logo ১৯ মে ২০২৫
বিদেশ ভ্রমণের তালিকায় তিনিই সবার শীর্ষে
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
১০ মে, ২০১৫ ১১:৪৮:১২
image

ঢাকা: লাগামহীন দুর্নীতি করেও দাপটের সঙ্গে টিকে থাকার অন্যতম উদাহরণ তাকসিম এ খান। নাগরিকসেবার সরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হয়েও তিনি স্থাপন করেছেন স্বেচ্ছাচারিতার ন্যক্কারজনক নজির। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। কিন্তু সব প্রতিকূলতা ম্যানেজ করে নিতে পটু তাকসিম কোনো অভিযোগেরই তোয়াক্কা করেন না।

তাকসিম ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে সওয়ার হওয়ার পর থেকেই অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর লুটপাটের আখড়া হয়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। ওয়াসার বিশুদ্ধ পানি প্রকল্প, বোতলজাত পানি ‘শান্তি’ বাজার না পাওয়ার পেছনেও তাকসিমের কারসাজি আছে বলে মনে করা হয়। এখন প্রতিবছর এ খাতে লোকসান হচ্ছে কোটি টাকারও বেশি।

আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে এক হাজার ১৩২ জনকে নিয়োগ দিয়ে ৫০ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বেদখল হওয়া খাল উদ্ধার কাজের টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ আছে তাকসিম এ খানের নামে।

কোথায় তিনি কার নামে টাকা রাখেন সে তথ্যও জমা আছে দুদকের কাছে। তাকসিমের ছোঁয়ায় ওয়াসার সব খাতই এখন লাগামহীন দুর্নীতির বেড়াজালে পড়েছে। নলকূপ স্থাপন, পানির লাইন স্থাপন, লাইন মেরামত, পানি শোধনাগার নির্মাণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে গ্রহণ করা প্রতিটি প্রকল্পেই বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ। আরও আছে পানির লাইনে কারসাজি, কারখানায় কম বিল করা, মিটার রিডিংয়ের দুর্নীতি, গ্রাহকদের বিপদে ফেলে অর্থ আদায়, নিয়োগপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের অবৈধ সম্মানীসহ নগরবাসীর দুর্ভোগের নানা অভিযোগ।

এসব ছাড়াও ৭০ হাজার নিম্নমানের পানির মিটার কেনার পেছনেও তাকসিম এ খানের লোভকেই দায়ী করা হয়। কার্যত তিনি আসার পরই ঢাকা ওয়াসা একটি খেলাপি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এতকিছুর পরও মাঝে-মধ্যেই ক্ষমতাধরদের জন্য ভূরিভোজ আয়োজনে জুড়ি নেই তার।সরকারি প্রতিষ্ঠানকে রীতিমতো ব্যক্তিগত বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসার বেতন নিয়েও গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ-সংবলিত চিঠি জমা পড়েছে দুদকে। তাতে দেখা গেছে, ওয়াসার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা যুগ্ম-সচিবের চেয়ে বেশি।ওভারটাইম ভাতার মাধ্যমে কর্মচারীরা তাদের বেতন বাড়িয়ে থাকেন।

ঢাকা ওয়াসার কিছু ড্রাইভার বেতন ও ওভারটাইম ভাতাসহ প্রায় ৬০ হাজার টাকা পান। আর মোট সাড়ে তিন হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে প্রায় তিন হাজারই এই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির।

অপকর্মের কাহিনীর শেষ নেই ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের। তিনি নিজের আধিপত্য কায়েম করতে ওয়াসায় গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের মাধ্যমেই করেন সব অনিয়ম, দুর্নীতি। ওয়াসায় তিনি এতটাই ক্ষমতাধর যে, প্রধানমন্ত্রীর একটি আদেশও অমান্য করেছেন নিজের স্বার্থে।

বিতর্কিতভাবে নিয়োগ পাওয়া এই এমডি ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে জেঁকে বসে আছেন ওয়াসায়। বড় বড় প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসার কয়েকজন কর্মকতা-কর্মচারী নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, চেয়ারম্যান না থাকায় এমডি তাকসিম এ খান ওয়াসায় একক কর্তৃত্ব চালাচ্ছেন। তার ভয়ে সবাই তটস্থ থাকেন। এ জন্য তার সম্পর্কে কেউ মুখ খুলতে চান না। কারণ মুখ খুললেই তার চাকরি হারানো অথবা সাসপেন্ড হওয়ার ভয় রয়েছে।

উড়ছে তাকসিম ডুবছে ওয়াসা: বেশির ভাগ সময়ই দেশে থাকেন না দোর্দণ্ড প্রতাপশালী তাকসিম। সরকারি কাজের নামে সরকারের টাকায় আমেরিকান পাসপোর্টে ঘোরেন দেশ-বিদেশ। আর প্রতি ট্যুরেই ঢুঁ মারেন আমেরিকায়। সেখানেই তার স্ত্রী-সন্তানরা স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাকসিম নিজেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী। এ কারণে ওয়াসার নানা প্রকল্পের পরিকল্পনা, মেশিনারিজ ক্রয় কিংবা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিপত্র সম্পাদনের নামে ছলেবলে কৌশলে ‘বিদেশ সফর’ নিশ্চিত করা হয়।

বিদেশ সফরে তাকসিম এ খানের নামটা নিশ্চিত করাও সংশ্লিষ্ট সব পিডির বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। সরকারি কাজের ট্যুর যে দেশেই হোক না কেনো ঘুরেফিরে তাকসিম আমেরিকায় পৌঁছান। তার দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো নিয়ে খোদ ওয়াসা কর্মীদের মুখে মুখে চার লাইনের ছড়া শুনতে পাওয়া যায়। ‘ভাবছে তাকসিম, কোন দেশে পাড়ি দিম (দিবো), ওয়াসা ডুবছে-তাকসিম উড়ছে।

চাকরি জীবনের দুই বছর ১০ মাসের মধ্যে এক বছরই বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে কাটিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. তাকসিম এ খান।এই সময়ে দাফতরিক কাজে ১৩টি দেশে এক বা একাধিকবার সফর করলেও প্রতিটি সফরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত করে নিয়েছেন তিনি।

ঢাকা ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা জানান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক গত তিন বছরে প্রায় ২০ বার যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মাল্টিপল ভিসা থাকায় তার যাতায়াতে কোনো সমস্যা হয়নি। প্রতিবার তিনি পাঁচ থেকে ১০ দিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকবার নিজের খরচে গেলেও বেশ কয়েকবার সেমিনার-ওয়ার্কশপের নামে খরচটা ওয়াসার ওপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছেন।এমনকি অন্য কোনো দেশে সেমিনার হলেও যুক্তরাষ্ট্রকে ভ্রমণের তালিকায় যুক্ত করেছেন তিনি। গত এক বছরে তিনি অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফিলিপাইন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র (অনেকবার), সিঙ্গাপুর, উগান্ডা, কেনিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ সফর করেছেন।বিদেশ ভ্রমণের তালিকায় তিনিই সবার শীর্ষে।

ওয়াসার অনেক কর্মকর্তার বক্তব্য, এমডি তার দায়িত্ব পালনের দুই বছর ১০ মাসের মধ্যে অন্তত এক বছরই বিদেশে কাটিয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় ঢাকা শহর নিয়ে তার ভাবারও সময় নেই। কারণ তিনিও যুক্তরাষ্ট্রেই স্থায়ী হতে চাচ্ছেন।

তাকসিম এ খানের বিদেশ ভ্রমণ-সম্পর্কিত নথিতে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকা ওয়াসায় যোগদানের পর এ পর্যন্ত বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে ৯১ দিন বিদেশে কাটিয়েছেন। ২০০৯ সালের ১৭ থেকে ২৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রে, ২০১০ সালের ২৩ ও ২৪  ফেব্রুয়ারি চীনে, ৯ থেকে ১৪ এপ্রিল উগান্ডায়, ২৮ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে, ১০ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর ফিলিপাইন ও ফ্রান্সে এবং ২১ থেকে ২৯ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ায় থেকেছেন।

২০১১ সালের ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত জার্মানি, ৪ থেকে ৮ জুলাই সিঙ্গাপুরে, ২৯ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় এবং ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ২০১২ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত কুয়েতে কাটিয়েছেন। এ ছাড়া ২০১২ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্রিটেনে এবং ২৮ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত ইতালিতে কাটিয়েছেন ড. তাকসিম। বেশির ভাগ সফরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে জুড়ে দেওয়ায় বিদেশে তার মোট অবস্থানকাল এক বছরের বেশি হবে বলে ওয়াসার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান।

তিনিই সর্বেসর্বা: দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস ধরে ঢাকা ওয়াসার চেয়ারম্যানের পদ খালি রয়েছে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে গত বছরের ১৯ জুন পদত্যাগ করার পর নতুন করে এ পদে আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

সূত্র মতে, ওয়াসায় যোগদানের পর থেকে সংস্থাটির এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধ চলছিল চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রহমতুল্লাহর। ওয়াসায় নিয়োগ-বাণিজ্য, দুর্নীতি, এমডির একচ্ছত্র আধিপত্য ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের মনোমালিন্য ক্রমেই বাড়ছিল। ওয়াসার এমডি সরকারের এক প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের ফুপা। তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তদবির করে বোর্ডকে ডিঙিয়ে বার বার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিতে থাকেন।এটা নিয়েই চেয়ারম্যানের সঙ্গে মতবিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে।এর মধ্যে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বিধিবহির্ভূতভাবে চেয়ারম্যানের মাসিক সম্মানী ভাতা বন্ধ করে দেন।


(ঢাকাটাইমস/ ১০ মে / এআর/ ঘ.)