logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
ভাষার জন্য রক্ত দেয়া জাতি কখনো পরাজিত হবে না: রশীদ হায়দার
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ১১:৩৬:১৯
image


তিনি একজন কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় পার্টটাইম চাকরির মধ্য দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। ১৯৬৪ সালে ‘চিত্রালী’র পাশাপাশি পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডের মুখপত্র ‘পরিক্রম’-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। স্নাতক পরীক্ষার কিছুদিন আগে ‘চিত্রালী’র কাজ ছেড়ে দিয়ে রিসার্চ অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে যোগ দেন ‘ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তানে’। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পত্রিকা ‘কৃষি ঋণ’-এর সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭২ সালে চাকরি পেয়ে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে একাডেমির পরিচালক হিসেবে অবসর নেন। গল্প-উপন্যাস রচনার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা গবেষণাকর্ম রয়েছে তার। ১৯৮৪ বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। এ বছরে ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে তিনি বাংলা একাডেমি ভবনে মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকাটাইমসকের সঙ্গে। কথা বলেছেন সাহিত্য, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ে। কথা বলেছেন স্বকৃত নোমান

ঢাকাটাইমস: একুশে পদকে ভূষিত হলেন। আপনার অনুভূতি কেমন?

রশীদ হায়দার: আসলে আমি কী কাজ করেছি তা বিচার করার মালিক আমি নই, সে সম্পর্কে মন্তব্য করার অধিকারও আমার নেই। কারণ, যখনই একটা লেখা প্রকাশ হয়ে যায় তখন সেটা আর লেখকের থাকে না, সেটা জনগণের সম্পত্তি হয়ে যায়। সুতরাং সে সম্পর্কে মতামত দেয়ার অধিকার রাখে পাঠক বা জনগণ। তারপরও যে কোনো পুরস্কার বা স্বীকৃতি আনন্দের বিষয়। পুরস্কার আমাকেও আনন্দিত করেছে।

ঢাকাটাইমস: আপনি সাংস্কৃতিক পরিবারের মানুষ। আপনার ভাইদের সবাই কবিতা লেখেন। অথচ আপনি ব্যতিক্রম, কথাসাহিত্যিক। কথাসাহিত্যে উদ্বুদ্ধ হলেন কিভাবে?

রশীদ হায়দার: কবিতা আমি যে একটা-দুটো লিখতে চেষ্টা করিনি তা নয়। কিন্তু দেখলাম যে, কবিতা লেখার চেয়ে গদ্য লেখা আমার জন্য আনন্দের। গদ্য লিখতে আমি অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গদ্য লিখতে পারি। আর উদ্বুদ্ধ হওয়ার পেছনে একটা কারণ আছে। ছোটবেলায় আমি ভালো চোর ছিলাম। আমি নিয়মিত বাজার করতাম। বাজার করতে গিয়ে পয়সা চুরি করা আমার একটা প্রিয় অভ্যাস ছিল। দু-এক আনা মেরে দিতাম। পাবনা শহরের সিনেমা হলে সাড়ে তিন আনায় সামনের সারির টিকিট পাওয়া যেত। সেই মেরে দেয়া পয়সা দিয়ে কত যে ছবি দেখেছি আমি তার কোনো হিসাব নেই। ক্লাস থ্রিতে থাকতেই হাতেখড়ির মতো আমার ‘মুখেবিড়ি’ হয়েছিল। তখন থেকেই বিড়ি টানতাম। একেবারে উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে যাকে বলে। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় আমি পাবনার ঐতিহ্যবাহী অন্নদা গোবিন্দ লাইব্রেরির সদস্য হই। আমার শিক্ষক বিমল কুমার ভৌমিক একদিন আমাকে ‘পথের পাঁচালি’ বইটি পড়তে দিলেন। এই বই পড়ে আমার মনে হলো আমার গোটা জীবন যেন পাল্টে গেল। এ বইটিই আমাকে কথাসাহিত্য রচনায় উদ্ভুদ্ধ করে। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখি বড় হয়ে কথাসাহিত্যিক হব।

ঢাকাটাইমস: গল্প-উপন্যাস লিখছিলেন, মাঝে আপনি গবেষণার দিকে ঝুঁকলেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনেক গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন। ‘স্মৃতি ১৯৭১’ ও ‘১৯৭১ : ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’, ‘খুঁজে ফিরি’ ইত্যাদি আপনার উল্লেখযোগ্য কাজ। এসব কাজ কি কোনো দায়বোধ থেকে করা?

রশীদ হায়দার: ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ৩০। আমি সরাসরি যুদ্ধে যাইনি। এই অপরাধবোধটা আমার ছিল। পরবর্তী সময় যখন উপলব্ধি করলাম যে, যুদ্ধের পরে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেই যুদ্ধে আমার কিছু করার আছে। লেখক হিসেবে আমার যা সাধ্য ছিল আমি তা করার চেষ্টা করেছি। আমাকে প্রথম এই কাজগুলো করতে দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক মনজুরে মাওলা। আমি খুব উৎসাহের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজ করতে আগ্রহী হই।

ঢাকাটাইমস: মুক্তিযুদ্ধের পর তেতাল্লিশ বছর কেটে গেল। এই দীর্ঘ সময়ে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

রশীদ হায়দার: না, পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ আমাদের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি, যুদ্ধ এখনো চলছে। এই যুদ্ধ আরো কিছুদিন চলবে, চলতেই হবে। তার কারণ, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়গুলোতে কোন দল বা কোন মানসিকতার মানুষগুলো ক্ষমতায় ছিল সেটা দেখতে হবে। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মানুষের মন থেকে মুছে দেয়া হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা ও মিথ্যা দিয়ে ভরিয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন মরহুম জিয়াউর রহমানের কথাই ধরুন। তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, কোন অধিকারে তিনি নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক দাবি করেন? তার দলের লোকেরা যে তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে মাইক ফাটিয়ে দিচ্ছেন, আমার প্রশ্ন, এই অধিকার তারা পেলেন কোথায়? একটা মানুষ তেলের ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন আর লাখ লাখ লোক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল, রাতারাতি দেশ স্বাধীন হয়ে গেলÑ বিষয়টা এত সস্তা? এই ইতিহাস মিথ্যা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়গুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করা হয়েছে, অসংখ্য নির্দোষ মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। সেই অবস্থা থেকে পরবর্তীকালে আমরা মুক্তি পেয়েছি। তবে যুদ্ধ এখনো চলছে। এই যুদ্ধ যেদিন শেষ হবে সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে।

ঢাকাটাইমস: মুক্তিযুদ্ধ এত বড় একটি ঘটনা, কিন্তু এ ঘটনা নিয়ে বাংলা ভাষায় এখনো পর্যন্ত সেই মাপের কোনো উপন্যাস রচিত হলো না। কেন হলো না? একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে আপনার মতামত কী?

রশীদ হায়দার: ওই যে বললাম, আমরা এখনো যুদ্ধের মধ্যেই আছি। এছাড়া আমাদের মধ্যে এখনো যুদ্ধের আবেগটা রয়ে গেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অসংখ্য লিখিত কাজ হয়েছে এরই মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক বইয়ের পরিমাণ দেখে আমার আশাবাদ বেড়ে গেছে। লিখিত জিনিসের শক্তি অন্তঃস্রোতের মতো। কখন কোথায় গিয়ে যে আঘাত করবে কেউ বলতে পারবে না। এই আঘাত হতে পাঁচ বছর, দশ বছর, বিশ বছর বা ত্রিশ বছরও লাগতে পারে। কিন্তু একদিন ঠিকই এই শক্তি কোথাও না কোথাও আঘাত করবেই। আমি আশাবাদী, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোনো মহান শিল্পী নির্মোহভাবে বিশাল পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস লিখবেন অবশ্যই। এ ছাড়া আপনি দেখবেন যে, আমাদের নাটকে সবচেয়ে ভালোভাবেই মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। এটা আমাদের অনেক বড় প্রাপ্তি।

ঢাকাটাইমস: আপনি বললেন যে, লিখিত জিনিস অন্তঃস্রোতের মতো। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে লেখার কদর কমে যাচ্ছে। মানুষ এখন ইন্টারনেটে নির্ভরশীল। চাইলে বহু তথ্য ইন্টারনেট সার্চ করে পেয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলছেন, বইয়ের যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনার কী মনে হয়?

রশীদ হায়দার: অসম্ভব। প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক না কেন বইয়ের কদর কখনোই কমবে না। যতই ই-বুক আসুক, মুদ্রিত বইয়ের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। বই একটা ক্ল্যাসিক মাধ্যম। বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। বইয়ের বিকল্প বই। আপনি বইয়ের মধ্যে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য পান ইন্টারনেটে কি ততটা পান? পান না। সুতরাং বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই।

ঢাকাটাইমস: প্রযুক্তি শিল্পী-সাহিত্যিকদের ধ্যানমগ্নতা নষ্ট করছে কি?

রশীদ হায়দার: আসলে প্রকৃত শিল্পীকে, প্রকৃত লেখককে, প্রকৃত স্রষ্টাকে কোনো কিছুই বিচলিত বা বিপথগামী করতে পারে না। কারণ তিনি জানেন, তিনি যে বিষয়টা পরিবেশন করতে যাচ্ছেন সেখানে ইতিহাসের সত্যতা আছে। দেশের কথা আছে, দেশের মাটির কথা আছে, মানুষের কথা আছে। প্রযুক্তির কল্যাণে সস্তা কিছু লিখে হয়তো কেউ সাময়িক প্রশংসা পেতে পারেন, বাহবা পেতে পারেন। কিন্তু কালের স্রোতে এক সময় তিনি হারিয়ে যাবেন। তাকে কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিল্প-সাহিত্য এমন একটা জিনিস, যে কারো তোয়াক্কাই করে না। যাকে রাখার তাকে রাখবে, যাকে ফেলে দেয়ার তাকে ছুড়ে ফেলে দেবে।

ঢাকাটাইমস: আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বাংলাদেশেও মহাসমারোহে দিবসটি উৎযাপন করা হচ্ছে। এটি তো ভিনদেশি সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে এর অনুপ্রবেশ আমাদের সংস্কৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে কিনা?

রশীদ হায়দার: আমি এটাকে অনুপ্রবেশ বলব না। আমরা তো এখন গ্লোবাল ভিলেজে বাস করছি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে সারা পৃথিবীতে পৌঁছে যেতে পারছি, তথ্য সরবরাহ করতে পারছি। আকাশ সংস্কৃতি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিকে সাময়িক প্রভাবান্বিত করলেও একেবারে হজম করে ফেলতে পারবেÑ এটা আমি মনে করি না। কারণ বাঙালি চরিত্রের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑ বাঙালি গ্রহণ যেমন করতে জানে, বর্জনও করতে জানে। বাংলার মাটি বর্ষায় যেমন নরম, গ্রীষ্মে তেমনি কঠিন, খটখটে। সেই কাঠিন্য দিয়েই বাইরের সব আবর্জনাকে দূরে ঠেলে দিতে পারে বাঙালি। এটাই বাঙালির শক্তি।

ঢাকাটাইমস: এই দেশের তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে আপনার আশাবাদ কী?

রশীদ হায়দার: বিপুল আশাবাদ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তরুণরা শাহবাগে যে ঘটনা ঘটাল তা অভূতপূর্ব। আমাদের অজান্তে ভেতরে ভেতরে একটা প্রজন্ম তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতিকে সহ্য করতে পারছিল না। তারা একটা স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায় ছিল। কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় ঘোষণার পর তাড়াতাড়িই এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে, পৃথিবীর ইতিহাসে এটা বিরল ঘটনা। আমি বিশ্বাস করি তরুণরা একদিন এই দেশকে বহু উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

ঢাকাটাইমস: বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার আশাবাদ কী?

রশীদ হায়দার: বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যাবে। যে দেশের মানুষ ভাষার জন্য অকাতরে রক্ত ঢেলে দেয়, যুদ্ধ করে একটা দেশকে স্বাধীন করে, সেই দেশের মানুষ কখনো পরাজিত হবে না। আমি এই ভাষার মাসে এ কথা বলছি, ভাষার জন্য অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দেয়া জাতি কখনো পরাজিত হবে না।