logo ০৫ মে ২০২৫
মুক্ত গণমাধ্যম হুমকি নয়
মাহফুজ আনাম
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ২১:৪৪:২৪
image


বাংলাদেশের সমৃদ্ধি এবং গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যম কোনো হুমকি নয়। সন্ত্রাসবাদই এ ক্ষেত্রে প্রধান হুমকি। আর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে জনগনকে অবশ্যই সাথে রাখতে হবে। কিন্তু গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে এর ভুমিকা পালন করতে না দিলে জনগনকে সাথে পাওয়া যাবে না।



অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী বুধবার জাতীয় সংসদের ফ্লোরে দ্য ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি এর প্রতিক্রিয়ায় উপস্থিত এমপিদের কয়েকজন টেবিল চাপড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগতও জানিয়েছেন। এ ঘটনায় আমরা তাজ্জব বনে গেছি এবং পুরোপুরি বিমূঢ় হয়ে পড়েছি।



কিন্তু কেন আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে? ১১ ফেব্রুয়ারি আমাদের পত্রিকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের একটি পোস্টার ছাপা হয়। ‘ফ্যানাটিকস রেইজ দেয়ার আগলি হেডস এগেইন’ (মৌলবাদিরা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে) শিরোনামে পোস্টারটির একটি ছবি ছাপা হয়। ছবির ক্যাপশনে লেখা ছিল ‘দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত সহিংসতামূলক পরিস্থিতির সুবিধা গ্রহণ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামি সংগঠন হিজবুত তাহরীর দেশের সশস্ত্র বাহিনীগুলোর ভেতর অসন্তোষ সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকায় বেশ কিছু উস্কানিমূলক পোস্টার ছেপেছে। এই পোস্টারটি রাজধানীর বাংলামোটরের একটি গলির দেয়ালে গতকাল সাঁটানো অবস্থায় পাওয়া গেছে।’



এই প্রকাশনার পেছনে আমাদের উদ্দেশ্য নিয়ে কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে? পোস্টারটির ছবি এবং এর নিন্দামূলক শিরোনাম ও ক্যাপশন থেকেই আমাদের উদ্দেশ্য কী তা স্পষ্ট। চলমান সহিংসতামূলক পরিস্থিতির সুবিধা গ্রহণ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনটি ভয়ংকর সব প্রচারণা চালিয়ে কীকরে আবারো মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সে ব্যাপারে সরকার ও জনগনকে সতর্ক করাই ছিল আমাদের মূল উদ্দেশ্য।



অথচ প্রধানমন্ত্রী ভাবলেন ভিন্ন জিনিস। তিনি বললেন, ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো সংগঠনের পোস্টার পত্রিকায় ছাপালে ওই সংগঠনের প্রচারণায়ই সহায়তা করা হয়। আর দুর্ভাগ্যের বিষয় রাজধানীর বাংলামোটরের কোনো এক কানাগলির দেয়ালে পড়ে থাকা হিজবুত তাহরীরের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনের একটি পোস্টার ডেইলি স্টার তাদের পত্রিকায় ছেপে দিয়েছে... ডেইলি স্টার না ছাপলে এটি হয়তো কেউ পড়তোও না। নেতিবাচক না ইতিবাচকভাবে ছাপা হয়েছে সেটা কোনো প্রশ্ন নয়। আমি মনে করি একটি পোস্টারকে এভাবে পত্রিকায় ছাপানো আর হিজবুত তাহরীরের পক্ষ হয়ে প্রচারণা চালানো একই কথা। কিন্তু আমার বুঝে আসছে না, ডেইলি স্টার কেন এমন কাজ করলো। তবে যারা হিজবুত তাহরীরের পোস্টার পত্রিকায় ছেপে নিষিদ্ধ ওই সংগঠনটির পৃষ্ঠপোষকতার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নিবো।’



কিন্তু আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রী কারো কুমন্ত্রণায় পড়ে এই ধরণের বক্তব্য দিয়েছেন। আর তিনি যা বলেছেন তা যদি সত্যিই বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে বাংলাদেশে কোনো স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমই আর টিকে থাকতে পারবে না।



প্রধানমন্ত্রীর প্রথম অভিযোগটি হল- হিজবুত তাহরীরের পোস্টার ছাপিয়ে আমরা দলটির প্রচারণায় সহায়তা করেছি। এর বিপরীতে আমাদের বক্তব্য হল, প্রধানমন্ত্রীও একই কাজ করেছেন। কারণ রাস্তার দেয়ালের একটি পোস্টার পত্রিকায় ছাপার ফলে হিজবুত তাহরীর যতটা না প্রচারণা পেয়েছে তারচেয়ে বেশি প্রচারণা পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে বক্তব্য দেয়ার ফলে। সূতরাং আমাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে আমরা বলবো যে প্রধানমন্ত্রীও একই দোষে দোষী।



এর চেয়েও আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করতে হলে জনগনকে সাথে রাখতে হবে। আর জনগনকে সাথে রাখতে চাইলে সরকার এবং স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমকে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। এটা সম্ভব শুধুমাত্র যদি গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে এর ভুমিকা পালন করতে দেয়া হয়। যদি গণমাধ্যমকে সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড, তারা কী বলছে না বলছে, কাকে টার্গেট করে নাশকতার পরিকল্পনা করছে এবং কীভাবে তারা সেটি করবে এসব তথ্য সরবরাহ করে জনগন ও সরকারকে সতর্ক করার সুযোগ দেয়া হয় তাহলেই তা সম্ভব। আমাদের রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর সংগঠনগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে জনগনকে জানানোর দায়িত্বও আসলে গণমাধ্যমেরই। এ কাজ করে যদি ডেইলি স্টার কোনো দোষ করে থাকে তাহলে পুরো বিশ্বের গণমাধ্যমও একই অপরাধে অপরাধী।



উদাহরণত বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন ও তার উত্তরসুরি আইমান আল জাওয়াহিরির প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি ভিডিও বিবিসি, সিএনএন ও আল জাজিরার মতো বিশ্ববিখ্যাত গণমাধ্যমসহ বিশ্বের প্রায় সবগুলো গণমাধ্যমেই প্রচার করা হয়। এ রকম আরো অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।



তাই বলে কি বিশ্বের সব সাংবাদিক বিন লাদেন বা আল কায়দার সমর্থক বনে গেছে?



আল কায়দা ছাড়াও ব্রিটেনের আইআরএ, স্পেনের বাস্ক এবং ডেনমার্ক, জার্মানি ও ফ্রান্সের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোও প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমের শিরোনাম হতো।



এছাড়া নাইজেরিয়ার বোকো হারাম এবং ইরাকের আইএসএ’র নির্মম নিষ্ঠুরতার কথাতো প্রায় প্রতিদিনই প্রচারিত হচ্ছে।



ফিলিপাইনের মরো লিবারেশন ফ্রন্ট এবং এর অঙ্গ সংগঠন আবু সায়াফ সম্পর্কেও সে দেশের গণমাধ্যমগুলো নিয়মিত খবর প্রচার করতো। এমনকি ফিলিপাইনের বিচ্ছিন্নতাবাদি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সেদেশের সরকারের সংলাপের মধ্যস্থতাও করেছে দেশটির গণমাধ্যমগুলোই। এর মধ্য দিয়ে ওই বিচ্ছিন্নতাবাদিরা মূল ধারায় ফিরে আসে।



আমাদের পাশের দেশ ভারতেও চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর খবর ও তৎপরতা প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। পাকিস্তান আজ সন্ত্রাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সন্ত্রাসীদের তৎপরতার খবর প্রচার করতে গিয়ে এমনকি অনেক সাংবাদিককে প্রাণও হারাতে হয়েছে।



আর আমাদের নিজেদের দেশেও সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যম কি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে না?



আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে বাংলা ভাইয়ের ঘটনা। ২০০৪ সালে জেএমজেবি (জাগ্রত মুসলিম জনতা, বাংলাদেশ) এবং জেএমবি (জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) রাজশাহী ও নওগাঁ এলাকায় অপরাধ দমনের নামে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে হত্যাকাণ্ড শুরু করে তারা।



একই বছরের ১৭ মে বাংলা ভাই তিন ব্যাক্তিকে অপহরণ করে এর তিন দিন পর একজনকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখে। ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোই সর্বপ্রথম বাংলা ভাইয়ের এসব তৎপরতার খবর জনগনের সামনে তুলে ধরে সবাইকে সতর্ক করে।



কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখনকার ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৪ সালের আগস্টে সম্পাদকদের সাথে এক মিটিংয়ে মন্তব্য করলেন যে, বাংলা ভাইয়ের বাস্তব কোনো অস্তিত্বই নাকি নেই! এবং মিডিয়াই নাকি বাংলা ভাই নামের একটি কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করেছে!



এরপর ২০০৫ সালের মার্চে জাতীয় সংসদের ফ্লোরে দাড়িয়ে খালেদা জিয়া বললেন, সরকার ও দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানোর জন্যই বাংলা ভাই নামের কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। আর চারদলীয় জোটের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্যই এ ধরণের প্রচারণা চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন খালেদা।



তবে ভাগ্য ভালো যে, আমরা যারা বাংলা ভাইয়ের ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ ছিলাম তাদের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আদেশ দেননি।



খালেদার অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানও গণমাধ্যমের একটি সেকশনের বিরুদ্ধে চরমপন্থার ব্যাপারে ভুয়া প্রচারণার অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সুযোগে একটি সেকশন মানবাধিকার লঙ্ঘন, মৌলবাদিদের উত্থান এবং সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের ব্যাপারে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একটি সেকশন সরকারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রচারণা চালাচ্ছে।’



সেসময় ক্ষমতাসীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের মন্ত্রী নিজামী ও আমিনীর মতো অনেক মন্ত্রীও বিষয়টি নিয়ে বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করেন ও বিবৃতি দেন।



ডেইলি স্টার বাংলা ভাইয়ের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং সরকারকে সতর্ক করার জন্য তার তৎপরতার খবর ছাপিয়ে কি তার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিল? বাংলা ভাইয়ের বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তির গাছে ঝুলানো লাশের নৃশংস ছবি ছাপিয়ে কি ডেইলি স্টার বাংলা ভাইয়ের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিল?



আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও বললেন, ‘ইতিবাচক বা নেতিবাচক যে শিরোনামেই ছাপুক না কেন হিজহবুত তাহরিরের পোস্টার এতো বড় করে ছাপানো নিষিদ্ধ ঘোষিত ওই সংগঠনটির প্রতি পৃষ্ঠপোষকতারই শামিল।’



কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? একটি পত্রিকার সম্পাদকীয় অবস্থানই এর ‘হৃদয় ও আত্মা’। সম্পাদকীয় নীতির ভিন্নতার কারণেই দেশে এতোগুলো পত্রিকার অস্তিত্ব বিরাজমান। এ কারণেই পাঠক কোনো একটি বিশেষ পত্রিকাকে বেশি পছন্দ করে। তাহলে কি আমরা এটাই মনে করবো যে, ‘প্রধানমন্ত্রী চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার বা বিডিআরের বিয়োগান্তক ঘটনা ও এর বিচারের খবর প্রচারের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন না?


সাঈদীর রায়ের পর চাঁদে তার ছবি দেখা গেছে বলে যে গুজব প্রচারিত হয় এবং অনলাইনে এ সম্পর্কিত যে ছবি প্রকাশ করা হয় সেটি যে ভুয়া ছিল তা প্রমাণ করার জন্য ডেইলি স্টারে খবর ছাপা হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হল- প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইতিবাচক বা নেতিবাচক শিরোনামের যদি কোনো পার্থক্য না-ই থাকে তাহলে তখনও কি আমরা সাঈদীর ভুয়া ছবি ও সে সম্পর্কিত খবর ছেপে ওই ভুয়া ছবির পক্ষে প্রচারণা চালানোর অপরাধ করিনি?


২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তাদের উপর পুলিশি অভিযানের পর হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী নিহত হয়েছে বলে যে গুজব ছড়িয়েছিল তার বিরোধীতা করে এই ডেইলি স্টারই বলেছিল যে নিহতের সংখ্যা ১২ বা ১৩ জনের বেশি হবে না। কারণ শুধুমাত্র এই ডেইলি স্টারেরই গুটিকয়েক রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফারই ঘটনাস্থলে সারারাত ধরে উপস্থিত ছিল। সূতরাং ইতিবাচক বা নেতিবাচক শিরোনাম বা ক্যাপশনের মাঝে যদি কোনো পর্থক্য না-ই থাকে তাহলেতো যারা হেফাজতের হাজার-হাজার কর্মী নিহত হয়েছে বলেছে তাদের আর আমাদের মধ্যে কোনো পার্থ্যক্যই নেই।


আবারো বলছি, যদি নেতিবাচক বা ইতিবাচক শিরোনাম, ক্যাপশন ও খবরের মাঝে কোনো পার্থক্য না-ই থাকে তাহলে সম্প্রতি তারেক রহমান বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে যেসব বিকৃত দাবি করেছেন সেসবের বিরোধীতা করেছেন যারা এবং যারা তারেকের বক্তব্য কোনো মন্তব্য ছাড়াই ছেপে দিয়েছেন তাদের মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই, নাকি?


আমরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে একটি বাস্তব বিষয় স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, গণমাধ্যমের কর্মকাণ্ডকে ব্যাপক পরিসরে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- গণতান্ত্রিক এবং টোটালিটারিয়ান বা সর্বগ্রাসী।


গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল বিশ্বাস হল- চলমান ঘটনাপ্রবাহের তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল জনগনই জাতীয় স্বার্থ এবং সব ধরণের গণতান্ত্রিক স্বার্থের রক্ষাকবচ হতে পারেন। ফলে গণতন্ত্রে সব ধরণের তথ্যই নির্মোহভাবে জনগনের সামনে তুলে ধরা হয়, যাতে তারাই বিচার করতে পারেন কোনটা জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে আর কোনটা অমঙ্গলজনক হবে। সত্যিকার গণতন্ত্রে গণমাধ্যমের উপর কোনো নিষেধাজ্ঞাই আরোপ করা হয় না।


কিন্তু টোটালিটারিয়ান বা সর্বগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গিতে সরকারকেই জাতীয় স্বার্থের সর্বোত্তম রক্ষাকবচ মনে করা হয়। ফলে জনগনের আশা-আকাঙ্খা ততটাই প্রকাশিত হতে পারে যতটা সরকার চায়। একটি বিষয় প্রায়ই বলা হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল স্বাধীন গণমাধ্যম না থাকা। এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ তাদের শাসনাধীনে থাকা দেশগুলোর বাস্তব ও সত্য ঘটনা-প্রবাহ সম্পর্কে জানতে পারেননি। ফলে তাদের পায়ের নিচের মাটি যে সরে যাচ্ছিল তা বিন্দুমাত্রও টের পাননি তারা।


পুনরায় হিজবুত তাহরীরের পোস্টার প্রসঙ্গে আসা যাক। একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠছে জনগন ও সরকারকে সে ব্যাপারে সতর্ক করাই ছিল হিজবুত তাহরিরের পোস্টার ছাপানোর পেছনে আমাদের একমাত্র ও মূল উদ্দেশ্য। পোস্টারটি শুধুমাত্র বাংলামোটরের একটি কানাগলিতেই নয় বরং রাজধানীর আরো অনেক জায়গাতেই ছাপা হয়েছিল। ছবিটির সঙ্গে ছাপা আমাদের শিরোনাম ও ক্যাপশনে সংগঠনটির অসাধু উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। আমাদের অভিপ্রায় সম্পর্কে অপব্যাখ্যার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি তা করে তাহলে তা হবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত।


আমাদের উদ্দেশ্য ছিল জনগনকে সংগঠনটির তৎপরতা সম্পর্কে অবগত করা। আর একটি শক্তিশালি ও অংশীদারিত্বমূলক গণতন্ত্র গড়ে তোলার এটাই একমাত্র পথ।


আজ আমরা এই বলে শেষ করতে চাই যে, সরকার ও স্বাধীন গণমাধ্যমের মধ্যকার যে কোনো সংঘাতে সরকারই সাধারণত প্রথমে জয় লাভ করে। কিন্তু সরকারের সেই বিজয় হয় ক্ষণস্থায়ী। স্বাধীন গণমাধ্যমই অবশেষে বিজয়ী হয়। আর মাঝখানের ওই কালটাতে জাতি গঠনের কাজে লাগানোর মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়ের অপচয় হয়। তবে আমরা আশা করি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটবে না। আর গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে তাদের ভুমিকা পালন করতে দিলেই শুধুমাত্র বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল উন্নয়নের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে। আর অপচয় করার মতো কোনো সময় আমাদের নেই।


‘ফ্রি দ্য মিডিয়া নট দ্য এনিমি’ শিরোনামে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনুদিত


(ঢাকাটাইমস/২০ফেব্রুয়ারি/এমএটি)