রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে
১৫ জানুয়ারি, ২০১৪ ১১:৪৪:১২

ড. মিজানুর রহমান: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা, সংখ্যালঘুদের সম্প্রদায়ের উপর হামলা,সরকার ও কমিশনের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকাটাইমসের সঙ্গে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা থেমে নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এটি বেড়েছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতা যেন প্রলম্বিত না হয়। ব্যর্থতা প্রলম্বিত হলে দেশ বিপন্ন হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যেতে পারে।
কেন মনে করছেন রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ?
বাংলাদেশের ৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, যে কোনো নির্বাচনকালীন সময়ে সংখ্যালঘুরা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সেজন্য প্রত্যাশা ছিল তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি রাষ্ট্র আন্তরিকতার সঙ্গে দেখবে। নির্বাচন কমিশন আমাদের এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়েছে এগুলো তো বিবেচনায় আনাই হয়নি; বরং যশোরের অভয়গ্রামে, দিনাজপুরে, গাইবান্ধা, লক্ষ্মীপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে গিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। রাষ্ট্র আমাদের দেয়া কথা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ রাখতে পারেননি। তাই বলেছি নিরাপত্তা বিধান করতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে।
কমিশনের পক্ষ থেকে আপনারা কী ধরনের সুপারিশ করেছিলেন?
দেশের যেসব অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের পরিমাণ বেশি সেসব জায়গায় নির্বাচনকালীন সময়ে হামলার আশঙ্কার কথা সরকারের কাছে ব্যক্ত করেছিলাম। এটি মোকাবিলায় প্রতিটি স্থানে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি কমিটি গঠনের জন্য সুপারিশ করেছিলাম। ভেবেছিলাম এগুলো বিবেচনা করা হবে। কিন্তু তা হয়নি।
মানবাধিকার রক্ষায় আপনাদের কী করার আছে?
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনানুযায়ী সুপারিশমূলক একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা আশঙ্কার কথা উল্লেখ করতে পারি, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুপারিশ প্রণয়ন করতে পারি। নিজেরা অপরাধী শনাক্তও করতে পারব না। কোনো শাস্তিও দিতে পারব না। আইন আমাদের সেই ক্ষমতা দেয়নি।
সরকারের কী করা উচিত?
সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রের উচিত আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, ক্ষতিপূরণ দেয়া এবং যারা এসব অপরাধে অপরাধী তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।
এ যাবৎকালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কমিশন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে কতটুকু দাঁড়াতে পেরেছে?
ব্যাপারটি আপেক্ষিক। মনে রাখতে হবে আমরা যে মানবাধিকার কমিশনের কথা বলছি তার জনবল সব মিলিয়ে ২৮ জন। এর মধ্যে হয়ত আটজনের বুদ্ধিভিত্তিক অবদান রাখার ক্ষমতা আছে। এই জনবল নিয়ে আমরা কতটুকু এগুতে পারব এবং কতটুকু কার্যকরভাবে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারব এটা বড় প্রশ্ন।
কমিশন সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার নিশ্চিতে কতটুকু সক্রিয় আছে?
সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ঠেকাতে কমিশন খুবই সক্রিয়। যেখানেই ঘটনা ঘটেছে আমরা সেখানেই ছুটে গিয়েছি। নির্যাতিতদের পাশে সব সময়ই দাঁড়িয়েছি। রাষ্ট্রকে তাদের কর্তব্যের ব্যাপারে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় করেছি।
আক্রান্ত এলাকায় ঘুরে নির্যাতিতদের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখেছেন?
আমরা যাওয়ায় নির্যাতিতদের মনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে। নির্যাতিতরা মনে করেছেন তারা একা নন। তাদের সহযোগী, সহযোদ্ধা রয়েছে।
মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কতটা সফল?
গত সাড়ে তিন বছরের মাথায় আমরা একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনকে মানুষের সামনে দাঁড় করাতে সমর্থ্য হয়েছি। কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটা মজবুত করতে সক্ষম হয়েছি। তবে রাজনৈতিক স্পর্শকাতর জায়গায় হয়ত অনেকে বলতে পারেন কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। কিন্তু এর বাইরে অন্যান্য ঘটনায় আমাদের সফলতার তালিকা বেশ দীর্ঘ। বাস্তবতাকে চিন্তায় রেখে আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে। ঢালাওভাবে আমি সাংঘাতিক সফলতার দাবি করব না। একদমই যে ব্যর্থ হয়েছি, এটাও স্বীকার করব না।
কমিশন কতটুকু নিরপেক্ষ থেকে কাজ করছে?
এ দেশের সংস্কৃতিতে যে কোনো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তারা অতিসত্বর সরকারি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে। অন্ততপক্ষে সেই জায়গাটায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মাথা উঁচু রেখে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছে। তার প্রমাণ দিয়েছে। তবে আমাদের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দর্শনের মিল থাকতে পারে।
সেটি কী ধরনের দর্শন?
স্বাধীনতার মূল্যবোধ। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক যা কিছু অর্জন। সে জায়গায় আমরা একদমই নিরপেক্ষ নই। স্বাধীনতার চেতনার ব্যাপারে নিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে যারা প্রতিক্রিয়াশীল তাদের দিকে হয়ত ঝুঁকে পড়ছি। এই জায়গায় দৃঢ়ভাবে আমাদের অবস্থান ধরে রেখেছি।
রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনাকে মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে দেখছেন?
‘রাজনৈতিক সহিংসতা’ কথাটির সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি। কারণ, ধরে নিলাম প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। বিএনপি আগ্রাসী ভূমিকায় থাকলে তারা আওয়ামী লীগারদের আক্রমণ করত। অগ্নিদগ্ধ, পঙ্গু ও ক্ষতিগ্রস্ত হতো আওয়ামী লীগাররা। কিন্তু আমরা দেখছি আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষ। যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা নেই। যারা রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝেন না।
তাহলে এটিকে কী ধরনের সহিংসতা বলবেন?
রাজনৈতিক কোনো সমস্যাকে কেন্দ্র করে হয়ত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই অজুহাতকে ব্যবহার করে এটি সন্ত্রাসবাদ কিংবা জঙ্গিবাদের রূপান্তরিত হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের মূল প্রাণে আঘাত হেনেছে। সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, সার্বভৌমত্ব এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। এটি আমাদের বুঝতে হবে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সহিংসতা হিসেবে ঢালাওভাবে চালিয়ে দেয়া হলে এই অবস্থার গুরুত্বকে অনেক ছোট করে ফেলা হবে। সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতার পরিচয় পাবে।
(ঢাকাটাইমস/১৫ জানুয়ারি/ এআর/ ঘ.)