logo ১৯ মে ২০২৫
সত্যজিত-মোকাররমের কারণে কপাল পুড়েছে যাদের
১০ মে, ২০১৫ ১১:৩৫:৫২
image


ভেতরে ভেতরে ফরিদপুর শহরের ত্রাস হয়ে উঠেছিল সত্যজিত মুখার্জি ও মোকাররম মিয়া বাবু। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাটে ছোটখাটো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকা দিয়ে তাদের খুশি করতে না পারায় পথে বসতে হয়েছে অনেক ব্যবসায়ীকে।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় নিয়েও রাজনীতিতে মেতেছিল সত্যজিত। নিজের আত্মীয়কে পছন্দের পদে বসাতে না পেরে শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতেও পিছপা হয়নি মোকাররম। অনেকে সহায়-সম্বল হারিয়েছেন এই দুই ‘ধিকৃত’ ও ‘সমালোচিত’ ব্যক্তির কারণে।সত্যজিত-মোকাররমের কারণে যাদের কপাল পুড়েছে সেই সব মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা তুলে ধরছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ। সঙ্গে ছিলেন ইনামুল হাসান  

ফরিদপুর শহরে ঢোকার পথেই প্রভু জগদ্বন্ধুর লীলাধাম। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়। শ্রীঅঙ্গন বললে যেকেউ সহজেই নিয়ে যাবে সাজানো গোছানো এই আশ্রমে। খাঁ খাঁ রদ্দুরে অঙ্গনের অতিকায় গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছিলেন নিত্ত গোপাল। চোখেমুখে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। গায়ের হাড়গুলো গোনা যাচ্ছিল সহজেই। নিজে থেকেই বললেন, ‘আশিটা বছর কেটেছে এই আঙিনায়। এত মানুষ দেখিছি। আপন ধর্ম, আশ্রয়, স্বজাতির সঙ্গে নেমক হারামি করতে আগে কখনো দেখিনি; সত্যজিত মুখার্জি যা করেছে তা স্বয়ং প্রভুও ক্ষমা করবেন না।’

পাশেই ছিলেন প্রায় একই বয়সের একজন প্রবীণ। তিনি আঙিনার প্রহরী। দীর্ঘ ২৮ বছর এই আঙিনার নিরাপত্তা রক্ষায় শ্রম দিচ্ছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধাও বটে। সুর মেলালেন নিত্ত গোপালের কথায়, ‘শোননি, পাপ ছাড়ে না বাপকে। এখানেই খেয়ে-থেকে বেঁচেছে। আবার এই আঙিনার নীতি নিয়মকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে, একি জগদ্বন্ধু সইতে পারেন? পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না?’

‘এই আঙিনার সঙ্গে কী করেছে?’ জানতে চাইলে চোখাচোখি করেন তারা দুজন। পরক্ষণেই জবাব দেন নিত্ত গোপাল, ‘ছিন্নমূল মানুষের ঠাঁই হয় এই অঙ্গনে। এখানে শত শত পরিবার বাসা বেঁধে থাকছে। সহায় সম্বলহীন মানুষ জগদ্বন্ধুর লীলাধামে সংসার পেতেছে। নিয়ম হচ্ছে, যুগের পর যুগ থাকো, পাকা দেয়ালের ঘরও তোলা যাবে কিন্তু ছাদটা পাকা করা যাবে না। সর্বোচ্চ শৌচাগারে পাকা ছাদ দেওয়া যাবে। কিন্তু সত্যজিত গায়ের জোরে শ্রীঅঙ্গনের নিয়ম ভেঙেছে। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অঙ্গনের কয়েকজন বাসিন্দার ঘরে পাকা ছাদ দিয়েছে।’

 ‘প্রতিবাদ করেনি কেউ?’

‘প্রতিবাদ! হয়নি আবার, কাজে দেয়নি। ক্ষমতার জোরে সব শুদ্ধ করে নিয়েছেন। অথচ কয়দিন আগেও এই অঙ্গনের জায়গায় ছিন্নমূল পরিবার হিসেবে টিনের ঘর তুলে বাস করতেন মানস মুখার্জির (সত্যজিতের বাবা) পরিবার। সত্যজিত নিজেও তো এই অঙ্গনের পরিচালনা কমিটির একজন বলে শুনেছি।’ অঙ্গন লাগোয়া লাহিড়ি পাড়ায় বাস নিত্ত গোপালের। বাপ-দাদাও ছিলেন এখানেই।

তাদের কথার সূত্র ধরে অঙ্গন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে, রীতিমতো চমকে ওঠার মতো তথ্য মেলে।

‘টাকার পাহাড় বানাতে চেয়েছিল সত্যজিত। কয়দিন হলো গোয়ালচামট হাউজিং এস্টেটে বাড়ি করেছে। আবার সেখানে বসেই অঙ্গনের সম্পদ লুটেপুটে খাওয়ার ফন্দি ফিকির করেছে। এও কি ভগবানে সয়!’ সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভরা মুখে দুহাত মুছে নিয়ে কথা বলছিলেন আঙ্গিনার একজন প্রবীণ সাধু। থেমে গেলেন। আর কিছু বলতে চাইলেন না। আঙুল ইশারা করে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি দেখিয়ে দিলেন। ‘উপরে যান, সেখানে বাংলাদেশ মহানাম সম্প্রদায় কমিটির সদস্যরা আছেন। এই আঙ্গিনার দেখভাল তারাই করেন। তারা আরও ভালো বলতে পারবেন।’

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই উপাসনালয়ই নয়, ফরিদপুর শহরে কানপাতলেই শোনা যায় প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর অপসারিত এপিএস ও ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা সত্যজিত মুখার্জির নানা অপকর্মের কথা। তার সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মোকাররম মিয়া বাবুর দুর্নীতি-অনিয়মের কাহিনি সাধারণ মানুষের মুখেমুখে।

এতদিন মুখ বুজে সয়ে যাওয়া ভুক্তভোগীরা তাদের প্রতি অন্যায়, অবিচারের বর্ণনা দিয়ে বুকটা হালকা করতে পারলে যেন খুশি হন। শহরের চায়ের টং দোকানি থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিপণিবিতানের ব্যবসায়ীরাও ফুঁসে আছে সত্যজিত আর মোকাররম বাবুর ওপর। তাদের কারণেই শহরের আধুনিক মার্কেটগুলোতে ঠাঁই হয়নি যুগের পর যুগ ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসা ব্যবসায়ীদের। বংশ পরম্পরায় যারা ব্যবসায়ী হিসেবেই দিন পার করছেন অন্যায়ভাবে মার্কেটের নবনির্মিত ভবনগুলোতে তাদের দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী পথে বসে গেছে। চিন্তায় চিন্তায় অকালে প্রাণও হারিয়েছে অনেকে। অনেকে দীর্ঘদিন বেকার জীবন পার করছেন সত্যজিত-মোকাররম ও তাদের অনুসারী-অনুগামীদের অন্যায়-অবিচারে। সাধারণ মানুষও ক্ষুব্ধ এই দুইজনের ওপর।

সত্যজিত মুখার্জির বিরুদ্ধে ফরিদপুর কোতোয়ালি ও ঢাকার পল্টন থানায় ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও মানবপাচারের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৩টি। মোকাররম বাবুর বিরুদ্ধেও ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগে আছে ছয়টি মামলা। দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) নেমেছে এই দুই জনের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে। পুরোদস্তুর খোঁজ চলছে দুর্নীতি ও অনিয়মের।

ফরিদপুর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন মনে করেন, ‘সত্যজিত ও মোকাররম বাবুর কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রয়োজন। আর এটা দিতে হবে এই দুইজনের অর্জিত সম্পদ থেকেই।’ তিনি বলেন, ‘মানুষের ধন-সম্পদ লুট করে যারা আজ টাকার পাহাড় গড়েছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি তাদের অবৈধ সম্পদ জব্দ করে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। আশা করি দুদকের সুষ্ঠু তদন্তে তাদের অবৈধ সম্পদের চিত্র ফুটে উঠবে।’

জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী বলেন, ‘সত্যজিত ও মোকাররমের কারণে ফরিদপুর শহরের অনেক নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা এমন ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল যে, কেউ মুখ খুলতে সাহস পেতো না। কিন্তু এখন তাদের দুর্নীতি, অনিয়মের চিত্র সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে স্বস্তি এসেছে। এ উপযুক্ত বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষের মনে শান্তি আসবে না।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকÑসুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের কারণে সমাজের সাধারণ মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমাজের নিরীহ মানুষরা এসব দুষ্টু লোকের কারণে সব সময় ভোগান্তির মধ্যে থাকে। তবে সর্বস্তরের মানুষ এক হয়ে দুর্নীতিবাজদের কোণঠাসা করতে পারলে সমাজকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে রক্ষা করতে পারে।’

শ্রীঅঙ্গন নিয়ে সত্যজিতের ‘বিশ্রী’ মতলব

কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী। বাংলাদেশ মহানাম সম্প্রদায়ের সভাপতি। শ্রীঅঙ্গনের দেখভালের দায়িত্বে থাকা এই প্রবীণ সাধু ভেতরে কিছু না রেখেই বলে দিলেন, ‘সত্যজিত মুখার্জি এই আঙ্গিনার শত বছরের নিয়ম-কানুনকে যেভাবে অশ্রদ্ধা করেছে তা নিন্দনীয়। আঙ্গিনার জায়গায় যারা থাকতো তারা কি না এর বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করে! তাও আবার আঙ্গিনাতে বসেই! নিজের বাড়িতেও নাকি লোকজনদের ডেকে নিয়ে রাতের আঁধারে নানা ষড়যন্ত্র করতো। যাদের সঙ্গে নিয়ে এসব করেছে তাদের মধ্যে আমাদের ভক্তরাই এসে এসব তথ্য দিয়েছে।’

তিনি জানান, শ্রী আঙ্গিনার গোটা এলাকাটি চারটি ভাগে ভাগ হয়েছে। উত্তরে মার্কেট, পূর্বে পল্লী বাগানবাড়ি, পশ্চিম পল্লী এবং দক্ষিণ পল্লী। এই দক্ষিণ পল্লীতে নাকি রাত-বিরাতে এসে নানা শলাপরামর্শ করতো সত্যজিত। নিয়ম হচ্ছে, ছিন্নমূল হিন্দু পরিবার এই আঙ্গিনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা মাসিক ৯০ টাকা ভাড়ায় নিতে পারবেন ঘর বানানোর জন্য। ঘরের দেয়াল পাকা হলেও উপরে দিতে হবে টিন। ছাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। শুধু শৌচাগারের ওপরে পানির ট্যাংক বসানোর সুবিধায় ছাদ দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ আঙ্গিনার জায়গায় স্থায়ী কোনো স্থাপনা করা যাবে না। এই নিয়মই যুগ যুগ ধরে মেনে আসছে সবাই।

কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন,‘গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে দক্ষিণ পল্লীতে কয়েকজন বাসিন্দা রাতের আঁধারে পাকা ছাদ করেছিল। খবর পেয়ে আমরা দিনের বেলায় প্রশাসনের লোকজন নিয়ে গিয়ে সেই ছাদ অপসারণ করি। আর যেন কেউ এ ধরনের কাজ না করে সেজন্য নির্দেশনাও দেওয়া হয়। সব ঠিকই ছিল। কিন্তু সত্যজিত ওই বাসিন্দাদের নিয়ে দিনের পর দিন বৈঠক করে গ্রুপিং করার চেষ্টা করে। সে আমাদের বলে এই আঙ্গিনার দায়িত্ব আমার কাছে। কে কী করছে আমি দেখছি।’

কান্তিবন্ধু বলেন, ‘সত্যজিতকে আমরা আঙ্গিনার সাধারণ সদস্য করেছিলাম। যে কারণে তার কথার প্রতি আস্থা রেখেছিলাম। কিন্তু পরে আবারও দক্ষিণ পল্লীর লোকজন ঘরে পাকা ছাদ দেয়। তাদের কাছে জানতে চাইলে বলে, তারা সরকারি আদেশ পেয়েছে। কোথা থেকে এসেছে এই সরকারি আদেশÑজানতে চাইলে বাসিন্দারা সত্যজিতের কথা বলে।’

বাংলাদেশ মহানাম সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদক বন্ধু সেবক ব্রহ্মচারী বলেন, ‘আমরা সত্যজিতের কাছে ছুটে যাই। সে দায়িত্ব নেওয়ার পরও কেন পাকা ছাদ উঠেছে জানতে চাইলে সে বলে, ‘আমিই অনুমতি দিয়েছি। আপনাদের কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে বলেন। এসব নিয়ম-টিয়ম করে লাভ নেই। পরে আমরা তার কাছ থেকে ফিরে আসি।’

এই সাধু জানান, ওই ঘটনার পর তারা সত্যজিতের নানা হুমকি-ধামকির শিকার হয়েছেন। সত্যজিতের কথা না শুনলে ‘খবর আছে’ এমন হুমকিও নাকি এসেছে তার অনুসারী-অনুগামীদের কাছ থেকে। মাঝে আঙ্গিনার উৎসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল পরিচালনা কমিটি। গত ২ মে আঙ্গিনার এক অনুষ্ঠানের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। তার উপস্থিতিতে সাধুরা গত ফেব্রুয়ারিতে সত্যজিতের কারণে ঘটে যাওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে তুলে ধরেন।

কান্তিবন্ধু ব্রহ্মচারী জানান, শিগগির আঙ্গিনা পরিচালনার কার্যনির্বাহী কমিটি বৈঠকে বসবে। বৈঠকে সত্যজিতের ব্যাপারে ও যারা আঙ্গিনার নিয়ম ভেঙে পাকা ছাদ তুলেছেন তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা ঠিক করা হবে।

শ্রী আঙ্গিনার একটি সূত্র জানায়, সত্যজিত ও তার অনুসারী-অনুগামীরা আঙ্গিনার বিশাল আবাসিক এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পাঁয়তারা করছিল। তারা চাইছিল যে করেই হোক, আঙ্গিনার আবাসিক এলাকার ভাড়া থেকে শুরু করে অন্য সবকিছু তাদের কব্জায় নিয়ে লুটেপুটে খেতে। ছিন্নমূল মানুষের কল্যাণে যুগের পর যুগ সেবা দিয়ে আসা এই আশ্রমটিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে পরিণত করার পাঁয়তারা করেছিল। যেটা আঙ্গিনা কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরে তার ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু সত্যজিতের ভয়ে প্রকাশ্যে তারা কিছুই বলতে পারতো না।

শিক্ষকের গায়ে হাত তুলেছিল বাবু

ধর্মীয় উপাসনালয় নিয়ে ‘অধর্মের’ কাজ করেছে সত্যজিত মুখার্জি। আর মোকাররম মিয়া বাবু শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তুলে ছাত্র-শিক্ষকের শ্রদ্ধার জায়গাতে চরম আঘাত হেনেছে। এই অপরাধে গোটা সমাজের মানুষ থু-থু ছিটিয়েছে মোকাররম বাবুর নামের ওপর। এমনটাই মন্তব্য করেছেন বাবুর এক সময়ের একজন রাজনৈতিক সহকর্মী। তিনি বলেন, ‘শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার অপরাধে গোটা ফরিদপুরবাসী সেদিন বাবুকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলতো। কিন্তু তার অস্ত্র ও পেশীশক্তির ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস করেনি।’

ঘটনাটি ২০১৩ সালের মার্চের। ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ পদে নিজের বোনের স্বামীকে চাকরি দিতে না পেরে ওই কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষকে মারধর করে জেদ মিটিয়েছিল মোকাররম বাবু। কলেজ সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে ফরিদপুর মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ অধ্যাপক ম হালিমের মেয়াদ ফুরিয়ে এলে নতুন অধ্যক্ষ নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বাবুর বোনের স্বামী কে এম শরীফ উদ্দিন তখন ওই কলেজের প্রভাষক ছিলেন। যোগ্যতা না থাকতেও সেও অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেতে আবেদন করে। অথচ জ্যেষ্ঠতার বিচারে আরও ১৭ জন অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক তার আগে ছিলেন। তাদের ডিঙিয়ে নিয়োগ পেতে আগ্রহী ছিলেন শরীফ উদ্দিন। মূলত তার খুঁটির জোর ছিল মোকাররম।

নিয়োগ পরীক্ষার বোর্ড, প্রশ্নপত্র সবই ‘ম্যানেজ’ করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন শরীফ উদ্দিন। কিন্তু ওই নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রশ্নবিদ্ধ এই পরীক্ষার কারণে অধ্যক্ষ নিয়োগ স্থগিত করে দেয় কলেজের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ১৭ জনকে ডিঙিয়ে বাবুর ভগ্নিপতির অধ্যক্ষ হওয়ার বাসনা নস্যাৎ হয়ে গেলে বিগড়ে যায় সে। পরে ওতপেতে থাকা মোকাররম মিয়া ও শরীফ উদ্দিনের ভাই মিরাজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ম হালিমকে ডেকে নিয়ে কিলঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে পালিয়ে যায়।

ওই ঘটনার কথা মনে হতেই চোখ ছলছল করে অধ্যাপক ম হালিমের। ফরিদপুর শহরান্তে টেপাখোলা ঝিলের (সোহরাওয়ার্দী সরোবর) পাড়ে তার বাসায় তার সঙ্গে কথা হয় গত বৃহস্পতিবার। তিনি বলেন, ‘কী কারণে আমাকে মারধর করা হলো তার আগে থেকেও কিছুই জানতাম না আমি। মার খাওয়ার পর বাবুর ক্ষোভের কারণ বুঝতে পারলাম। সে আমার ছাত্র ছিল। আমি কল্পনাও করতে পারিনি, ক্ষমতা মানুষকে এভাবে অন্ধ ও অসভ্য করে দেয়।’

এই শিক্ষক বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয় (খন্দকার মোশাররফ হোসেন) একজন সৎ, দক্ষ ও যোগ্য প্রশাসক। তার মনটা অনেক বড়। শিশুর মতো। কিন্তু তিনি কঠোর হলে তার সিদ্ধান্তে বাইরে যাওয়ার সাহস কারো নেই। আমাকে মারার ঘটনায় তিনি বাবুর প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। প্রকাশ্য সভায় আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে বাবু আমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার ভান করলে আমি তাকে কিছুই বলতে পারিনি। কিন্তু পরে বুঝেছি এসবই ছিল তার নাটক। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে সে আমার পা ছোঁয়ার ভান করেছে।’

প্রবীণ এই শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, ‘গুরুজনরা প্রায়ই বলতেন, শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি করার পর শিক্ষক ক্ষমা করে দিলেও সৃষ্টিকর্তা ক্ষমা করেন না। তিনি ঠিকই এর বিচার করেন। মোকাররম মিয়া বাবু যদি সত্যিকারের মানুষ হয় তাহলে সেও এটা অনুধাবন করতে পারছে।’

ফরিদপুর মহাবিদ্যালয় কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, ‘কলেজে প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও বাবু ও তার ভগ্নিপতি শরীফ উদ্দিন লাখ লাখ টাকা ঘুষ খেয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অনেকেই এসব কথা জানতো। কিন্তু বাবুর ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতো না কেউ।’

এইচএসসি পাস বাবু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি!

মোকাররম মিয়া বাবুর সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এইচএসসি। এই যোগ্যতা নিয়ে মাফিয়ার মতো গোটা ফরিদপুর শহর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। বাদ দেননি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। এইচএসসি পাসের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ঈশান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতিও হয়েছিলেন। মূলত স্কুলে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগে মোটা অঙ্কের বাণিজ্যের আশায় ওই পদে এক ধরনের জোর করেই বসেছিল মোকাররম বাবু। অভিযোগ আছে, যে কয়দিন ছিল তার মধ্যে সব ধরনের নিয়োগে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়েছে মোকাররম বাবু। যে বা যারা এর বিরোধিতা করার চেষ্টা করেছে তাদের চাকরিচ্যুত বা চাকরি না দেওয়ার ভয়ও দেখিয়েছে হরহামেশা। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়মের সব তথ্য বেরিয়ে আসার পর সঙ্গে সঙ্গে ঈশান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় মোকাররম বাবুকে।

তিতুমীর মার্কেটের দোকান বরাদ্দ নিয়ে সত্যজিত-বাবুর হরিলুট

ফরিদপুর শহরের সরকারি তিতুমীর মার্কেটের দোকান বরাদ্দ নিয়ে চরম হরিলুটের নজির স্থাপন করেছেন সত্যজিত ও মোকাররম বাবু। ২০০০ সালে মার্কেটের পূর্ব দিকে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ১৬৭টি দোকান। পথে বসে যান অনেক ব্যবসায়ী। পরিবার নিয়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে তাদের জন্য। উপায়ান্তর না দেখে নিজেদের টাকায় ওই সেমিপাকা দোকানগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয়। কিন্তু তাতেও যখন জায়গা হচ্ছিল না তখন ফরিদপুর জেলা প্রশাসন তিনতলা পাকা মার্কেট করে দেওয়ার উদ্যোগ নেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ১৬৭ জন ব্যবসায়ীর অর্থায়নেই মার্কেট নির্মাণের প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরপরই শুরু হয় সত্যজিত ও মোকাররম মিয়া বাবুর নানা পাঁয়তারা। প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী ওই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মার্কেট বানানোর কথা। পাশাপাশি নতুন মার্কেটের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর পরিবারের সদস্যদের নামে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার কথা। অথচ দোকান বরাদ্দ দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াকে বেআইনিভাবে হাত করে এ থেকে কোটি কোটি টাকা হরিলুট করেছে সত্যজিত-মোকাররম। নিয়ম ভেঙে, নির্মাণাধীন মার্কেটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবারকে দোকান বরাদ্দ না দিয়ে এসব দোকান ঘুষের বিনিময়ে অন্যদের বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে তারা। কোনোদিন ব্যবসা-বাণিজ্য করেননি অথবা পরিবারের কেউ ব্যবসায়ী ছিলেন না এমন ব্যক্তিরাও পেয়েছেন দোকান বরাদ্দ।

এসব নিয়ে বঞ্চিত ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ করতে গেলে পদে পদে হামলা ও মামলার শিকার হতে হয়েছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে অবিরত নির্যাতন চলেছে তাদের ওপর। ভয়ভীতিও দেখানো হয়েছে ব্যবসায়ীদের।

অভিযোগ আছে, সত্যজিত ও মোকাররম বাবুর অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় আব্দুল মালেক মিয়া নামে ৮০ বছরের একজন প্রবীণকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। তার সঙ্গে পেটানো হয় বাদল সাহাকেও। মার্কেটের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী সুকুমার সাহাকে গভীর রাতে বাড়ি থেকে ধরে এনেও মারধর করার অভিযোগও আছে। মার্কেট ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়ার অভিযোগও আছে।

মোকাররম বাবু ও তার অনুসারী-অনুগামীদের অত্যাচারে পথে বসা ব্যবসায়ীদের অনেকেই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে কাটাতে মারা গেছে। এদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী গৌতম সাহা, ইউসুফ খান, আকবর মোল্লা (মনা শেখ), নিখিল দাসসহ অন্যরা। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে বেকার জীবন কাটাচ্ছেন।

তিতুমীর মার্কেটের গম ব্যবসায়ী ইদ্রিস শেখ। ২০০০ সালে পুড়ে যাওয়া দোকানগুলোর মধ্যে একটি ছিল তার। এখন তিনি প্রায় অন্ধ। এজন্য দায়ী মোকাররম বাবুরাই। জানতে চাইলে ইদ্রিস শেখের ঘনিষ্ঠরা জানান, মোকাররম বাবুর লোকজন তাকে এমনভাবে পিটিয়েছে যে, তিনি ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছেন। চোখে কিছুই দেখতে পারেন না তিনি।

তিতুমীর মার্কেটের একজন ফল ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের পরিবারের চারটি দোকান ছিল এই মার্কেটে। এখন একটিও নেই। পুড়ে যাওয়ার পর নতুন মার্কেটের জন্য টাকা দিয়েছি। কিন্তু যেভাবে নির্মাণ কাজ এগোচ্ছে তাতে কবে দোকান পাব তার কোনো ঠিক নেই। এসব কিছুর জন্য দায়ী মোকাররম ও সত্যজিত। তাদের কারণেই মার্কেটের কাজ এতদিন ধীর গতিতে চলেছে।’ তিনি বলেন, ‘মোকাররম বাবু ও সত্যজিত যেভাবে মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে বেরিয়েছে তা না দেখলে বিশ্বাস করার মতো না। তাদের কারণে এই শহরের শত শত ব্যবসায়ী আজ পথের ফকির। ব্যবসায়ী হয়েও দোকান বরাদ্দ নিতে গিয়ে জায়গা-জমি বিক্রি করতে হয়েছে। দোকানের মূল্যের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি ঘুষ দিতে হবে বাবুদের। এসবের কি কোনো বিচারই হবে না?’

ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির বিস্তর অভিযোগ

মামলার পাহাড় জমেছে সত্যজিত মুখার্জি ও মোকাররম মিয়া বাবুর বিরুদ্ধে। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর এপিএস পদ থেকে অপসারিত এবং ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর সত্যজিতের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও মানবপাচারের অভিযোগে ১২টি মামলা হয়েছে ফরিদপুরের কোতোয়ালি ও ঢাকার পল্টন থানায়। মোকাররমের বিরুদ্ধেও ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির অভিযোগে আছে ছয়টি মামলা। একাধিক মামলায় পুলিশের রিমান্ডে আছে মোকাররম মিয়া।

তিতুমীর বাজারে দোকান বরাদ্দের পর তা বুঝে পেতে চাঁদা দাবি করে সত্যজিত মুখার্জি। তা না হলে প্রভাব খাটিয়ে দোকানের বরাদ্দ বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়।গোয়ালচামটের মোল্লবাড়ী সড়কের বাসিন্দা সুমন সাহা এ অভিযোগে একটি মামলা করেছেন কোতোয়ালি থানায়। তিনি এজাহারে বলেন, তিতুমীর মার্কেটে  দোকান বরাদ্দ পেতে সুমন সাহা সত্যজিত, রূপক কুমার সাহা এবং জহিরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সত্যজিত তাকে নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করতে বলেন। তিনি এই প্রক্রিয়ায় দোকান বরাদ্দ পান। পরে গত ৭ মার্চ সত্যজিত মুখার্জি রূপক এবং জহিরুলকে নিয়ে একটি কালো রঙের প্রাইভেটকারে করে তার বাড়িতে গিয়ে বলেন, বরাদ্দ পাওয়া দোকান বুঝে পেতে হলে তাকে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হবে। তা না হলে তার বরাদ্দ পাওয়া দোকান প্রভাব খাটিয়ে বাতিল করে দেওয়া হবে। ভয়ে আসামি তাকে নগদ দুই লাখ টাকা চাঁদা দেন। পরে সত্যজিত তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে বাকি তিন লাখ টাকা সময় মতো না দিলে মেরে লাশ গুম করে ফেলার হুমকি দেন।

ব্যবসায়ী অংশীদার হতে না দেওয়ায় সন্ত্রাস ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলির মসজিদবাড়ী সড়কের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সেলিম হাসান এ অভিযোগে থানায় মামলা করেছেন। শহরের নিউমার্কেটের তৃতীয় তলায় ডরিমন চাইনিজ রেস্টুরেন্টটি তার। এই ব্যবসায়ীর অভিযোগ, সত্যজিত মুখার্জি তার ব্যবসায়ী অংশীদার হতে চেয়েছিল। তাকে তার ব্যবসার সঙ্গে নিলে নিউ মার্কেটের পুরো ছাদটি বরাদ্দ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে বলেও আশ্বস্ত করে। কিন্তু ওই ব্যবসায়ী রাজি না হওয়ায় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে গত ৫ মার্চ তার কাছে আড়াই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ সময় সেলিম হাসান তাকে নগদ দেড় লাখ টাকা চাঁদা দেন। বাকি টাকা সাত দিনের মধ্যে দিতে না পারলে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। পরে ঠিক তাই করেছে সত্যজিত। ব্যবসা হারিয়ে ওই ব্যবসায়ী এখন পথে বসেছেন।

ব্যবসায়ী অংশীদার না করায় গোয়ালচামটের লাহেড়ি পাড়া এলাকার চন্দ্র পোদ্দারের কাছ থেকেও এক লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে সত্যজিত। অভিযোগ আছে, সে জোর করে ব্যবসায়ী অংশীদার হতে চেয়েছিলেন। সরকারি মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে। কিন্তু ওই ব্যবসায়ী ঝুঁকি মনে করে রাজি হননি। তাতেই বিগড়ে যান সত্যজিত। গত ৬ মার্চের এ ঘটনায় করা মামলায় সত্যজিতের পাশাপাশি তার স্ত্রী সুমিকা মুখার্জিকেও আসামি করা হয়েছে।  

হাউজিং এস্টেটে নিজের বাড়ি করার কাজে ভারী যন্ত্র ব্যবহারের পর বিল পরিশোধ না করে উল্টো মেশিনের মালিকের কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগ আছে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। টাকা চাইলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। শহরের কৈজুরী ইউনিয়নের বাসিন্দা এই অভিযোগের কথা তুলে ধরে সত্যজিতের বিরুদ্ধে মামলা করেন সামচু মোল্যা। এজাহারে বলা হয়, বাড়ি করার সময় সত্যজিত মাটি কাটার কাজে তার এসকেভেটর (ভেকু) নিয়ে সাতদিন কাজ করেন। সে অনুযায়ী ভাড়া হয় এক লাখ ১০ হাজার টাকা। কিন্তু টাকা পরিশোধ না করে সত্যজিত তাকে ঘোরাতে থাকে। বিষয়টি তার বাবা মানস মুখার্জির কানে দিলে সে উত্তেজিত হয়ে যায় এবং সামচু মোল্যাকে শাসায়। উল্টো ব্যবসা করতে হলে তার কাছে মাসে ১৫ হাজার টাকা করে নিয়মিত চাঁদা দাবি করে। এ ঘটনা কাউকে জানালে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয় তাকে।

পোশাক কিনে ও বানিয়ে বাকি হওয়া টাকা চাওয়ার কারণেও ব্যবসায়ীকে রক্তচক্ষু দেখিয়েছেন সত্যজিত, এমন অভিযোগ বদরপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সঞ্জিত কুমার মিত্রের। রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে উপজেলা মসজিদ মার্কেটে পোশাক ও টেইলার্সের দোকান। বিভিন্ন সময় পোশাক কেনা ও বানানোর কাছে তিনি সত্যজিতের কাছে ৭০ হাজার পাঁচশ টাকা পাওনা ছিলেন। এই টাকা তো তিনি আদায় করতে পারেননি বরং টাকা আদায়ের তাগাদা দিলে সত্যজিত তাকে মাসে মাসে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দেওয়ার দাবি জানান। এছাড়া কানাইপুর বাজারে গ্রামীণ বস্ত্রালয় থেকে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা মূল্যের পোশাক কিনে তার টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বরং ব্যবসা করতে হলে মাঝেমধ্যে এমন উপঢৌকন দেওয়া লাগবে বলে ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ গোস্বামীকে শাসিয়ে যায় সত্যজিত। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে।

ছাত্রলীগের কমিটিতে পদ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আছে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ফাইনকে কলেজের ছাত্রলীগের কমিটিতে সভাপতি করার আশ্বাস দিয়ে চার লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে সত্যজিত। অন্যথায় তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। পরে ফাহাদ দুই লাখ টাকা চাঁদা দেন সত্যজিতকে। বিষয়টি কাউকে না জানানোর ব্যাপারে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয় তাকে।

ধর্ষণের অভিযোগেও মামলা হয়েছে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। ফরিদপুর শহরের কৈজুরী ইউনিয়নের একজন নারী এই মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, সত্যজিত বিদেশে পাঠানোর কথা বলে ওই নারীকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে। পরে গত ১১ এপ্রিল রাতে তার সঙ্গে ‘কথা আছে’ বলে একটি বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে। এছাড়াও নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় লোক পাঠানোর কথা বলেও মানুষের কাছ থেকে বছরের পর বছর টাকা নিয়ে ঘোরাতে থাকে সত্যজিত। অভিযোগ আছে, পাসপোর্ট ও টাকা নিয়ে যখন বিদেশ পাঠাতে পারছিল না তখন তার কাছে এগুলো ফেরত চাওয়া হলে হুমকি-ধামকি দিতো সে।

পশ্চিম গোয়ালচামটের বাসিন্দা ঠিকাদার মীর আবুল হোসেনকে ব্যবসা করতে হলে চাঁদা গুনতে হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল সত্যজিত। পরে তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদাও আদায় করা হয়। আরেক ঠিকাদার সালেহ আহমেদ জানান, সত্যজিতের হুমকির মুখে এক সঙ্গে সাড়ে সাত লাখ টাকা চাঁদা দেন তিনি। এ ঘটনায় করা মামলায় ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এই ঠিকাদার।

গত ২৬ এপ্রিল ঢাকার পল্টন থানায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে সত্যজিতের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন টেকনোমিডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথ। মামলাটির তদন্ত চলছে। তবে সত্যজিত এখনও পলাতক।

 ধর্ষণ ও চাঁদাবাজি মামলার আসামি মোকাররম মিয়াও

শহরের ধুলধী রেলগেট সংলগ্ন মল্লিক ট্রেডার্সের মালিক এস এম সরোয়ার হোসেন সন্টুর কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে ১৫ লাখ টাকা আদায় করে মোকাররম মিয়া ও সত্যজিত। গত ১০ এপ্রিল রাতে ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তারা দুজন ওভারসিসের ব্যবসা করতে হলে তাদের চাঁদা দিতে হবে বলে দাবি করেন। পরে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে পরদিন ১৫ লাখ টাকা আদায় করেন। এ ঘটনা সন্টুর করা মামলার তদন্ত চলছে।

দেড় লাখ টাকায় বিদেশে পাঠানোর কথা বলে এক নারীকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে মোকাররম মিয়া বাবু। কৈজুরী ইউনিয়নের বাসিন্দা ওই নারীর অভিযোগ, তিনি যখন বাবুকে বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন তখন সে তাকে একটি বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় ওই নারী বিস্তারিত তুলে ধরে বাবুর বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণ মামলা করেছে। মামলায় বাবুকে প্রতারক ও মানবপাচারকারী বলেও উল্লেখ করা হয়।

ফরিদপুর শহরের ঠিকাদার সফিউল আলমের অভিযোগ, মোকাররম বাবুর কারণে দীর্ঘদিন শান্তি  মতো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেননি তারা। বাবুর লোকজন তাদের পিছু নিয়ে থাকতো সব সময়। যে কোনো সময় টাকা দাবি করে বসতো তারা। এমনকি সফিউল আলম একটি নতুন মোটরসাইকেল কিনলে সেটিও ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে মোটরসাইকেলটি ফেরত আনেন সফিউল।

জেলা পরিষদের নির্মাণাধীন ‘স্বর্ণকমল’ মার্কেটে দুই কোটি ১৯ লাখ টাকার কাজ পান আরেক ঠিকাদার বিল্লাল হোসেন। তার কাজ চলাকালে গত ২১ মার্চ মোকাররম বাবু তার লোকজন নিয়ে গিয়ে ওই ঠিকাদারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এই টাকা না দিলে তার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেয়। পরে ওই ব্যবসায়ী তাকে দুই লাখ টাকা দিলেও বাকি তিন লাখ টাকার জন্য সে নিয়মিত তাগাদা দিয়ে আসছিল। ঠিকাদার বিল্লাল হোসেন বাকি টাকা দিতে অস্বীকার করলে মোকাররম বাবু তাকে খুন করে ফেলার হুমকি দেয় বলে এ ঘটনায় করা মামলার এজাহারে তুলে ধরা হয়েছে।

ফরিদপুর শহর যুবলীগের সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন বরকতের কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেছিল মোকাররম বাবু। অবিরত হুমকি-ধামকি দিয়ে তার কাছে ৫০ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে চাঁদাও আদায় করা হয়। বাকি ৫০ লাখ টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় বাবু ও তার সাঙ্গপাঙ্গোরা। এ ঘটনায় করা মামলায় চারদিনের পুলিশের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল বাবুকে।- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।