আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানজনক ‘অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড-২০১৪’ পেয়েছেন তিনি। নিটল-নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা এশীয় মুসলিম নারীদের মধ্যে প্রথম, যিনি এ পুরস্কার পেলেন। তিনি বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। সোনালী ব্যাংকের বর্তমান পরিচালক এবং বাংলাদেশ ইউএন উইমেন সিভিল সোসাইটি অ্যাডভাইজরি গ্রুপের সদস্য। পুরস্কারপ্রাপ্তি, নারী উদোক্তাদের চ্যালেঞ্জসহ নানা বিষয়ে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন মাহী
ঢাকাটাইমস: আপনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা ও বৃহৎ শিল্প গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্টও। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীর অংশগ্রহণে মূল প্রতিবন্ধকতাগুলো কী?
সেলিমা আহমাদ: আমরা তিনটি প্রতিবন্ধকতাকে বড় করে দেখি। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো সামাজিক। কোনো নারী ব্যবসা করতে চাইলে প্রথমেই বাধা আসে পরিবার থেকে। সংসার সামলানোর পর একজন নারী ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চাইলে তিনি যথেষ্ট সময় পান না।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে আমাদের নারীদের যথেষ্ট দক্ষতা তৈরি হয়নি। বাজারে কোন পণ্যের উৎপাদন, বিপণন লাভজনক, কোন পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি কী, বাজার ব্যবস্থা কেমন, ক্রেতাদের অবস্থান কোথায় ইত্যাদি বিষয়ে নারীর দক্ষতা কম। সম্ভাব্য পণ্য সম্পর্কে নারীর কাছে যথেষ্ট তথ্য না থাকায় তারা ব্যবসা করতে নেমেই কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হন। এই প্রতিযোগিতা সামাল দিয়ে ব্যবসা করা আরো কঠিন। এই সমস্যা সমাধানে আমরা নারী উদ্যোক্তাদের কাছে বহুমুখী তথ্য সরবরাহ করে থাকি।
প্রচলিত উৎসগুলো থেকে নারীর ঋণ পাওয়া বা অর্থসংস্থানের সমস্যাও আছে। ব্যাংক বা অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের ঋণ দিতে আগ্রহী হয় না। আমরা কথা বলে জেনেছি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা যিনি ঋণ দেবেন তিনি প্রথমেই কারণ দেখান, নারীকে টাকা দিলে যদি ফেরত না আসে। নারী যদি ব্যবসাটা ঠিকমতো পরিচালনা করতে না পারেন।
ঢাকাটাইমস: উচ্চশিক্ষা শেষে ব্যবসায় নারীর অংশগ্রহণ কেমন?
সেলিমা আহমাদ: একজন নারী ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রথমে একটি চাকরি খোঁজেন। একটি চাকরি করলে নিরাপদে জীবন যাপন করা সম্ভব- এ ধরনের প্রবণতা আমাদের সমাজে প্রায় প্রতিষ্ঠিত। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গেলে একটা ঝুঁঁকি নিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অনেক নারীর সেই যোগ্যতা থাকার পরও শুধু আত্মবিশ্বাসের অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে আসতে পারেন না বা চান না। ব্যবসা করতে গেলে লাভ যেমন হতে পারে, আবার লোকসানও হতে পারে। এই মনমানসিকতা অনেকের মধ্যে নেই। একজন নারী যদি কোনো কারণে সফল না হন, তাহলে পারিবারিক সংকটে পড়েন। টাকা-পয়সা ধারকর্জ করলে নারীর ক্ষেত্রে আরো সমস্যা হয়।
ঢাকাটাইমস: ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকারি কিছু সুবিধার কথা শোনা যায়। বাস্তবে এগুলো নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে কতটুকু সহায়ক?
সেলিমা আহমাদ: নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকারের সহায়তা আছে আবার প্রতিশ্রুতির কথাও শোনা যায়। দেশে তৃণমূলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আসছেন। তারা নিজেরাই গড়ে তুলছেন ছোট ছোট উদ্যোগ। যার মাধ্যমে নিজেদের আয় উপার্জনের পাশাপাশি সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান। সরকারের অব্যাহত নীতি সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়াতে পারলে নারীরাই দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারেন। এখন পান দোকান থেকে শুরু করে বুটিক, পার্লার, কৃষি, ট্রেডিং, হস্তজাত পণ্য, নার্সারি, দর্জি, ইন্টেরিয়র ডিজাইন, ছোট গার্মেন্ট, বায়িং হাউস, এমনকি আমদানি-রপ্তানি ব্যবসাতেও নারীরা সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছেন। দেশে ১১ হাজারের বেশি নারী উদ্যোক্তা সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। এই উদ্যোক্তারাই দেশে দেড় লক্ষাধিক বেকারের কর্মসংস্থান করেছেন।
ঢাকাটাইমস: নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?
সেলিমা আহমাদ: আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রচুর নারী উদ্যোক্তা তৈরি করেছি। এ বছর সারা দেশে প্রায় ১৬ হাজার নারী উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে হাতিয়া উপজেলায় উন্নত চুলা তৈরির প্রশিক্ষণ চলছে। আমরা ইউএনএফপিএর সঙ্গে নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছি। এ কার্যক্রমে আছে জনসংখ্যার বৃদ্ধি রোধ।
ঢাকাটাইমস: এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী?
সেলিমা আহমাদ: নারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে। তারা যে বড় শিল্পপতি বা রপ্তানিকারক হতে পারেন তা ভাবতে হবে। সে ক্ষেত্রে তাদের কিছু প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এজন্য আমরা গাজীপুরে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করছি। সেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও ঢাকার স্বনামধন্য নারী উদ্যোক্তারা তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
ঢাকাটাইমস: নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সেলিমা আহমাদ: আমার প্রধান লক্ষ্য এখন ভিশন-২০২০। আমি চাই এ সময়ের মধ্যেই নারীরা পুরুষের পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবে সমানভাবে তাদের স্থান করে নেবে। অর্থনীতিকে আরো গতিশীল করতে নারীদের মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে যেন উদ্যোক্তা তৈরি হয়, সেজন্য কাজ করছি। এছাড়া নিটল গ্রুপ যেন আরো বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারে, সে লক্ষ্যে কাজ করাই আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আমার আরেকটি বড় লক্ষ্য বৃহৎ ব্যবসায় নারীদের উৎসাহিত করা এবং গ্রামের নারীরা যেন এককভাবে বাজারে দোকান দিতে পারে এই বিষয়ে তাদের আর্থিক ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রকমের সাহায্য করা। আমার আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে নারীদের ব্যবসার ক্ষেত্র বদলানো। বুটিক বা পার্লারের ব্যবসা থেকে তাদের বের করে এনে বৃহৎ ব্যবসায় নিয়োজিত করা ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করা।
ঢাকাটাইমস: নারী উদ্যোক্তা সহজ অর্থায়নের জন্য আপনি কি কিছু ভেবেছেন?
সেলিমা আহমাদ: নারীরা যেন স্বল্প সুদে ঋণ পায় তার জন্য কাজ করব। এই ব্যাপারে সরকারের কাছে আমি সাহায্য চেয়েছি। অর্থমন্ত্রী আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি আমার ভিশন-২০২০ প্রকল্পে সহায়তা করবেন।
ঢাকাটাইমস: আপনি উইমেন চেম্বারের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন। একটি বড় সংগঠনের শীর্ষ পদে থেকে কাজ করেছেন। উইমেন চেম্বার নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে কী ভূমিকা রাখছে?
সেলিমা আহমাদ: নারীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ বাড়াতে উইমেন চেম্বারের পক্ষ থেকে আমরা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ২০০৯ সালে সরকারের কাছে একটি স্মারকপত্র দিয়েছিলাম। সেখানে অনেকগুলো সমস্যার কথা তুলে ধরে সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। আমাদের দাবিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে সুদবিহীন ঋণের ১০ শতাংশ ও এডিবির অর্থায়নের শতকরা ১৫ শতাংশ ঋণ নারীকে দেওয়া বাধ্যতামূলক করে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি পরিপত্র দিয়েছিল। বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে কাজ করতে নারী হিসেবে আমার কোনো সমস্যা হয়নি।
ঢাকাটাইমস: একজন নারীকে ব্যবসায় সফল হতে হলে শুরুতে কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে?
সেলিমা আহমাদ: ব্যবসায় সফল হতে গেলে তাকে নিজের পণ্যের বাজার ব্যবস্থাটা ভালো করে বুঝতে হবে। ব্যবসাটার আদ্যোপান্ত বুঝেই এগোতে হবে। মোটকথা পর্যাপ্ত তথ্য তার কাছে থাকতে হবে। ঝুঁকি নেওয়ার মতো সক্ষমতা তার আছে কি না সেটাও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নারী যেহেতু তার উৎপাদিত পণ্যটি দূর-দূরান্তে নিয়ে যেতে পারেন না, তাই বাজার ব্যবস্থাটা নিকটবর্তী হলে তার জন্য সহজ হবে।
ঢাকাটাইমস: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি নীতি সহায়তা কতটুকু অনুকূল?
সেলিমা আহমাদ: দেশে বিদ্যমান নীতিসহায়তা নারীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণের জন্য যথেষ্ট অনুকূল বলতে পারি। সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ও বিনা সুদে ঋণ প্রদান, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, শুল্ক রেয়াতসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ তৈরি করেছেন। এসব সুযোগ নিয়ে অনেকেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন সফলভাবে। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের লোকজন নতুন নারী উদ্যোক্তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন। এতে একজন নারীর দক্ষতা বাড়ছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন মনে করি। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা সহজ করতে নারীদের জন্য সহজ গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করা, একজন পুরুষ যেভাবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শিল্প স্থাপন করছেন, নারীর ক্ষেত্রেও সমদৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ, নারীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা আরো নিশ্চিত করা। আমরা উইমেন চেম্বার থেকে সরকারের কাছে জাতীয় নারী উন্নয়ন তহবিল করার জন্য একটি আবেদন করেছি। আশা করি, সরকার আমাদের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে দ্রুতই পদক্ষেপ নেবে।
ঢাকাটাইমস: কোন ব্যবসা নারীদের জন্য বেশি সহায়ক। নারীবান্ধব বলে আলাদা কোনো ক্ষেত্র আছে কি?
সেলিমা আহমাদ: আসলে এ দেশে নারীবান্ধব ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে কিছু নেই। নারীরা এখন সব ব্যবসাই করতে পারে। বড় বড় শিল্প স্থাপন থেকে শুরু করে ছোট ছোট হাতের কাজ সবখানেই নারীদের পদচারণ বেড়েছে। ভবিষ্যতে তাদের অংশগ্রহণ আরো বাড়বে। এখন অনেক রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েরাও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে এগিয়ে আসছে।
ঢাকাটাইমস: নারী হওয়ায় আপনাকে কি কোনো সমস্যায় পড়তে হয়েছিল?
সেলিমা আহমাদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রি নিয়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি পরামর্শক ফার্ম চালু করি। সেটা আশির দশকের শুরুর দিকে। তখন কিন্তু আমরা আলাদা কোনো প্লাটফরম পাইনি। ধীরে ধীরে আমাকে এগোতে হয়েছে। নারী হিসেবে আমি শুরুর দিকে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হলেও বাড়তি সুবিধা পাইনি। বরং আমাকে অনেকের মতোই সংগ্রাম করে নিজের জায়গা করতে হয়েছে। আমরা উইমেন চেম্বার গঠনের পর এফবিসিসিআইয়ে মেম্বার হওয়ার জন্য আবেদন করি। এই সদস্যপদ পেতে সময় লেগেছে ১১ বছর। আমি মনে করি সব নারীর ক্ষেত্রেই একই ধরনের সংগ্রামের কমবেশি কাহিনি আছে।