লালের মাঝে মোটা সাদা হরফে লেখা ‘বহিষ্কৃত ২ নেতা’। তার নিচে মোকাররম মিয়া বাবু ও সত্যজিত মুখার্জির প্রমাণ সাইজের ছবি। রঙিন এই পোস্টারের মাধ্যমে ফরিদপুরবাসী এই দুই বিতর্কিত নেতার গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি এদের ‘অবৈধ সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব জব্দ’ করার দাবিও উঠেছে জোরেশোরে। মোকাররম ও সত্যজিতের ছবি দেওয়া এসব পোস্টারে ছেয়ে গেছে রাজবাড়ী মোড় থেকে শুরু করে গোটা ফরিদপুর শহর। যেখানে বিতর্কিত ওই দুইজনের নামের পাশে লেখা ‘টেন্ডারবাজ, সন্ত্রাসের মদদদাতা, ভূমিদস্যু, ঘুষখোর, নিয়োগ বাণিজ্যকারী, শহরে দোকান দখলকারী, মাদকের পৃষ্ঠপোষক।’ এদের মধ্যে মোকাররম আছেন পুলিশ হেফাজতে। সত্যজিত পালিয়ে বেঁচেছেন। তবে দুজনের কেউই পালাতে পারেননি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জাল থেকে। দুজনের দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে। চলছে অবৈধ সম্পদের খোঁজও। ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে মোকাররম ও সত্যজিতের বিপুল সম্পদ ও কুকীর্তির হদিস মিলেছে। ফরিদপুরের পথে-প্রান্তরে ঘুরে, মানুষের সঙ্গে কথা বলে সেই চিত্রই তুলে এনেছেন প্রতিবেদক-হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
খুব যে আগের কথা তাও নয়। ফরিদপুর শহরের শ্রী অঙ্গনে ছিল আনুমানিক ৪০/৪২ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি ছাপড়া। সেখানেই একটা সময় দিন কাটতো তাদের। গ্রাম থেকে এসে কপর্দকহীন পরিবারটি থিতু হয়েছিল সেখানে। এখন ওই পরিবারের লোকজনই থাকছে গোয়ালচামট হাউজিং এস্টেটে। ব্যবধানটা শুধু রাস্তার এধার-ওধার নয়, টিনের সেই ছাপড়া নেই, উঠেছে দালান। ২০তলা ভিত দিয়ে পাঁচতলার কাজ প্রায় শেষ। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর সাবেক এপিএস ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত সত্যজিত মুখার্জির এমন উত্থানে ফরিদপুরবাসীর চোখ উঠেছে কপালে। এই তো সেদিনও যাদের রিকশায় চড়ার ক্ষমতা ছিল না আজ তারা হাঁকাচ্ছেন দামি গাড়ি! তবে কি আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন সত্যজিত? ‘মোটেও না। দুর্নীতি, অনিয়ম, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, নিয়োগ বাণিজ্যসহ টাকা বানানোর এমন কোনো পথ নেই যে পথে পা পড়েনি সত্যজিতের।’ উত্তর সবার জানা।
শহরের বেজায় নীরব আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা বাড়িতে এখন আর থাকতে পারছেন না সত্যজিত। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পুলিশের ভয়ে। শোনা যাচ্ছে, ভারতে পালিয়ে গেছেন তিনি। পালিয়ে থেকেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সরব থাকছেন। গত ১ মে ফেসবুকে তার দেয়ালে তিনি লেখেন, ‘আমি ভালো, বন্ধুরা তোমরা ভালো থেকো।’ পালিয়ে বেড়ালেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে ধরা পড়েছেন সত্যজিত মুখার্জি। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তার অবৈধ সম্পদের খোঁজে নেমেছে দুদক। চলছে দুর্নীতির অনুসন্ধানও।
গোয়ালচামট হাউজিং এস্টেটের বাড়িতে আছেন সত্যজিতের বাবা মানস কুমার মুখার্জি ও অন্যরা। এস্টেটের পশ্চিম দিকে ঠিক যেখানে গিয়ে কার্পেটিং রাস্তা শেষ হয়েছে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে সত্যজিতের দুর্নীতির দৃষ্টান্ত, ‘কালিদাস ভবন’। হোল্ডিং নম্বর-১/২৩/৪। রাতারাতি এমন পরিবর্তন যে স্বাভাবিক নয়, এটা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হতে হয় না। ভেতরের দিকে কাজ বাকি, কিন্তু বাড়িটির লোহার মজবুত গেট প্রমাণ দিচ্ছে অন্যায় পথে উপার্জিত সম্পদ রক্ষায় বেশ সতর্ক ছিলেন সত্যজিত।
বাইরে থেকে গেটে কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে শব্দ এলো ‘কে?’
‘শুনলাম আপনারা বাড়ি ভাড়া দেবেন, একটু দেখা যাবে?’
ভেতর থেকে গায়ে গামছা জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ। চোখে চশমা, গায়ে আড়াআড়ি পৈতা ঝুলছে। তিনি সত্যজিতের বাবা। আধখোলা গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলেন, ‘কোত্থেকে এসেছেন, কী জন্য ভাড়া নেবেন?’
‘অফিস করার জন্য।’
‘ঠিক আছে, কিন্তু একটু সময় লাগবে। সমস্যা যাচ্ছে তো তাই।’
‘কী সমস্যা?’
ভেতরে ডেকে নিয়ে গেট লাগাতে লাগাতে বললেন, ‘আমার ছেলে একটু বেকায়দায় আছে।’
‘কী হয়েছে তার?’
‘তেমন কিছু না, রাজনৈতিক কারণে একটু দূরে আছে।’
‘কোথায় আছেন?’
‘ঢাকায়।’
‘আপনাদের পৈতৃক নিবাস কি এখানেই?’
‘না, এখানে এসে জায়গা কিনে বাড়ি করেছি।’
‘গ্রাম ছেড়ে এসেই এখানে বাড়ি করেছেন?’
‘না, আগে ভাড়া ছিলাম। ছেলে বাড়ির কাজে হাত দিয়েছে বছর তিনেক হলো।’
‘আপনি কী করতেন?’
‘হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতাম। এখন অবসরে।’
নিজে থেকেই পাঁচতলা বাড়িটির তৃতীয়তলা ঘুরিয়ে দেখালেন। ‘এই ফ্লোরটাই ভাড়া হবে।’
অন্য একটি ফ্লোরে তার ছেলের স্ত্রী স্কুল বানাবেন বলেও জানালেন।
ভাড়া কত, ঠিক করার জন্য আসতে বললেন পরে। যোগাযোগের জন্য একটা মুঠোফোন নম্বরও দিলেন। বেরিয়ে আসার পথে বাড়ি লাগোয়া দ্বীপশিখা স্কুলের ওপাশ থেকে কেউ একজন হাত নেড়ে ডাকছিলেন। তার কাছে যেতেই হাত ধরে একটু নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে গেলেন জনৈক ব্যক্তি।
জানতে চাইলেন, ‘ওই বাড়িতে কেন গিয়েছিলেন?’
‘ভাড়া দেওয়া হবে কিনা...’
‘ভাই ওই বাড়িতে ভুলেও আর ঢুকবেন না। বাড়ির মালিক সত্যজিত মুখার্জি পলাতক। ওর বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি মামলা। পুলিশ খুঁজছে।’
‘কেন কী করেছে সে?’
‘চুরি-চামারি কিছুই বাদ দেয় নাই। খুব খারাপ লোক। লুটেপুটে খাইছে, এখন যখন গলায় বেঁধে গেছে তখন পালাইছে।’
ওই এস্টেটের পেছনের গ্রামই রঘুনন্দনপুর। ওই এলাকাতেও বেশ জায়গা-জমি কিনেছেন সত্যজিত। ২০ শতাংশের একটি প্লটের কথা সবাই জানেন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সত্যজিত মুখার্জি এখানে নামে-বেনামে অনেক জমি কিনেছেন। জায়গা-জমি কিনেছেন বোয়ালমারীতে নিজ গ্রামের বাড়িতেও। কিন্তু কোথাও কোনো সাইনবোর্ড লাগাননি। সবার চোখে পড়ে যান রীতিমতো এই ভয় তাড়িয়ে বেরিয়েছে ‘অবৈধ’ পথে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া সত্যজিতকে।
ব্যবসায়ী না হয়েও ফরিদপুরের ব্যবসায়ীদের রীতিমতো জিম্মি করে রাখতেন সত্যজিত। সুযোগ বুঝে শহরের প্রায় সব মার্কেটেই নিয়েছেন একাধিক দোকানপাট। শুধু তাই নয়, নিজের অনুসারী-অনুগামীর বাইরে অন্যদের দোকানও পেতে দেননি। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ স্টাইলে সবকিছু কব্জা করেছেন। এসব কা-ে শহরের ব্যবসায়ীরা চরম ফুঁসে আছেন সত্যজিতের ওপর। ফরিদপুর শহরের জেলা পরিষদ মার্কেট স্বর্ণকুটির আধুনিক বিপণি কেন্দ্র। এই মার্কেটেও হানা দিয়েছেন তিনি। এখানে দুটি দোকান আছে তার নামে। স্থানীয় ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সত্যজিত মুখার্জির জ্বালায় গত ৬ বছর এখানে টেকাই দায় ছিল। বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করতো। ফরিদপুর শহরে ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসায়ীর কাছ থেকেই কোনো না কোনোভাবে চাঁদা আদায় করতো সে। প্রকৃত ব্যবসায়ী হওয়ার পরও সত্যজিতকে রাজিখুশি না করায় শহরের মার্কেটগুলোতে দোকান বরাদ্দ পাননি অনেকে। অথচ সত্যজিতরা ঠিকই একাধিক দোকান হাতিয়ে নিয়েছেন।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহরের সরকারি তিতুমীর মার্কেটে নামে-বেনামে আটটি দোকান আছে সত্যজিতের। এছাড়া হেলিপোর্ট বাজারেও আছে তিনটি দোকান।
সরেজমিনে এই মার্কেটগুলোতে গেলে দোকানিরা জানায়, সত্যজিতের চেলা-চামু-ারা অতীতে বিভিন্নভাবে তাদের হয়রানি করার চেষ্টা করতো। জোর করে দোকান বরাদ্দ নেওয়ার পাশাপাশি পুরো মার্কেটে ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতো। এখন তাদের অবর্তমানে ফরিদপুরের ব্যবসায়ী মহলে স্বস্তি ফিরেছে।
স্থানীয় দোকানি সুকমল বড়–য়া বলেন, ‘ফরিদপুর শহরের ত্রাণকর্তা মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত ১ মে শহরের জনতা মোড়ে চাঁদাবাজ, ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তারপর আমাদের মধ্যে ভয়ডর কেটে গেছে। সামাজিকভাবে চাঁদাবাজ ও ঘুষখোরদের আমরা বয়কট করবো। কোনোভাবেই আর কোনো দুর্নীতিবাজের ঠাঁই ফরিদপুরের মাটিতে হবে না।’
সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের সুশাসন ভেঙে পড়ে বলে মনে করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সুশাসনের জন্য নাগরিকÑসুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘দুর্নীতি-অনিয়ম তো নতুন কিছু নয়। যারাই ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যান বা ক্ষমতায় থাকেন তারাই কোনো না কোনোভাবে এসবে জড়িয়ে যান। এদের কারণে সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন।’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের বিচার না হলে অন্যরা দুর্নীতিতে উৎসাহিত হবেন। এজন্য সত্যজিত মুখার্জির মতো লোকদের দুর্নীতি ও অনিয়মের মতো অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে এই বিচার করতে হবে।’
ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
সত্যজিতের বিচারের দাবিতে যখন ফরিদপুরবাসী সরব তখন এই বিতর্কিত নেতাকে দলেও রাখেনি ছাত্রলীগ। গত ১৭ এপ্রিল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুজ্জামান মনিরের স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপ, ঘুষ ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে সংগঠনের গঠনতন্ত্রের ১৭-এর ক, খ এবং গ ধারা অনুযায়ী সত্যজিত মুখার্জিকে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ ও সাধারণ সদস্যপদ থেকে বহিষ্কারের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মনির ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সত্যজিত মুখার্জির মতো লোকেরা ছাত্রলীগকে কলুষিত করার চেষ্টা করেছে। এদের মতো অপরাজনীতিকদের জন্য অনেক দুর্নাম কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র সংগঠনটিকে। এদের ঠাঁই আর কখনই ছাত্রলীগে হবে না।’
এর আগে গত ১৬ এপ্রিল প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) পদ থেকে অপসারণ করা হয় সত্যজিতকে।
সত্যজিতের বিরুদ্ধে যত মামলা
সত্যজিত মুখার্জির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে আরও পাঁচটি মামলা হয়েছে ফরিদপুর ও ঢাকার বিভিন্ন থানায়। তার বিরুদ্ধে ১৯ এপ্রিল প্রথম মামলাটি করেন ফরিদপুর শহরের লক্ষ্মীপুরের ঠিকাদার সালেহ আহমেদ। এর তিনদিন পর একই থানায় মাচ্চর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা সারোয়ার হোসেন সন্টু দ্বিতীয় চাঁদাবাজির মামলা করেন। গত ২৬ এপ্রিল ঢাকার পল্টন থানায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে মামলাটি করেন টেকনোমিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথ। তার বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার চাঁনপুর গ্রামে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৫ জানুয়ারি সকাল সাড়ে দশটার দিকে সত্যজিত মুখার্জি নিজে পল্টনে টেকনোমিডিয়া লিমিটেডের কার্যালয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। অন্যথায় তাকে ঢাকায় ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী যশোদা ঘাবড়ে যান এবং সত্যজিতকে নগদ সাত লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন। টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ওই ব্যবসায়ীকে শাসিয়ে যান এবং পরবর্তী তিনদিনের মধ্যে বাকি তিন লাখ টাকা ব্যবস্থা করে রাখতে বলেন। পরে গত ৮ জানুয়ারি পল্টনে ওই ব্যবসায়ীর কার্যালয়ে গিয়ে বাকি তিন লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন। এ ঘটনায় তিনজন সাক্ষীর কথাও উল্লেখ রয়েছে মামলার এজাহারে।
পল্টন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তোফায়েল আহমেদ জানান, মামলার নম্বর ৩৮-২৬/০৪/২০১৫। ৪৪৮/৩৮৬ ধারায় মামলাটি রুজু হয়েছে। মামলাটির তদন্ত চলছে।
এছাড়া ২৭ এপ্রিল রাতে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় আরও দুটি মামলা হয়। শহরতলির বদরপুর এলাকার সঞ্জিত সাহা ও পূর্ব গঙ্গাবর্দী এলাকার সামসু মোল্যা দুজনেই সত্যজিতের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনেছেন। সামসু মোল্যা তার মামলার অভিযোগে বলেন, ‘সত্যজিত মুখার্জি বাড়ি করার সময় তার কাছ থেকে মাটি কাটার বেকু মেশিন ভাড়া করেন। পরবর্তীতে ভাড়ার টাকা চাইলে টালবাহানা শুরু করেন। বিষয়টি সত্যজিতের বাবাকে জানানো হলে সে ক্ষ্যাপে যান। পরে ৭ মার্চ সত্যজিত একদল সন্ত্রাসী নিয়ে কৃষি কলেজের সামনে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দেন। এক পর্যায়ে হাতে থাকা পিস্তল বের করে আমার দিকে তাক করে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন। তিনি প্রতি মাসে আমার কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। নইলে আমার ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন বলে জানান।’ অন্যদিকে সঞ্জিত সাহা সত্যজিত ও তার স্ত্রী সুমিকা মুখার্জির নামে চাঁদাবাজির মামলাটি করেছেন বলে জানা গেছে।
আরও যত সম্পদের মালিক সত্যজিত
শুধু যে ফরিদপুরেই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সত্যজিত তা নয়। ঢাকাতেও আছে নামে-বেনামে একাধিক ফ্ল্যাট। ঢাকার মিরপুর-১২-এর ৬/ডি ব্লকে ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। এছাড়া মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকাতেও তার একাধিক ফ্ল্যাট আছে বলে সূত্রে জানা গেছে। তার ঘনিষ্ঠরা বলেন, সত্যজিত মাঝেমধ্যে গর্ব করে বলতেন, ‘এক সময় ফরিদপুর শহরে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, এখন ঢাকাতেও আমার একাধিক ফ্ল্যাট। টাকা-পয়সা উড়ে বেড়ায়, যখন ধরতে শিখেছি তখন আর চিন্তা নেই। সব স্বপ্নই পূরণ হবে।’
স্কুল টিচার বাবা গোটা ফরিদপুর শহর চষে বেড়াতেন আধ পুরনো সাইকেলে চেপে। তাদের অসচ্ছলতার কথা কারোই অজানা ছিল না। কিন্তু সেই পরিবারের ছেলে সত্যজিতের সম্পদের হঠাৎ উল্লম্ফনে তাক লেগেছে সবার চোখে। সাইকেলে চড়া বাবার ছেলে ঘুরতেন রিকশায় আর সে কি না হাঁকায় দামি গাড়ি! তাও আবার শুধু প্রাইভেট কারই নয়, দুটো মাইক্রোবাসও আছে সত্যজিতের।
আক্ষেপ করে ফরিদপুর শহরের মাইক্রোবাস স্ট্যান্ডের একজন দোকানি বলেন, ‘হায়রে সত্যজিত, কী তোর অহংকার। মাটিতে পা পড়তো না। আজ সে কই? এদের ভবিষ্যতে আরও ভুগতে হবে।’
বাড়ি, গাড়ি, জায়গা-জমির পাশাপাশি কোটি কোটি টাকা ব্যাংক হিসাবেও জমা রেখেছেন সত্যজিত মুখার্জি। শুধু নিজের নামেই নয়, স্ত্রী সুমিকা মুখার্জি, বাবা মানস কুমার মুখার্জির নামেও ফরিদপুরের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত আছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের রাজধানীর কাকরাইল শাখায় ১৫ কোটি টাকার আমানত আছে সত্যজিতের। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এলিফেন্ট রোড শাখায় গচ্ছিত আছে বিপুল অর্থ। আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নগদ জমা আছে অন্তত ৫০ কোটি টাকা। সত্যজিত এত টাকা কোথায় পেলেন এই প্রশ্নই মুখে মুখে। গাজীপুরে সত্যজিতের একটি ফ্যাক্টরিও আছে বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া একটি ডেভেলপার কোম্পানিসহ নামে-বেনামে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গেও আছেন সত্যজিত।
চাকরি দেওয়ার নাম করে মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা অগ্রিম নেওয়ার অভিযোগও আছে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। একাধিক ভুক্তভোগী জানান, চাকরি তো দূরে থাক টাকাও ফেরত পাননি তারা। ফরিদপুর শহরে খোঁজ করলে এমন শত শত ঘটনার প্রমাণ মিলবে।
মোকাররম বাবু কাহিনি
ফরিদপুর শহরের মিয়াপাড়া সড়ক দিয়ে ঢুকতেই দু-তিনজন লোক পিছু নিলো। যেন আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন তারা। একটু যেতেই দেখা গেলো দু-তিনজন নয়, জনা পাঁচেক লোক গাছের ছায়ায় চেয়ার পেতে গল্প করছেন। এদের মধ্যে তরুণ থেকে শুরু করে ৬০ বছরের প্রোঢ়কেও চোখে পড়লো। ভরদুপুরে লোকজনের এই আড্ডা খানিক খটকার জন্ম দিলো মনে। স্থানীয় এক দোকানির কাছে জানতে চাইলে তিনি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বেশ সতর্কতার সঙ্গে জবাব দিলেন, ‘পাহারা বসিয়েছে। দিনরাতে পালা করে চলে এই পাহারা।’ ‘কীসের পাহারা, কেনইবা?’ বললেন, মোকাররম মিয়া বাবুর নাম শোনেননি। তারই জ্ঞাতিগোষ্ঠী তারা। শুনেছি, বাবুর সম্পদের অনুসন্ধান চলছে। অপরিচিত কাউকে এই তল্লাটে ঢুকতে দেখলেই পিছু নেন বাবুর আত্মীয়স্বজনরা।’
বুঝতে বাকি রইলো না ঢোকার পথে কেন ‘সন্দেহের চোখে’ দেখছিল। তবে মোকাররম বাবুর প্রতি যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চোখ কঠিনভাবে পড়েছে সে কথা হয়ত অজানা নেই তাদের। দুদকের জালে জড়িয়ে গেছেন বাবু। এখন অনুসন্ধান চলছে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত এই নেতার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের। দুদকের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রমাণও রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মিয়াপাড়ায় ঢোকার পথে আড্ডার কেন্দ্র ওই তিনতলা বাড়িটাও মোকাররম বাবুর। কৌশলে ভাইদের রেখেছেন সঙ্গে। তবে এর পুরো নির্মাণ ব্যয়ই করেছেন তিনি। প্রায় মূল সড়ক লাগোয়া বাড়িটির সামনে থেকে একজন প্রবীণ পিছু নিলেন, তার সঙ্গে দুই যুবকও। ২৫ থেকে ৩০ কদম এগিয়ে যেতেই হাতের বাঁ পাশে সদ্য রঙ করা একটি বাড়ি নজর কাড়লো। তিনতলা এই বাড়িটির মূল ফটকের পিলারে গোলাপি রঙ করা। মূল বাড়ির মাঝের অংশে নীল রঙ সাদার মধ্যে বেশ ফুটেছে। মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কেউ একজন ডাকলেন পেছন থেকে। ‘কী চাই, এদিকে আসেন।’ পেছন ফিরতেই চোখে পড়লো একজন বৃদ্ধকে। যার দাড়ি, গোঁফ ও চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে হাফহাতা শার্ট। তিনিই এই প্রতিবেদককে অনুসরণ করছিলেন শুরু থেকেই।
‘বাইরে দেখছি টু-লেট ঝুলছে। অফিস-বাসা দুটোই ভাড়া দেবেন...।’
‘না ভাড়া হবে না। খালি নেই।’
বাইরে বেরিয়ে টু-লেটে লেখা মুঠোফোন নম্বরে কল দিতেই ওপাশ থেকে বলা হলো ‘দোতলায় ভাড়া হবে। দেখতে চাইলে উপরে উঠে আসুন।’
আবারও সেই বৃদ্ধের বাধা। ‘যাওয়া যাবে না, বললাম না ঘর খালি নেই।’
‘কিন্তু ফোনে কেউ একজন বললো উপরে যেতে। আমি গিয়ে দেখে আসতে চাই।’
অনেক জেরার জবাব দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই একজন পরিচয় দিলেন মোশাররফ বলে। ঘর দেখালেন। আসার সময় জানতে চাইলে বলেন, এই বাড়ির মালিক তিনি নন, তার ভাই। তবে ভাইয়ের নাম কি তা বলতে চাননি। পরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বাড়িটিও বাবুর। আর পিছু নেওয়া বৃদ্ধলোকটি তার বাবা। যিনি একসময় সরকারি চাকরি করতেন।
এবার আরেকটু সামনে যেতেই চোখ চড়ক গাছ। চার ইউনিটের চারতলা সুরম্য এই দালানের নাম ‘পদ্ম নিবাস’। হোল্ডিং নম্বর ২৭/২৯/৮/১। যোগাযোগের ঠিকানায় লেখা-‘প্রোপ্রাইটর : আব্দুল মান্নান মিঞা।’ নিচে আছে ফোন নম্বর। কিন্তু নয়টি ডিজিটের পর বাকিগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে সাদা কাগজে। বাড়ির মালিকের পরিচয় কিংবা ফোন নম্বর গোপনের চেষ্টা হলেও স্থানীয় কারোই জানতে বাকি নেই এই বাড়িটিও জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোকাররম মিয়া বাবুর।
বাড়ির নিচতলায় গ্যারেজে বেসরকারি একটি ওষুধ কোম্পানির গাড়ি রাখা। গেটের কাছে দুজন লোক বসা। পরিচয় জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘আমরা এখানের কেউ না।’
‘তাহলে এখানে বসে আছেন কেন?’
‘এমনি বসে আছি।’
‘বাড়িটি কার?’
‘আমরা এই এলাকার না। বলতে পারবো না।’
কিছুক্ষণ ঘুরে এসে আবারও দেখা গেলো ওই দুজনের একজন গ্যারেজের সামনে ঝাড় দিচ্ছেন। ‘আপনি তো বললেন বাইরে থেকে এসেছেন তো ঝাড় দিচ্ছেন কেন?’ লোকটি কোনো জবাব না দিয়েই উপরে চলে গেলেন। বসা ছিলেন একজন। এই বাড়ির পাশেই দেয়ালে ঘেরা আরেকটি জায়গা। যেখানে কিছু সবজিও চাষ করা হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হচ্ছে, দেয়ালে ঘেরা জায়গাটির রাস্তার পাশের অংশে একটা সাইনবোর্ড লাগানো। যেখানে লেখা ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, সভাপতির কার্যালয়, ফরিদপুর জেলা শাখা।’
বাড়ির নিচে বসে থাকা লোকটির কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘এই জায়গাও বাড়ির মালিকের।’
‘তাহলে মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় কোথায়।’
‘এই বাড়িতেই। কিন্তু এহন যাওয়া যাইবো না। অফিস বন্ধ।’
স্থানীয় একজন বাসিন্দা তোফায়েল মিয়া জানান, মানবাধিকার কমিশনের নাম ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে কৌশলগত কারণে। আদতে এসবই বাবুর চালাকির অংশ। এই জায়গাটি নিয়ে ঝামেলা চলছিল, যে কারণে মানবাধিকার কমিশনের কথা বলে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
মোকাররম বাবু মিয়াপাড়ার জন্য রীতিমতো ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। তার ভয়ে এই তল্লাটে অনেকেই তটস্থ থাকতেন। নানাভাবে মানুষকে হয়রানি করাই ছিল বাবুর কাজ। ক্ষোভ ঢাললেন স্থানীয় নারগিস বেগম। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর বিচার বলতে একটা কথা তো আছে। এখন জেলে পইচ্যা মরুক। বুঝতে পারবো কেমন লাগে। যাকে না তাকেই ধরে মারধর করতো। এই এলাকায় বাবুর কারণে সন্ত্রাসী, বখাটে যুবকের আনাগোনা বেশি ছিল। এখন কয়দিন থেকে এইখানে একটা কাকপক্ষীও দেখা যাচ্ছে না।’ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে মোকাররম মিয়া বাবু একটা চরম ঘৃণিত নাম। তৃণমূল থেকে জেলা পর্যন্ত সবস্তরের নেতা-কর্মীর মনেই আছে বাবুর প্রতি চরম ক্ষোভ। তাদের সঙ্গে কথা বললে সেগুলো উগড়ে গিয়ে হালকা হওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘মোকাররম মিয়া বাবু সব সময়ই চাইতেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে। সে মনে করতো অন্যরা বেশি সক্রিয় হলে তার অস্তিত্ব সংকট হবে। এই শঙ্কা থেকেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে কূটকৌশল অনুসরণ করতো। বিভিন্ন সময় আমরাও তার ফাঁদে পা দিয়ে ভুল করেছি। যেটা পরে বুঝতে পেরেছি। বাকিটা জীবন খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পাশে থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে যেতে চাই, দলের হাতকে শক্তিশালী করতে চাই।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাবুর উচিত ছিল আজীবন মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের গোলামি করা। পায়ের কাছে পড়ে থাকা। কারণ একসময় তার কিছুই ছিল না, মন্ত্রী মহোদয়ের ¯েœহধন্য হওয়ার সুযোগের অসৎ ব্যবহার করে অনেক টাকাকড়ি করেছে। অথচ মন্ত্রী মহোদয় এসবের কিছুই জানতেন না। এখন তিনি বাবু এবং সত্যজিতের বিরুদ্ধে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা যথার্থ হয়েছে। বাবু ও সত্যজিতের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে আগামীতে কেউ এ ধরনের গর্হিত কাজ করার সাহস দেখাবে না।’
একই সুরে কথা বললেন কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ বোস। তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘বাবু ও সত্যজিত মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে যে আচরণ করেছে তাকে এক কথায় বলবো জঘন্য। খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাহেব একজন সৎ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক। তিনি বাবু ও সত্যজিতকে ফুটপাত থেকে তুলে এনেছিলেন। কিন্তু তারা মন্ত্রীর আশপাশে থেকে যেভাবে নিজের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত ছিল তাতে এক কথায় বলতে হয়, তারা বেঈমান। এই বেঈমানদের ঠাঁই আর যেখানে হোক আওয়ামী লীগে হবে না।’ তিনি বলেন, ‘এদের কারণে অনেকেই মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে ভিড়তে পারেনি। অতীতের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। ফরিদপুর আওয়ামী লীগের অভিভাবক খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে ছিলাম, এখনও আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।’
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতিবাজরা কোনো দলের হতে পারে না। এরা দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে দুর্নীতি করে। এদের বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সজাগ হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘মোকাররম মিয়া বাবুর মতো লোকেরা শুধু ফরিদপুরে নয় দেশের সব জায়গায় কম বেশি আছে। তাদের ব্যাপারে আগেভাগে সজাগ হতে না পারলে পরে পস্তাতে হয়। কারণ এরা শুধু নিজেরাই ধ্বংস হয় না, দল বা সংগঠনের ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে।’
আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার
গত ৩০ এপ্রিল ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় মোকাররম বাবুকে। জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ সাহেব ছারোয়ার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ফরিদপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক কাজী জায়নুল আবেদীনের সভাপতিত্বে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বিশেষ সভা হয়। সেখানে উপস্থিত সব নেতার সিদ্ধান্তে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে অবৈধ সম্পদ উপার্জন করে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে মোকাররম মিয়া বাবুকে জেলা আওয়ামী লীগ ও সব স্তরের সদস্য পদ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’ এটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সভায় দলের জ্যেষ্ঠ নেতা এস এম নুরুন্নবী, বিপুল ঘোষ, লোকমান হোসেন মৃধা, মাসুদুল হক মাসুদ, মাইনুদ্দীন আহমেদ মানু, শওকত আলী জাহিদ, মনির হোসেন, মোকাররম বাবুর পক্ষের আইনজীবী ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা বদিউজ্জামান বাবুলসহ প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন।
বাবুর বিরুদ্ধে যত মামলা
চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের অভিযোগে বাবুর বিরুদ্ধে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় মোট ছয়টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে গত ১৯ এপ্রিল ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। মামলাটি করেছেন ফরিদপুর শহর যুবলীগের সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন বরকত। এছাড়া ফরিদপুর মাচ্চর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সরোয়ার হোসেন সান্টুর করা চাঁদাবাজি মামলায় তাকে সাত দিনের এবং সাজ্জাদ হোসেনের করা মামলায় চারদিনের পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয় তাকে। গত ২৩ এপ্রিল ঢাকার রমনা থানা পুলিশ তাকে আটক করেছিল। পরে তাকে ফরিদপুর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বাবু
নামে বাবু হলেও কাজে তিনি বড়দের চেয়েও বড়। কীভাবে ক্ষমতার আশপাশে থেকে নিজের আখের গোছাতে হয় সে কথা বাবুকে শিখিয়ে দিতে হয়নি কাউকে। যেভাবে পেরেছেন শুধু টাকাই হাতিয়ে নিয়েছেন। ফুটপাত থেকে নিজেকে তুলে এনেছেন অট্টালিকায়। তার সম্পর্কে কথাগুলো বলছিলেন আওয়ামী লীগের এক নেতাই। বাবু যে শুধু শহরের মিয়াপাড়ায় একাধিক বাড়ি করেছেন তাই নয়, ফরিদপুর শহরে কিনেছেন ফ্ল্যাট। ঢাকাতেও নামে-বেনামে একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। ফরিদপুর শহরে মাছরাঙার শপিংমলের উপরে ১৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া ঢাকার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে কসমোপলিটন ড্রিমের দ্বিতীয় তলায় ১৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। ঢাকায় শ্যামলীর আদাবরেও আছে একটি ফ্ল্যাট। তাজমহল রোডে আছে আরও একটি ফ্ল্যাট। এসব ফ্ল্যাটের সবকয়টি নিজের নামে কেনেননি বাবু। স্ত্রী, নিকটাত্মীয়দেরও ব্যবহার করেছেন কায়দা করে।
ফরিদপুর শহরে একাধিক প্লটের মালিক বাবু ও তার স্ত্রী নাজনীন সুলতানা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর পৌরসভার পেছনে পাঁচ শতাংশ জায়গাও আছে তার। এছাড়া ঝিলটুলি পানির ট্যাংকের পাশে স্ত্রীর নামে আছে আরও পাঁচ শতাংশ জায়গা।
ঝিলটুলি পানির ট্যাংক এলাকায় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা সদরুল আলমের সঙ্গে। অনেকটা আক্ষেপের সুরে তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘এদের বিরুদ্ধে বলে কয়ে কোনো লাভ আছে বলেন। বরং আমাকে ক্ষমতা দেন দেখেন মনের জ্বালা কীভাবে মিটাই।’
পৌরসভার পেছনে রেলওয়ে স্টেশন মার্কেট লাগোয়া এলাকা মাদকের আখড়া বলে বেশ পরিচিত। স্থানীয় সূত্র জানায়, এই মাদকের আখড়ায় বেশ প্রভাব ছিল মোকাররম বাবুর। তার ছত্রচ্ছায়ায় এখানে অনেকে মাদক ব্যবসা করতেন। এজন্য তাকে নিয়মিত মাসোহারাও দিতে হতো।
ওই এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘ফরিদপুর শহরকে শতভাগ মাদকমুক্ত করতে হলে বাবুর মতো লোকদের খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। প্রকাশ্যে এসব সামাজিক খুনিদের বিচার কার্যকর করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকার জগতে ঠেলে দিয়ে এদের টাকা-পয়সার মালিক হওয়ার নেশা বন্ধ হবে না।’
স্থাবর সম্পদের পাশাপাশি নগদ টাকাও জমা করেছেন বেশ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফরিদপুরের সরকারি ও বেসরকারি একাধিক ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা জমা আছে বাবুর। গত ১৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের ফরিদপুর শাখা থেকে ৭০ লাখ টাকা নগদ তুলেছেন তিনি। ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের ফরিদপুর শাখায় অন্তত ১০ কোটি টাকা জমা আছে। তার ঘনিষ্ঠ একজন জানান, ২০১৩ সালে দুটি নতুন হিনো ৪২ সিটের বাস কিনে পরে তা কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন বাবু। টাকা রেখেছিলেন মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট এবং ইস্টার্ন ব্যাংকে। প্রশ্ন, কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন বাবু?
নিজের কোনো ট্রেড লাইসেন্স আছে কি না সন্দেহ, অথচ প্রায় অর্ধশত দোকান নিয়েছেন ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন মার্কেটে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাদ দেননি দোকান দখলও। তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর শহরে নিউমার্কেটের তৃতীয় তলায় দুটি, স্বর্ণকুটির মার্কেটে তিনটি, তিতুমীর বাজারে (নির্মাণাধীন) নামে-বেনামে পাঁচটি, হেলিপোর্ট বাজারে আটটি এবং রকিবউদ্দিন পৌর মার্কেটে দুটি দোকানের মালিক তিনি। ফরিদপুর শহরের মধ্যে বিগত ছয় বছরে যত সরকারি দোকান তৈরি হয়েছে সেখান থেকে জোরপূর্বক, পেশিশক্তির বলে এবং বিভিন্ন লোকের নাম ভাঙিয়ে ২০ থেকে ২৫টি দোকান নিজ নামে এবং বেনামে বন্দোবস্ত নিয়েছেন।
একসময় পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো মোকাররম বাবুর এখন একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। কয়দিন বাদে বাদে মডেল পরিবর্তনের বিলাসিতাও নাকি করেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠরাই দিয়েছে এসব তথ্য। সূত্র জানায়, একটি ব্যক্তিগত গাড়ি আছে বাবুর। এছাড়া শ্যালকের ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন একটি মাইক্রো। স্ত্রীকে কিনে দিয়েছেন টয়োটা এলিয়ন মডেলের গাড়ি। যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-১১-৪৮৮৬। সম্প্রতি আরও একটি টয়োটা প্রিমিয়ো কিনেছেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা দিয়ে। যার শো-রুম নম্বর-৫৬১। রেজিস্ট্রেশন এখনও বাকি।
রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির বলে সরকারি ঠিকাদারিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন মোকাররম বাবু। ফরিদপুর জেলার সরকারি সব কাজ কব্জা করে মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে তা বড় বড় ঠিকাদারদের মধ্যে ভাগ করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় একজন ঠিকাদার বলেন, বাবু ও তার লোকজনদের উৎপাতের মুখে সহসাই সরকারি ঠিকাদারি কাজ পাওয়া কঠিন। তাদের অতিক্রম করে কিছুই করা সম্ভব নয়। কোনো কাজ করতে গেলেই মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে হয় তাদের। ছয় বছর ধরে এসব করে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন তিনি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মাসোহারা আদায়েও এগিয়ে বাবু বাহিনী। বাসস্ট্যান্ড, আবাসিক হোটেল, মদের দোকান এমনকি পতিতাবৃত্তি থেকেও মোটা অঙ্কের মাসোহারা নেন তিনি। এছাড়া সরকারি বড় কর্মকর্তাদের নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের অভিযোগও আছে। ফরিদপুর পাসপোর্ট অফিস থেকে শুরু করে ফরিদপুরের সরকারি দপ্তরগুলো থেকেও মাসোহারা তোলে তার অনুসারী-অনুগামীরা।
শহরের বাসিন্দা মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘বাবু ও তার সাঙ্গপাঙ্গোদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারতো না। নীরবে তাদের অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করে যেতে হতো। এভাবে মানুষ কয়দিন থাকতে পারে বলুন? এখন তাদের বিচার হচ্ছে এজন্য ফরিদপুরবাসী খুব খুশি ও স্বস্তির মধ্যে আছে।’
অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক
সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সত্যজিত মুখার্জি ও মোকাররম মিয়া বাবুর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান পরিচালনা করছে সংস্থাটি। দুদক সূত্র জানায়, সত্যজিত ও মোকাররমের অবৈধ সম্পদের দালিলিক প্রমাণ দুদকের হাতে এসেছে। সংস্থাটি এসব বিষয় মাঠ পর্যায়ে খতিয়ে দেখছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে দুদক তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জমান ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সত্যজিত মুখার্জি ও মোকাররম মিয়া বাবুর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দুদকের কাছে এসেছে। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধান চলছে।’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ কেউই অতীতে দুদকের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তাদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হবে না।’
সত্যজিতের অবৈধ সম্পদের খোঁজ বের করার দায়িত্ব পেয়েছেন দুদকের উপপরিচালক কে এম মেসবাহ উদ্দিন। তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘সত্যজিত মুখার্জির অবৈধ সম্পদের অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানও শুরু হয়ে গেছে। তবে তদন্ত গুছিয়ে আনার আগে এ ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না।’
এছাড়া মোকাররম মিয়া বাবুর দুর্নীতি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুদকের আরেক উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমকে। তিনি ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘মোকাররম মিয়া বাবুর দুর্নীতি অনুসন্ধানের কাজ শুরু হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে তদন্ত শেষে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’