ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড.অহিদুজ্জামান। শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটে দীর্ঘদিন ধরে তিনি অধ্যাপনা করছেন। শিক্ষা নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকও তিনি। টিভি টকশোতোও নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ এবং চলমান রাজনীতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে।
ঢাকাটাইমস পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:
ঢাকাটাইমস: বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বিরোধীদলের একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি। তবে এরকম কর্মসূচির জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয়। যেভাবে দিনের পর দিন হরতাল অবরোধ দেয়া হচ্ছে, ভালোভাবে বললে সহিংস হরতাল অবরোধ দিচ্ছে, আর বাঁকাভাবে বললে হরতাল অবরোধের নামে সারাদেশে যে সহিংসতা চালানো হচ্ছে এটা অত্যন্ত দু:খজনক। বিগত কয়েকদিনের আন্দোলনে বিরোধীদল জনগনকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। বর্তমানে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন আর এরকম পরিস্থিতিতে তাদের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি সফল হয়নি এটাই বলতে হচ্ছে। কারণ বিরোধীদলের আন্দোলনে জনগনের সম্পৃক্ততা ছিলনা। বেগম খালেদা জিয়া নিজে পল্টন আসেননি এমনকি তাদের কোন নেতাই পল্টনে যান নি।
ঢাকাটাইমস: খালেদা জিয়াকে তো অবরুদ্ধ করে রেখেছে পুলিশ, তিনি বের হবেন কিভাবে, আন্দোলনই বা হবে কিভাবে?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে এটা মানছি। তবে ১৮ দলের অন্য নেতারাতো আসতে পারতেন। একত্রিত হতে পারতেন। দেশে ১৬ কোটির উপর লোক রয়েছে। রাজধানীতেও রয়েছে প্রায় দেড় বা দুই কোটি লোক। কিন্তু খালেদা জিয়ার ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। অতীতে আমরা দেখেছি আন্দোলনের সময় বিএনপি আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু বিএনপির আন্দোলনে তাদের কর্মীরাই সাড়া দেয়নি। মার্চ ফর ডেমোক্রেসির ঘোষণার পর বিএনপির কোন নেতাই রাজপথে নামেননি।
ঢাকাটাইমস: বলা হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অতর্কিত গুলির কারণে নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পারছে না, তাহলে কিভাবে রাজপথে নামবে?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় যখন মার্শল ল চলছিল তখন জরুরি অবস্থায় মধ্যেও আমরা মিছিল করেছি। সেই আন্দোলনে সবার স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে পুলিশ বাহিনীর মিশন ব্যর্থ হয়েছে। খালেদা জিয়ার কর্মসূচির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলে আন্দোলন সফল করা সম্ভব ছিল। রাজধানীর অলি গলিতে ইচ্ছা করলে বিরোধীদলের সমর্থকরা মিছিল বের করতে পারতো। আন্দোলনকে গণজোয়ারে রুপ দিতে পারলে পুলিশ বাহিনীও তাদের মিশনে ব্যর্থ হতো।
ঢাকাটাইমস: রাজপথে নামলেই পুলিশ মিছিলে গুলি চালাচ্ছে। সিনিয়র নেতাদের গুলি না করলেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাহলে আন্দোলন সফল হবে কি করে?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: পুলিশের বেপরোয়া গুলির কথা আমরা জানি। আর কতটা গুলি করছে তাও জানি। মূলকথা হল এরশাদ, জিয়াউর রহমান ও ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে যখন সামরিক সরকার ছিল তখনও আন্দোলন হয়েছে এবং ৯৬ সালেও দেশে আন্দোলন হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর কারণে নেতাকর্মীরা বাসা থেকে বের হতে পারছে না মানলাম। কিন্তু তারা বের হয়ে দেখাতো যে তারা আন্দোলন করার ব্যাপারে আন্তরিক। সবাই একযোগে বের হলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারতো। পুলিশ যদি এক্ষেত্রে গণগ্রেপ্তার করতো তাহলে বিশ্বের কাছে একটা ভুল বার্তা যেতো। কিন্তু তারা এরকম কিছ্ইু করেনি। সুতরাং আমি মনে করি এ আন্দোলন জনগণের অনুভূতিকে নাড়া দিতে পারেনি।
ঢাকাটাইমস: বিরোধীদলের বর্তমান লক্ষ্য কি বলে মনে হচ্ছে?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: সব দাবি বাদ দিয়ে বর্তমানে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাচ্ছেন। এখন এই দাবিতে এসে বিরোধীদল বাকি সব ভুলে গেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার এই আবদারে মানুষ রাজি নন। মানুষ একটা সমঝোতা চাচ্ছে।
ঢাকাটাইমস: বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির কি করা উচিত?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: দুই নেত্রীর অনেক উপদেষ্টা একসাথে বসে আলোচনা করার কথা বলছে। কিন্তু বসার ব্যবস্থা করছেন না। দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে গত পাঁচ বছরে শেখ হাসিনার অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এমন কোন খারাপ কাজ করেনি যার ফলে জীবনের ঝুকি নিয়ে নিয়ে মানুষ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়বে। এরকম অবস্থা হলে মানুষ মাঠে নেমে যেতো। সুতরাং আমার মনে হয় বিরোধীদল আন্দোলন করতে চায় করুক। কিন্তু মূল জায়গা ঠিক রেখে করতে হবে। বিএনপি যদি মনে করে জনগণ তাদের ক্ষমতায় বসাবে তাহলে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করুক।
ঢাকাটাইমস: সরকার অবরোধ দিয়ে যানবাহন বন্ধ করছে বলে অভিযোগ করছে বিরোধীদল। বিষয়টি নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: যানবাহন সরকার বন্ধ করেনি। মালিক সমিতি ও শ্রমিক সমিতি বন্ধ করেছে। হয়তো এতে সরকারের পরোক্ষ সায় রয়েছে । কিন্তু আমরা বিরোধীদলের অবরোধে দেখি ট্রেনের বগিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে, পেট্রল বোমা মারা হচ্ছে, ট্রেনের লাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে। এটা রাজনৈতিক কারণে উভয়দল করছে। সুতরাং কেউ কাউকে দোষারোপ করে কোন লাভ নেই।
ঢাকাটাইমস: আইনজীবীদের উপর হামলার বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: হাইকোর্টে বহিরাগতরা প্রবেশ করে আইনজীবীদেরকে আক্রমন করবে এটা সমর্থনযোগ্য নয়। আমি নিজেও আইনের ছাত্র ছিলাম। আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টে আমার যাওয়া আসা ৮৯ সাল থেকে। হাইকোর্ট একটা পবিত্র জায়গা। আইনজীবীদের সাথে আগে যারা প্রবেশ করেছে এবং পরে যারা প্রবেশ করেছে তারা উভয়ই এই ঘটনার জন্য দায়ি। যেকোন মূলে এইসব জায়গার পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে।
ঢাকাটাইমস: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর হামলার ঘটনা কিভাবে মূল্যায়ণ করবেন?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর হামলার ঘটনায় আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত ব্যাথিত। তবে এরধরণে ঘটনা না হওয়াই ভাল। এরকম ঘটনা ভবিষৎতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। সুতরাং এরকম ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই কামনা করছি।
ঢাকাটাইমস: চলমান সংকট উত্তরণে সমাধান আছে কি?
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হলে যেকোন মূল্যে দুই নেত্রীকে একত্রে বসতে হবে। তবে বর্তমান পরিস্থির জন্য বেশি দায়ি করবো বিরোধীদলকে। প্রধানমন্ত্রী নানা উপায়ে একাধিকবার বিরোধীদলকে আলোচনায় বসার আহবান জানিয়েছেন। ধরে নিলাম শেখ হাসিনা আন্তরিক নয়। কিন্তু বসলেতো একটা সমাধানে আসা যেতো। না বসলে আন্তরিক নাকি আন্তরিক না এটাতো মূল্যায়ণ করা যাবে না। সমস্যা হলো সবাই সবার মতো করে জয়ী হতে চায়।
ঢাকাটাইমস: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. অহিদুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন: মানিক মোহাম্মদ।