ঢাকা: একবাক্যে তার সম্পর্কে বলা যায় বাংলাদেশের আধুনিক ক্রিকেটের ইতিহাসের সঙ্গী।তার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ ১৯৯৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতে নতুন এক ক্রিকেট যুগে পা রেখেছিল। তারপর প্রথম বিশ্বকাপ, প্রথম টেস্ট; একটার পর একটা ইতিহাসের অংশ হয়েছেন। এরপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশের সফলতম বিশ্বকাপ অভিযানে জাতীয় দলের নির্বাচক ছিলেন। সেই থেকে ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় দলের নির্বাচক থেকে প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করেছেন; মাঝে জাতীয় দলের ম্যানেজারের ভূমিকাও পালন করেছেন।
বর্ণাঢ্য এই জীবনের যাত্রায় এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক আকরাম খান।
বিসিবি পরিচালক হিসেবে পেয়েছেন বোর্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি চালানোর দায়িত্ব। সে দায়িত্ব দারুণ উপভোগ করছেন বলেই জানান সাবেক এই অধিনায়ক ও প্রধান নির্বাচক। এই মুহূর্তে তাকে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজসহ তিনটি বড় ইভেন্টের জন্য জাতীয় দলের প্রস্তুতি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। সেই ভাবনার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়েও কথা বলেছেন আকরাম।
আর নিজের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার এসব কথা বলেছেন তিনি ঢাকাটাইমসকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দিবাকর আচার্য্য
এখন তো শ্রীলঙ্কা আসছে বলে একটা সবুজ সংকেত পাওয়া গেছে। ফলে আপনারা এক ধরনের স্বস্তি নিয়ে কাজ করতে পারছেন বলা যায় ?
হ্যাঁ, এখন তো স্বস্তিতেই আছি। একটা অনিশ্চয়তা ছিল হয়ত। কিন্তু সে জন্য আমরা আমাদের প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি রাখিনি। মাত্রই বিজয়-দিবস টি-টোয়েন্টি শেষ হলো। এর আগে ‘এ’ দল ও জাতীয় দল একটা সিরিজ খেললো। তার আগে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ হলো। এর মাঝে আবার চট্টগ্রামে কর্পোরেট ক্রিকেটে অনেকে গিয়ে খেলে এসেছে। সবমিলে খেলোয়াড়রা কিন্তু দারুণ ম্যাচ প্র্যাকটিসের মধ্যে আছে। সবচেয়ে ভালো কথা হলো, জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা দারুণ পারফরমও করছে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের জন্য কতটা প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে খেলোয়াড়দের?
আমি মনে করি ছেলেরা পুরোপুরি প্রস্তুত। যতটা দরকার ছিল, তারা অনুশীলন ম্যাচ পেয়েছে। ফলে বলা যায়, বড় চ্যালেঞ্জ নিতে ওরা এখন প্রস্তুত আছে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট খেলতে হবে। লংগার ভার্সনের কী একটু ঘাটতি থেকে গেল?
না, সেটাও তো হচ্ছে। এই যে বিসিএল (বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ) শুরু হয়ে গেল। এখানে দেশের সেরা ৮০ জন খেলোয়াড় চারদিনের ম্যাচে খেলবে। খুবই ভালো ক্রিকেট হবে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে এটা আমাদের খুব কাজে দেবে। একটা কথা বলতে পারি যে, আমরা জাতীয় দলের অনুশীলনের জন্য যা চাচ্ছি, তা পাচ্ছি। এখন মাঠে সেই ফলটা পেলেই আমরা খুশি।
কী ফল হলে সেটাকে ‘ভালো’ বলবেন?
এটা তো বলা খুব কঠিন। ওরা নিজেদের সেরাটা খেললেই আমি খুশি। তারপর ফল তো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করবে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের পুরোনো রেকর্ড তো খুব ভালো না।
সেটা যেমন আছে। আবার ইতিবাচক দিক হলো, সর্বশেষ সফরে আমরা ওদের বিপক্ষে খুব ভালো খেলেছি। বিশেষ করে গেল টেস্টে অনেক ভালো পারফরম্যান্স করেছে খেলোয়াড়রা। দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বা গত দুই আড়াই বছর ধরেই বাংলাদেশ চমৎকার খেলছে। ফলে আমরা ইতিবাচক ভাবেই ভাবতে পারি।
আপনার নিজের কথা একটু বলুন। ক্রিকেট অপারেশন্সের দায়িত্ব কেমন উপভোগ করছেন?
খুব। খুব উপভোগ করছি। যেহেতু বোর্ডের সঙ্গেই আছি গত বছর ছয়েক ধরে, ফলে কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে; মোটামুটি একটা ধারণা আছে। আমি আগেও আপনাকে বলেছি যে, আমার চ্যালেঞ্জ দুটো। প্রথমত খেলোয়াড়দের একটা স্বচ্ছন্দ পরিবেশ দেয়া। ওরা যাতে কোনো কিছু নিয়ে অস্বস্তি বোধ না করে; ওদের যা দরকার, সেটা পূরণ করা। এরপর জাতীয় দল ও ‘এ’ দলের জন্য দলগত যত বেশি সম্ভব অনুশীলন-ম্যাচের সুযোগ করে দেয়া। গত কিছুদিন টানা ঘরোয়া ক্রিকেট থাকায় জাতীয় দল ও ‘এ’ দল নিয়ে এই মুহূর্তে আমরা ওরকম নিবিড় কাজ করছি না। তবে এই ব্যস্ত সূচি শেষ হওয়ার পর সেটা আবার শুরু হবে।
খেলোয়াড়দের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক একইরকম থাকবে বলে বলেছেন অনেকবার। সেটা কী আছে?
হ্যাঁ, ওটাই আমার সবচেয়ে বড় কাজ। আমি বলি, খেলোয়াড়দের জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা। সেটাই ধরে রেখেছি। সব সময় ওদের সঙ্গে আমি ওদের একজন হয়েই থাকতে চাই, চেষ্টা করি। ওদের স্বচ্ছন্দ রাখাই আমার কাজ। সেটা করতে পারলেই ওদের কাছ থেকে সেরা পারফরম্যান্সটা পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
একটু চট্টগ্রাম প্রসঙ্গ। আপনি চট্টগ্রামের কাউন্সিলর হিসেবে বোর্ডে এসেছেন। সেখানকার খেলোয়াড়দের, ক্রিকেটামোদীদের আপনার ওপর আলাদা কিছু দাবি আছে। আপনার ভাতিজা তামিম সম্প্রতি আফসোস করে বলেছেন, চট্টগ্রাম থেকে আর আপনাদের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে খেলোয়াড় বের হচ্ছে না…
হ্যাঁ, এটা তো শুধু তামিমের নয়, আমাদেরও আফসোস। এই শহর থেকে এক সময় অনেক কোয়ালিটি সম্পন্ন খেলোয়াড় বেরিয়েছেন। নান্নু ভাই, নোবেল ভাই, মাসুম ভাই, শহীদ ভাই থেকে এই তামিম, নাফীস, আফতাবরা। কিন্তু এখন তামিম ছাড়া জাতীয় দলে কেউ নেই। নতুন কেউ উঠে আসছে তেমনও নয়। অবশ্যই আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই পরিস্থিতিটা বদলানো।
সে জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে?
অবশ্যই। দেখুন, খেলোয়াড়ের বিকাশের জন্য অনেক-অনেক ক্রিকেটের বিকল্প নেই। মাঝে তো চট্টগ্রামে ক্রিকেট অনেক কমে গিয়েছিল। নাছির ভাই (আজম নাছির) গত ক’বছর ধরে অবস্থাটা বদলানোর চেষ্টা করছেন। এখন তরুণদের নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে, খেলাও হচ্ছে অনেক। এটাকে বাড়াতে হবে। আপনি যদি প্রচুর ক্রিকেট খেলাতে পারেন; তাহলে খেলোয়াড় বের হবেই।
চট্টগ্রাম ছাড়া বিভাগের বাকি জেলাগুলোর ব্যাপারে কোনো কিছু ভাবছেন?
অবশ্যই। ক্রিকেটকে রাজধানী বা মহানগরীমুখী করে রাখলে কাজ হবে না। জেলা পর্যায়ে খেলাটা নিয়মিত আয়োজনের জন্য যা যা দরকার করতে হবে। আমার তো তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা আছে। এখান থেকে বিশেষ করে মহিলা ক্রিকেটারদের বেরিয়ে আসার ভালো সম্ভাবনা আছে। আমি চাই চট্টগ্রামের প্রতিটা জেলায় সারা বছর ক্রিকেট চলুক।
পুরো দেশ নিয়েও তো ভাবতে হবে…
অবশ্যই। চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করাটা আমি পুরো দেশের ক্রিকেট নিয়েই কাজ করার অংশ হিসেবে দেখছি। আসলে আমি এখন দেশের প্রতিটা জেলা নিয়ে পরিকল্পনা করে সেটা বাস্তবায়িত করতে পারব না। চট্টগ্রামে কাজগুলো করে একটা মডেল যদি তৈরি করতে পারি, দেখবেন, প্রতিটা বিভাগে-জেলায় সেরকম কাজ হচ্ছে।
জাতীয় দলকে আরও শক্তিশালী করা এবং দলের একটা শক্ত পাইপলাইন করা নিয়ে আপনি অনেক দিন ধরে কথা বলছিলেন।
হ্যাঁ, এটাকে সংগঠক হিসেবে আমার প্রধান স্বপ্ন বলতে পারেন। আমাদের বয়সভিত্তিক দলগুলো যে কোনো কারণেই হোক, আগের মতো আর পাইপলাইন হিসেবে খুব ভালো অবস্থায় নেই। এখন যারা জাতীয় দলে আছেন, তাদের খুব বেশি বিকল্প বয়সভিত্তিক দলগুলোতে পাবেন না। আমি আগেও বলেছি, যে পাইপ লাইনের কথা আমি বলি, সেটা নির্বাচক হিসেবে আমার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। সেটা নিয়েই কাজ করতে চাই। এ ব্যাপারে আমার বিস্তারিত পরিকল্পনা আছে। সব কাজ হয়ত আমার পদে থেকে সরাসরি করতে পারব না। সেটা জরুরিও না। এটা টিম ওয়ার্কের মতো। সবাই মিলে কাজ করতে হবে। আমার আইডিয়াগুলো শেয়ার করছি।
পেস বোলারদের নিয়ে আপনার একাডেমি করার পরিকল্পনাটা আছে এখনও?
অবশ্যই। আমি তো ওটার কাজ বেশ এগিয়ে নিয়েছিলাম। আমি একা না, ওটার পরিকল্পনা আমরা কয়েকজন মিলেই করেছি। সেই যে সীমবদ্ধতার কথা, সেসব কারণেই হয়নি। এবার পেস বোলিং একাডেমিটা অবশ্যই দাঁড় করাতে চাই।
অধিনায়ক ও প্রধান নির্বাচক হিসেবে সফলতার সঙ্গে নিজের সময় শেষ করেছেন। কর্মকর্তা হিসেবে খুব বেশি লোক ‘সফল’ বলে স্বীকৃতি পায় না। আপনি পাবেন তো?
আমি অধিনায়ক হিসেবে সফল ছিলাম টিমমেটদের জন্য, আমি প্রধান নির্বাচক হিসেবে সফল ছিলাম কারণ সঙ্গীরা ভালো করেছেন। কর্মকর্তা হিসেবেও ব্যাপারটা তাই। টিম ভালো করলে আমিও ভালো করব। আমি টিম মেম্বার হিসেবেই খেলব। আশা করি, নিজের সুনামটা ধরে রাখতে পারব।
(ঢাকাটাইমস/ ১৫ জানুয়ারি/ এআর)