আগামীকাল পাঁচ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিরোধীদল ছাড়াই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। উৎসববিহীন এ নির্বাচন এ নিয়ে ঢাকাটাইমস মুখোমুখি হয়েছিল নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন ঢাকাটাইমস পাঠনের জন্য তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিলকিছ ইরানী।
ঢাকাটাইমস: নির্বাচন হচ্ছে এবং তাতে নেই বিরোধী জোট। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন তিনি হতাশ। কোনো জোটই ছাড় দিতে রাজি নয় এতটুকু। কিছুই কি করার ছিল না নির্বাচন কমিশনের?
আবু হাফিজ: প্রধান বিরোধী দলের দাবি, নির্বাচন করতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। কিন্তু তা নির্বাচন কমিশনের হাতে না। এটা রাজনৈতিক বিষয়। রাজনৈতিক নেতারাই এর সমাধান করবেন। আমরা অনেক অপেক্ষা করেছি। এক মাস অপেক্ষা করে তফসিল দিয়েছি। আমরা সময় হাতে রেখেছিলাম যেন পুনঃতফসিল করতে পারি। কিন্তু রাজনৈতিক সংকটের সমাধান দলগুলো না করলে আমাদের তো কিছু করার নেই।
ঢাকাটাইমস: ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় নির্বাচিত হয়েছেন ১৫৪ জন। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন? এই কারণে নির্বাচন পেছানোর আর কোনো সুযোগ আছে কি?
আবু হাফিজ: নির্বাচন একটি আইনি প্রক্রিয়া। আইনে বলা আছে কিভাবে মনোনয়ন দাখিল হবে, কিভাবে বাছাই হবে, বাছাই হওয়ার পর যদি একজন টিকে তাহলে কি হবে, কখন প্রত্যাহার হবে, প্রত্যাহারের পর কি হবে। বাছাইয়ের পর যদি দেখা যায় একজন মাত্র প্রার্থী আছে তখন তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করতে হবে। একই আসনে একাধিক প্রার্থী থাকলে যদি কেউ নিজের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেয়, আর সেখানে যদি অবশিষ্ট একজন প্রার্থী থাকে তাহলে রিটার্নিং অফিসার তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করবেন। এখন যেখানে একজন করে প্রার্থী ছিল সেখানে রিটার্নিং অফিসার তাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করেছেন, সেখানে নির্বাচন কমিশনের করার তো কিছু নাই এমন কি রিটার্নিং অফিসারের ও করার কিছু নেই।
আর নির্বাচন পেছানোর সুযোগ থাকলেও এই ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর ক্ষেত্রে তো কিছু সমস্যা হবেই।
ঢাকাটাইমস: সরকার দল এবং তার জোটের দলগুলো বলছে নির্বাচন করা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। বিরোধী জোট বলছে এততরফা নির্বাচন তাদের অধিকার হরণ। এই দুইয়ের চাপে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠার দশা। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আবু হাফিজ: নির্বাচন নিয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে অনেক বিতর্ক হয়েছে আমরা দেখেছি। সংবিধানে লেখা আছে মেয়াদ উত্তীর্ণের শেষ ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সেটাকেই আমরা ধরে নিয়ে নির্বাচনের পথে এগুচ্ছি। এ বিষয়ে বিতর্ক থাকলে আমরা বিতর্কে যেতে চাই না।
ঢাকাটাইমস: নির্বাচন কমিশন বলছে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে তাদের। বিষয়টা যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন।
আবু হাফিজ: আমরা আগেও বলেছি। সংবিধানে আছে সংসদ মেয়াদ পুর্তির ক্ষেত্রে, মেয়াদ পুর্তির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। অথবা অন্য কোন কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভেঙে যাওয়ার পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সংসদ যেহেতু মেয়াদ পুর্তি করতে যাচ্ছে, তাই আমরা সেটা বিবেচনায় নিয়েছি এবং সে অনুযায়ী তফসিল ঘোষণা করেছি।
ঢাকাটাইমস: বর্তমান নির্বাচন কমিশন যতগুলো নির্বাচন করেছে (সিটি নির্বাচন) সেগুলো নিয়ে বড় ধরনের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। তারপরও আপনাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দল। এর আগের কমিশন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল তখন চারদলীয় জোট। এই সমালোচনাগুলো কেন হয়?
আবু হাফিজ: এ বিষয়টি যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর, যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো সমালোচনা করছে এ বিষয়ে আমার বলা ঠিক হবে না। আমাদের সম্পর্কে সমালোচনা থাকতে পারে। আমাদের ভুল, ত্রুটি থাকতে পারে তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ হবে, এই জিনিসটা সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার। কোনটা আমরা ঠিক করিনি, বেআইনি কিছু করেছি কি না, সংবিধান লঙ্ঘন করেছি কি না, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো আইন উপেক্ষা করেছি কি নাÑ এসব বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, তাহলে আমরা শোধরাতে পারবো। তবে ঢালাওভাবে অভিযোগ করা হলে আমরা কিছু বুঝতে পারব নাÑ কেন আমাদের অভিযুক্ত করা হলো।
ঢাকাটাইমস:এর আগের কমিশনাররা কাজ করেছিলেন সেনাসমর্থিত একটি সরকারের অধীনে যাদের প্রকাশ্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। এর সাথে একটি রাজনৈতিক সরকারের অধীনে কাজ করা কমিশনের ভূমিকাকে কীভাবে তুলনা করবেন?
আবু হাফিজ: একটি কমিশনের সঙ্গে আরেকটি কমিশনের হুবহু তুলনা করা যাবে না। কেননা দেশ তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। সেনাসমর্থিত সরকারের সময় বিগত কমিশন যে প্রেক্ষাপটে এসেছিল আর আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে কাজ করছি তা এক নয়। দুই কমিশনের কাজের পরিবেশ ভিন্ন, কাজেই আমাদের আচরণ ও ভিন্ন হবে।
ঢাকাটাইমস: লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে অনেক কথা হয়েছে গত কয়েক মাসে। এই বিষয়টা আসলে কী?
আবু হাফিজ: খেলার মাঠ যেমন আবাহনী মোহামেডান দু’দলের জন্য একই রকম হয়, সমতল হয়, এক দলকে বন্ধুর মাঠ পার হতে হচ্ছে আর আরেক দল সমতল মাঠ পার হচ্ছে এমন নয়, তেমনি রাজনৈতিক সব দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হয়। একজনকে প্রশাসন-পুলিশ সহায়তা দিচ্ছে আরেক জনকে দিচ্ছে না, এ রকম তো হবে না। কমিশন দেখবে কারো প্রতি বৈরী আচরণ করা হচ্ছে কিনা। হলে কমিশন তখন ব্যবস্থা নেবে।
ঢাকাটাইমস: নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা কিন্তু এখন পর্যন্ত কখনও নেয়া যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে সময়ের সমস্যা থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রমাণও পাওয়া যায় না। তাহলে ভোটের পরিবেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাখতে কী কী করা যায়?
আবু হাফিজ: আপনি বাইরে বের হলে দেখেছেন ঢাকা শহরে আগে কতগুলো বিলবোর্ড ছিল? কিন্তু আমরা যখন তফসিল ঘোষণা করেছি, আমরা বলেছি ৪৮ ঘন্টার সময় দিলাম। এর মধ্যে কেউ কেউ নামিয়েছে কেউ কেউ নামায়নি। যেগুলো নামানো হয়নি নামানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুন করলে ফাঁসি হয়, এটা শাস্তি। তারপরও কি খুন হয় না? তেমনি কোনো কোনো জায়গায় আচরণবিধি লঙ্ঘন হতে পারে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
আমরা জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি কমিটিকে ক্ষমতা দিয়েছি যেন তারা শাস্তি দিতে পারে। আগে তারা তদন্ত করে আমাদেরকে জানাতো। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে অনেক সময় দেরি হতো। তাই তারা যেন অপরাধীকে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে পারে সে ক্ষমতা তাদেরকে দেয়া হচ্ছে।
ঢাকাটাইমস: ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবার নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকের গুরুত্ব কতটা?
আবু হাফিজ: পর্যবেক্ষকরা দেখবে নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে কিনা। পর্যবেক্ষকরা যে কমিশনের ওপর রাগ করে আসছেন না, তা নয়। বিদেশি নাগরিকরা হরতাল অবরোধে বের হন না। তারা দেখেছেন এখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নেই, সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এজন্য হয়তো তারা পর্যবেক্ষক পাঠাতে চাচ্ছেন না। সেখানে আমাদের বলার কিছু নেই।
ঢাকাটাইমস: আপনাদের আগের কমিশন নির্বাচনে কারচুপি রোধে বেশ কিছু আইনি সংস্কার করেছিলেন। বলা হয়, কারচুপির সুযোগ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে প্রিজাইডিং অফিসার ও প্রার্থীদের এজেন্টকে ভোটকেন্দ্রের চূড়ান্ত ফল দেয়ার ক্ষমতা দেয়ায়। এখনও কি ভোটকে প্রভাবিত করার কোনো অপকৌশল করা যায়? এছাড়া ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার সময় এবং এখন সে সরকার তুলে দেয়ার পরÑ দুই সময়ই নির্বাচনে কারচুপির আশঙ্কার কথা বলে আন্দোলনে আছে বিরোধী জোট। এই আশঙ্কার স্থায়ী সমাধানের কী উপায়?
আবু হাফিজ: নির্বাচনে কারচুপির এখন কোন সুযোগ নেই। গত কমিশন থেকে এ কমিশনে কারচুপি হয়েছে এটা কেউ বলতে পারবে না। এখন কারচুপি করা খুব কঠিন। এখন ছবিসহ ভোটার তালিকা করা হয়েছে। একজনের ভোট আরেকজন দিতে গেলে ধরা পড়ে যাবে। আর তালিকায় এখন ভুয়া ভোটার থাকার সুযোগ নেই। ভোটার তথ্যে ছবিসহ অনেক তথ্য থাকে। তাই এখন নির্বাচনে কারচুপি করা সম্ভব নয়।
আর নির্বাচনে যেটা ঘটে সেটা হলো অনুকৌশল। খেলায় যেমন জেতার জন্য কৌশল থাকে তেমনি প্রত্যেক দলেই নির্বাচনের কৌশল থাকে। কার কৌশল কেমন হবে, কীভাবে তারা জিতবে, নির্বাচনে সেই কৌশলই তারা অবলম্বন করে। কিন্তু ভোটে কারচুপির দিন আর নেই।
ঢাকাটাইমস: ভারতের নির্বাচন কমিশনকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে আদর্শিক কমিশন বলা হয়। সে কমিশন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান, বিরোধী দলের প্রধানকেও ডেকে এনে সাবধান করেছে। বাংলাদেশে কোনো কমিশনকে এমন কঠোর হতে দেখা যায়নি। এটা কেন?
আবু হাফিজ: কঠোর তো হয়েছি। তাদের তো সাবধানও করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অর্থমন্ত্রী সিলেটে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি যে, আপনি অর্থমন্ত্রীকে বলে দেন যে এটা করা যাবে না। পরে তিনি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেননি। রিকশায় চড়ে ভোট দিতে গিয়েছেন। কঠোরতা আমরা প্রয়োগ করছি। যেখানে কঠোর হওয়া দরকার সেখানে কঠোর হবো। ভারত স্বাধীনতার পর থেকে তাদের গণতন্ত্রের পথে সাবলীলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশ বারবার হোঁচট খেয়েছে। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের থেকে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। তবে আমরা দলগুলোকে ডেকে সাবধান করতে পারব না, তা নয়। যেমন তফসিল ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে সমাবেশ-মিটিং করেছেন তফসিল ঘোষণার পর এখন কি তেমন করছেন তিনি? তিনি তো মানছেন।
(ঢাকাটাইমস/০৪ জানুয়ারি/ এআর)