logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
সাংসদদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে তদন্ত হতেই পারে: গোলাম রহমান
০৬ জানুয়ারি, ২০১৪ ১১:২৫:১৬
image


গোলাম রহমান। দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান। ঢাকাটাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন মন্ত্রী-সাংসদদের দুর্নীতি, পদ্মা সেতু, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আগের সরকারের দুর্নীতি ও খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের অক্ষমতা ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মোসাদ্দেক বশির





ঢাকাটাইমস : গত পাঁচ বছরে মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে কি না তা তদন্ত করে দেখার দাবি উঠেছে।

গোলাম রহমান : দুদকের আইনে যেকোনো সময় যেকারো সম্পদের উৎস নিয়ে তদন্ত করা যায়। মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। কাজেই এ বিষয়ে তদন্ত হতেই পারে।

ঢাকাটাইমস: আপনার সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ। এই অভিযোগে করা মামলায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি করা হয়নি কেন?

গোলাম রহমান : আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগটা ছিল, তিনি এসএনসি-লাভালিনকে কাজ দিতে চেয়েছিলেন। পদ্মা সেতুর কাজ পেতেও প্রতিষ্ঠানটি কাকে কাকে ঘুষ দিতে হবে তার একটি তালিকা তৈরি করে। তবে এর মানে এই নয় যে, যাদের নামে তালিকা করা হয়েছে তারা ঘুষ চেয়েছিলেন। তাদের তালিকায় কয়েকজনের নাম আছে, যাদের সঙ্গে ওরা দেখাও করেনি। আবার দরপত্র নিয়ে একটি বাছাই কমিটি করা হয়। কমিটিতে ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ও আইনুন নিশাতের মতো মানুষরা। আমাদের অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের স্পষ্ট ও লিখিতভাবে তারা বলেছেন, আবুল হোসেন কখনো তাদের প্রভাবিত করেননি। এরপরও তাকে আসামি করাটা কি যৌক্তিক হতো?

ঢাকাটাইমস: পদ্মা সেতু দুর্নীতির বিষয়ে বলা হয়েছে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। ষড়যন্ত্র করলেই কি তারা অপরাধী হয়?

গোলাম রহমান : আমাদের দেশে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হরহামেশাই হচ্ছে। অনেক কাজেই দরপত্র জমা দিতে দেওয়া হয় না, কয়েকজন মিলে আঁতাত করে দরপত্র জমা দেয়। এসব হলো ষড়যন্ত্র। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও অভিযোগটা একই রকম প্রায়। মামলাটি যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে এটা মাইলফলক হয়ে যাবে। এই মামলায় কানাডাতে তদন্ত হচ্ছে। কানাডায় মামলা প্রমাণ হলে বাংলাদেশও এসব তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ না করে পারবে না। সৈয়দ আবুল হোসেনের যদি কোনো সম্পৃক্ততা থাকে তাহলে তিনি রেহাই পাবেন না।

ঢাকাটাইমস: বিশ্বব্যাংক গঠিত অনুসন্ধান কমিটি দুই বার বাংলাদেশে আপনাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকগুলোয় আসলে কী হয়েছিল?

গোলাম রহমান :  তারা জানতে চেয়েছিলেন আবুল হোসেন মন্ত্রী ছিলেন। তাই তিনি এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে পারেন না। তাই তাকে মামলায় আসামি করার কথা বলেছেন।  বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে। উপদেষ্টা মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক অনেক অভিযোগ করেছে। তাকে না সরালে অনুসন্ধান করা হবে না। কিন্তু ওদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাকে অভিযুক্ত করা হয়নি।

ঢাকাটাইমস: পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন না করাটি কিভাবে দেখেন?

গোলাম রহমান : আমার বুঝে আসে না বিশ্বব্যাংক কেন পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিল। এটা মনে হয় লঘু পাপে গুরু শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

ঢাকাটাইমস: আবুল হোসেনকে মামলায় আসামি করলে তো বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করত?

গোলাম রহমান : কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে দালিলিক প্রমাণ লাগবে। আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো দালিলিক প্রমাণ না পাওয়ার কারণে তাকে আসামি করা হয়নি। তাকে আসামি করলে বিশ্বব্যাংকের কাছে নতি স্বীকার করা হতো। এটা তো বিবেকের কাছে সায় দেয় না।

ঢাকাটাইমস: বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপনাদের মিটিংয়ে উতপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছিল বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

গোলাম রহমান : ওরা বারবার বলছিল আবুল হোসেনকে আসামি করতে। তবে আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছি, তাঁর জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।

ঢাকাটাইমস: আবুল হোসেনকে মামলা করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা ছিল কি?

গোলাম রহমান : ওই সময় সরকারের সঙ্গে আমার একটি সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। সেই যোগাযোগটা ছিল অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে। তবে তিনি কখনো বলেননি যে কাউকে মামলা থেকে বাদ দিতে হবে। আমরা সবাই চাচ্ছিলাম পদ্মা সেতুটা হোক।

ঢাকাটাইমস: হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর নাম আলোচনায় ছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। তাকে কেন আসামি করা হয়নি?

গোলাম রহমান : মোদাচ্ছের আলী ওই ব্যাংকে গেছেন। আমি আমার অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের বলেছি, দালিলিকভাবে বা সাক্ষীর ধারা দুর্নীতির বিষয়টি যদি প্রমাণ করতে পারেন তাহলে তাকে ছাড় দেবেন না।  তবে সেই প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ঢাকাটাইমস: আমাদের দেশে দুর্নীতি দমনের চ্যালেঞ্জগুলো কী?

গোলাম রহমান : দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। সরকার বা শাসকের দায়িত্ব হলো যারা শাসিত তাদের দুর্নীতিবাজদের হাত থেকে রক্ষা করা। পাশাপাশি দুর্নীতিবাজকে শাস্তির আওতায় আনা। তৃতীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। বৃত্তবানদের দুর্নীতি হলো মানসিক ব্যাধি। তাদের দুর্নীতি থেকে দূরে রাখার জন্য শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।

ঢাকাটাইমস: আপনি দুদককে বলেছেন নখ ও দন্তহীন বাঘ। দুদক সম্পর্কে এমন মন্তব্য করার পেছনে কারণ কী ছিল?

গোলাম রহমান : দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদক অনেক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দুদক উল্লেখযোগ্য কাউকে সাজা দিতে পারেনি। এ জন্য দুদক সম্পর্কে আমার মন্তব্য ছিল এ রকম।

ঢাকাটাইমস: দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনে দুর্নীতি প্রতিরোধে কোনো লাভ হয়েছে কি?

গোলাম রহমান : কমিশন গঠনের পর অনেক বড় বড় কর্মকর্তা, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সচিবদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান, জিজ্ঞাসাবাদ ও মামলা করা হয়েছে। ব্যুরো থাকলে এটি করা সম্ভব হতো বলে আমার মনে হয় না।

ঢাকাটাইমস: দুর্নীতিবাজদের কেন সাজার আওতায় আনা যাচ্ছে না?

গোলাম রহমান : মূল সমস্যা হলো আইনের দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা। আমাদের দেশে বিচার সম্পন্ন করতে অনেক বছর লেগে যায়। ফলে যারা মামলা পরিচালনা করেন তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং অনেক সময় সাক্ষীও হারিয়ে যায়। দুর্নীতিবাজদের সাজা নিশ্চিত করতে আমাদের আইনি ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।   

ঢাকাটাইমস: গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুদক খুব তৎপর ছিল। সেই তৎপরতাকে কিভাবে দেখেন?

গোলাম রহমান : তখন দেশে জরুরি অবস্থা চলছিল, মৌলিক অধিকার বন্ধ ছিল, বহু লোককে দুর্নীতির অভিযোগে জেলে পাঠানো হয়েছিল। যখন মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলো তখন তারা আদালতে গেলে তাদের সাজা আর টেকেনি। এখন দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করছে। দুদক অনুসন্ধান করে যার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাচ্ছে তার বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দিচ্ছে।  

ঢাকাটাইমস: অভিযোগ করা হয়, দুদক বিরোধী দলকে দমনের জন্য কাজ করে।

গোলাম রহমান : এই অভিযোগটি ঠিক নয়। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় অনেক লোকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অনুসন্ধান হয়েছে। মামলা হয়েছে। কিছু কিছু অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে ছিল। আমি চেয়ারম্যান থাকাকালে সেসব অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত না করে কাউকে মুক্তি দিইনি।

ঢাকাটাইমস: বিরোধীদলীয় নেতার বিরুদ্ধে তো দুদকের করা মামলা এখনো চলছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলাগুলো বন্ধ আছে।

গোলাম রহমান :  বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার ভৈরব সেতু দুর্নীতি অভিযোগ আসে। কমিশনের কাছে মনে হয়েছে এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির অভিযোগটি দালিলিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকার একটি কমিশন গঠন করেছে। ওই কমিশন সাড়ে তিনশ দুদকের মামলা প্রত্যাহার করার জন্য সুপারিশ করেছিল। কিন্তু আমরা তা মানিনি। তারা আদালতের মাধ্যমে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করুক। এই মামলাগুলোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও মামলা ছিল।

ঢাকাটাইমস: মামলা প্রমাণ না হলে সংশোধিত আইনে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের সাজার বিধান করা হয়েছে। এতে দুদকের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসবে বলে মনে করেন কি?

গোলাম রহমান : অনেক সময় অভিযোগ উঠে হয়রানি করতে দুদককে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক সময় মিথ্যা অভিযোগে অনেকে সমস্যায় ভোগেন। দুদকের দ্বারা এসব যাতে না হয় সে জন্য এই আইনটি করা হয়েছে। এতে দুদকের কার্যক্রমে আরো স্বচ্ছতা আসবে বলেই মনে করি। এতে দুদক কর্মকর্তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।

ঢাকাটাইমস: দুদককে বলা হয় একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। আসলে দুদক কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে?

গোলাম রহমান : দুদকের চেয়ারম্যান পদমর্যাদা আপিল বিভাগের বিচারপতির পদমর্যাদার সমান। কমিশনারের পদমর্যাদা হাইকোর্টের বিচারকের পদমর্যাদার সমান। তারা যেকোনো সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নিতে পারে। দুদকের কার্যক্রমে  কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে আমি মনে করি না।   

ঢাকাটাইমস: সংশোধিত দুদক আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিচারপতিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে দুদককে সরকারের অনুমোদন লাগবে। এটা কতটা যৌক্তিক?

গোলাম রহমান : এ আইনের কারণে দুদক স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে না। এর আগেও সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে আইন করা হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে হাইকোর্ট তা বাতিল করে দিয়েছে। দুদকের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় উচ্চ আদালতে পর্যালোচনার পর আইনটি টিকবে বলে আমার মনে হয় না।

(ঢাকাটাইমস/ ০৬ জানুয়ারি/ এআর/ ঘ.)