা জিয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধীদের বলেছেন ‘রাজনৈতিক বন্দি’। ক্ষমতায় এলে তাদের ছেড়ে দেয়ার ইঙ্গিত আছে এ কথায়। বিএনপি যদি বলত, একাত্তরে যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার করবে, তাহলে হাঙ্গামা কমে আসত। মানুষ তাদের প্রতি আস্থা রাখত। যেহেতু বিএনপির প্রতি মানুষ সেই আস্থা নেই তাই আওয়ামী লীগ সেই জায়গাটা নিয়েছে। তবে এ ইস্যুতে দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান থাকবেই। কারণ, জামায়াতকে জোটে রেখে বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে সরাসরি কিছু বলতে পারবে না।

ঢাকাটাইমস: যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিবেদনে বিশ্বের সংঘাতময় দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এর পরিণাম আসলে কী হতে পারে?

সলিমুল্লাহ খান: যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ধরনের কোনো তথ্য প্রকাশ করে থাকে তবে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এজন্য যে যুক্তরাষ্ট্র তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি করার জন্য নানা রকম নীতি গ্রহণ করে। নানা রকমের প্রতিবেদন প্রকাশের আয়োজন করে। আমি মনে করি পৃথিবীর একমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তালিকায় তাদের নাম নেই কেন? যদি দেশটির সরকার এ ব্যাপারে কোনো বিবৃতি দেয় তখন তা নিয়ে ভাবা যাবে।

ঢাকাটাইমস: দুই দলের মধ্যে বিরোধটা আসলে কী নিয়ে?

সলিমুল্লাহ খান: আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দ্বিমত হয়েছে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতি নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপির দাবি একটি অবস্থায় এসে সীমিত হলো। তারা আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নয়। এ থেকে ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি মনের অস্থিরতাই প্রকাশ পেয়েছে। যেটা করা ঠিক নয়। বিএনপির একটি নীতি থাকা উচিত। বিএনপি যদি বলত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না তাহলে জনগণের কাছে আরও শ্রদ্ধা লাভ করত। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে নই।

ঢাকাটাইমস: তাহলে সমাধান কী।

সলিমুল্লাহ খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারই সঠিক সমাধান নয়। যারা এটিকে বাড়ানো কথা বলেন আমি সবিনয়ে তাদের বিরোধিতা করি। স্থায়ীভাবে আমাদের সরকার পরিবর্তন ও নির্বাচনের রূপটা কীভাবে হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক বাদ দিয়ে স্থায়ী কোনো সমাধানে পৌঁছতে চাইলে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। এখন হয়ত অনেকে একথা শুনছেন না। কথায় আছে কাঙ্গালের কথা অনেক পরে ফলে।

ঢাকাটাইমস: মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের উল্লম্ফন। গত পাঁচ বছরে শত শতগুণ সম্পদ বেড়েছে। কীভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?

সলিমুল্লাহ খান: আমার মনে হয় এটা অস্বাভাবিক নয়। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সাংসদরা এখন লুটপাট করছেন। বিএনপির আমলেও এটা হয়েছে। এখন মন্ত্রীদের সম্পদ বেড়েছে এটা নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রিত্বের বাইরে সম্পদ আহরণের প্রক্রিয়া সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না কেন? মন্ত্রীরা এসব করছে বলে আমরা হিসাবগুলো পাচ্ছি। কিন্তু এর বাইরে যারা আছেন তাদের কোনো খোঁজ নেই।

ঢাকাটাইমস: বিএনপি নেতারাও ক্ষমতায় থাকতে অনেক সম্পদ করেছেন। বলা হয়, সম্পদ রক্ষার স্বার্থেই তারা আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় হচ্ছেন না।

সলিমুল্লাহ খান: মজার বিষয় হচ্ছে, এবারের আন্দোলনে দেখা গেল বিএনপি-জামায়াতের শক্তি ঢাকার বাইরে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে, সাতক্ষীরায়। শহরে অতটা দেখাতে পারেনি। শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণী যেটাকে আমরা পেটিবর্জুয়া শ্রেণী বলি তাদের মধ্যে যারা আওয়ামী লীগের আমলে উপকৃত হয়েছে তারা আন্দোলনে অতটা আগ্রহী নয়। আগে শুনেছি গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থন বেশি। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে শহরে মধ্যবিত্তদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থন বেড়েছে। বেড়েছে যদি না বলেন তাহলে বিরোধিতা কমেছে। যে কারণে বেগম জিয়ার বারবার ডাকেও শহরের লোক সাড়া দেয়নি। তাছাড়া বিএনপি নেতাদের ওপর সরকারের কৌশলগত নিপীড়ন তো আছেই। বিএনপি নেতারা সরকারের যে চাপ সেটা অতিক্রম করতে পারেনি।

ঢাকাটাইমস: নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলছিলেন।

সলিমুল্লাহ খান: নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রণয়ন বিভাগ বা সংসদ এবং বিচার বিভাগ। কেউ কারও ওপরে নয়; বরং সার্বভৌম। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংস্থা। বিচার বিভাগও সাংবিধানিক সংস্থা। নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ৫ বছর। এটি কমিশনকে সরকারের হাতে রাখার মোক্ষম হাতিয়ার। তাই কমিশনারদের মেয়াদ বিচার বিভাগের বিচারপতির মতো দীর্ঘ করা যায়। এখন নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগের একটি অংশ। তাকে করা উচিত বিচার বিভাগের সঙ্গে তুলনীয় একটি অংশ। কিন্তু কেউ এটি করতে চায় না। কারণ সবাই নির্বাচনকে মেনুপুলেট করতে চায়।

 ঢাকাটাইমস: কিন্তু বিচার বিভাগকে দলীয়করণের অভিযোগও আছে?

সলিমুল্লাহ খান: এজন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথাই দায়ী। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের অধীনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে প্রস্তাব ছিল ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সেটাই মূল কারণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথাটা কেন ক্ষতিকর তা প্রমাণিত হয়েছে। যদি এটি ক্ষতিকর না হতো তাহলে গত বার দু’বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকত না। বিএনপি সংবিধানে যে সংশোধনী এনেছিল সেটা না আনলে এই ব্যবস্থার ত্রুটি বুঝতে পারতাম না।

ঢাকাটাইমস: জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক বিএনপিকে কতটা এগিয়ে দিচ্ছে বা কতটা পিছিয়ে দিচ্ছে?

সলিমুল্লাহ খান: বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিভেদের মূল কারণই হচ্ছে জামায়াত। এজন্যই দু’দলের মধ্যে কোনো আপস হচ্ছে না। বিএনপি মনে করছে জামায়াতের সঙ্গে জোট না বাধলে সে নির্বাচনে জিততে পারবে না। বিএনপির অনেকে আদর্শগতভাবে মনে করেন জামায়াতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি মিত্রতা করলে তারা বাংলাদেশে এমন একটি সরকার কায়েম রাখতে পারবেন, যেটাকে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে।

 ঢাকাটাইমস: জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কের মূলচিত্রটা আসলে কী?

সলিমুল্লাহ খান: বিএনপিতে দুটি চিন্তা কাজ করে। একটি হচ্ছে নির্বাচনী ঐকমত্য। আরেকটি হচ্ছে আদর্শগত ঐক্য। কিছুলোক আছে যারা মুসলিম জাতি হিসেবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করতে চায়। এরা কম শক্তিশালী নয়। এই দুটি মিলে বিএনপির মূল চিত্রটা আমাদের হাতে নেই। তবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের কারণেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে না।

ঢাকাটাইমস: আওয়ামী লীগও তো জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছিল?

সলিমুল্লাহ খান: কিন্তু আওয়ামী লীগ তো বলে তারা জামায়াতের সঙ্গে টেকনিক্যাল (স্বল্পমেয়াদি) মিত্রতা করেছিল, স্ট্র্যাটেজিক (দীর্ঘমেয়াদি) মিত্রতা করেনি। আওয়ামী লীগ বলে তারা জামায়াতের সঙ্গে কোনো ফ্রন্ট করেনি। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিল, জামায়াতও তাই চেয়েছিল। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি-আওয়ামী লীগ-জামায়াত ও বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে আন্দোলন করেছিল। তখন তারা একটি জোট করেনি। চারটি আলাদা জোট ছিল। কিন্তু বিএনপি তাদের মন্ত্রিসভায় জামায়াতকে বসিয়ে দীর্ঘমেয়াদি মিত্রতা করেছে।

ঢাকাটাইমস: সাধারণ মানুষের পছন্দটা আসলে কি? দুই দলই তো সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ বলা চলে ...

সলিমুল্লাহ খান: সাধারণ মানুষের পছন্দটা এখনও বাজারে দেখা যাচ্ছে না। তবে এটা মনে রাখতে হবেÑ বিএনপি বা আওয়ামী লীগের বিকল্প জাতীয় পার্টি নয়। সাধারণ মানুষ নিজেরা গণতান্ত্রিক দল গড়ে তোলা দরকার। ছোট ছোট যেসব বাম দল আছে সেগুলোর আচরণ আরও হতাশা ব্যঞ্জক। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্রই। গণতন্ত্রের বিকল্প স্বৈরতন্ত্র নয়।

ঢাকাটাইমস: সাধারণ মানুষের দল বলতে দিল্লির আম আদমি থেকে শিক্ষা নিতে বলছেন না তো?

সলিমুল্লাহ খান: মোটেও না। দিল্লির আম আদমি অন্য জিনিস। এটা মোটেও ভালো জিনিস নয়। এই যে আন্না হাজারে অথবা আম আদমি পার্টি এগুলো হচ্ছে অনেকটা মুখরোচক। এগুলোকে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। তারা দু’বছর ক্ষমতায় থাকুক। দিল্লিতে কংগ্রেস পার্টি কুশাসন করেছে। এজন্য মানুষ আম আদমিকে নির্বাচিত করেছে। বিদ্যুৎ ও পানির দাম কমিয়ে তো সরকার চলে না। ভারতে আন্না হাজারে ড. ইউনূসের মতো লোক। যারা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কথা কিছুই বলে না। আম আদমি পার্টি নামটা খুব সুন্দর। তবে তারা কী করে তা আগে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।



(ঢাকাটাইমস/ ০৭ জানুয়ারি/ এআর)