ঢাকা: বছরের শুরুতেই এক কঠিন পরীক্ষায় পড়েছিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আগের বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বছরপূর্তি সামনে রেখে এ বছরের শুরুতে মাঠে সক্রিয় হয় প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক জোট বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল। টানা তিন মাস চলে অবরোধ-হরতাল। তবে শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। আর এর কৃতিত্ব যতটা না দল হিসেবে আওয়ামী লীগের তার চেয়ে বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা এবং প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাই বলছেন, দেশ ও দল পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী এগোলেও দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এগোয়নি।
সরকারের বিভিন্ন অর্জনের পক্ষে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের আশানুরূপ সমাগম ঘটাতে পারেনি দল।
বছরজুড়ে দলটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ও সমালোচনার কারণ ছিল দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ।এসব ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অগ্রগতি যা-ই হোক, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে।বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক কয়েকটি পুরস্কারও অর্জন করেছে সরকার। এই কৃতিত্বের ভাগ দলটি চাইতেই পারে।
আবার সরকারের বা দলের নেত্রীর অর্জন ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রচিন্তাকে জনগণের কাছে ভালোভাবে তুলে ধরতে দল দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে বলেও মনে করেন দলের কেউ কেউ।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী মনে করেন, পঁচাত্তরের পরে ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় যে সাংগঠনিক দুর্বলতার তৈরি হয়েছিল আওয়ামী লীগে, তিন দফা ক্ষমতাসীন হয়ে সেটি অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে তারা। ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, পঁচাত্তরে পটপরিবর্তনের পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তারা ক্ষমতার বাইরে ছিল। এতে করে আ.লীগের সাংগঠনিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তারা দলকে সাংগঠনিকভাবে গোছানো শুরু করে। এরপর ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। এর মাধ্যমে দলটি তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার বলেন, সরকারি দল হিসেবে অন্য দলগুলোকে কীভাবে মোকাবেলা করছে, কিংবা তাদের মতাদর্শ এই বছরে কীভাবে প্রচার করছে, সেটা বড় কথা নয়। আওয়ামী লীগকে চিন্তা করতে হবে তারা এখন ক্ষমতায়। জনগণ এ বিষয়গুলো ছাড়াও অন্য কিছু চাই। দুর্নীতি মাঠপর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। আওয়ামী লীগের জন্য এ বছরের মূল্যায়ন মিশ্র।
বিদায়ী বছরে দলের মূল্যায়ন সম্পর্কে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ২০১৫ সালকে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের বছর বলছেন।
অন্তঃকোন্দল থাকলেও বেশ কিছু সাংগঠনিক জেলা, উপজেলার সম্মেলন করেছে দলটি। দিবসভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয় এবং সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাংগঠনিক বছর পার করল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
বছরের প্রথম সম্মেলনটি হয় সিরাজগঞ্জ সাংগঠনিক জেলার। ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি ওই সম্মেলনের পর বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সম্মেলন দেয়া হয়। সর্বশেষ ১ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা জেলা সম্মেলন হয় দলের।
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, পাশাপাশি জামায়াত-বিএনপির দীর্ঘমেয়াদি তাণ্ডব মোকাবেলা করেছে আওয়ামী লীগ। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দুরূহ কাজ ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এক ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।
জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে অনেকগুলো অর্জনের কথাও বলেন আওয়ামী লীগের এই নেতা। এই অর্জন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের মাধ্যমে হয়েছে। তার ভাষায়, “দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচক্ষণতার পরিচয় এটি। তবে আমাদের সরকারের বা নেত্রীর অর্জনগুলো ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রচিন্তাকে জনগণের কাছে ভালোভাবে তুলে ধরতে আমরা দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছি।”
সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে পার্টির নীতি-আদর্শ, লক্ষ্য, নির্বাচনী ওয়াদার ভিত্তিতে গণরায় পেয়ে সরকার গঠন করলে দলের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু দলের নীতিসমূহ সরকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও জনগণের অংশীদারি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দলের দায়দায়িত্ব সঠিকভাবে পরিচালিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
আবু সাইয়িদ বলেন, সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে সরকারের অর্জনসমূহ জনগণের কাছে তুলে ধরতে অনেকটাই ব্যর্থ দল। তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করে সরকারকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে সরকারের ওপর দল নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে দলের কার্যক্রম সরকারের মুখাপেক্ষী। দলের সরকার না হয়ে সরকারের দল হয়ে গেছে।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, সরকারের অর্জন অনেক। সেই অর্জনগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে জনগণকে একতাবদ্ধ করে দলকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তেমনটি সফল হয়নি। এখানে দলের কার্যক্রমের চেয়ে সরকারের কার্যক্রম এগিয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে গেলেও দল সেভাবে এগোয়নি।
(ঢাকাটাইমস/২৮ডিসেম্বর/মোআ)