logo ০৫ মে ২০২৫
দুই শতাধিক পৌরসভায় লড়াইয়ের আভাস
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:১১:১৪
image

হোক স্থানীয় নির্বাচন, দলীয় প্রতীকের কারণেই দুই শতাধিক শহরে (পৌরসভা) দুই দলের মধ্যে লড়াই এনেছে জাতীয় নির্বাচনের আবহ। নৌকা না ধানের শীষ-কোনটা জিতবে বেশিরভাগ আসনে? তাকিয়ে গোটা দেশবাসী। আওয়ামী লীগ জিতলে প্রমাণ হবে সরকার সঠিক পথেই আছে। বিএনপির আন্দোলনে জনসমর্থন নেই। আর বিএনপি জিতলে জোর গলায় তারা বলতে পারবে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ তাদের পক্ষে। সরকার জোর করে ক্ষমতায় বসে আছে। তবে লড়াইটা কি কেবল দুই দলের? না। পরোক্ষ আরও একটি লড়াইয়ে আছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এই সংস্থাটির কতটা দক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তাদের সক্ষমতা কতদূর তার প্রমাণও হবে এই নির্বাচনে।


বাংলাদেশে হাতেগোনা দুই একটি বাদে কোনো নির্বাচন কমিশনই বলতে গেলে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদের কমিশনও বাদ যায়নি। নিয়োগের পর সরকারের গত আমলে চার সিটি নির্বাচন, বেশ কিছু সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন সুষ্ঠুভাবেই আয়োজন করেছে এই কমিশন। তবে বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর এই কমিশন নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপি। কমিশন অবশ্য বলছে, নির্বাচন অনুষ্ঠান তাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধ্যকতা ছিল। আর নির্বাচনে কে আসলো বা বর্জন করল, সেটা দেখা কোনোভাবেই কমিশনের কাজ নয়। বর্তমান কমিশনের অধীনেই সর্বশেষ রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক নেই বললেই চলে। ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছিল ওই নির্বাচনে। নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেনি বিএনপি। বরং বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকার জন্য প্রশংসা পেয়েছে নির্বাচন কমিশন। ২০১৩ সালের জুনের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত চার সিটি নির্বাচনে সহজ জয় পেয়েছিল বিএনপি।


তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ঠেকাতে ওই সময় আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। দিনের পর দিন হরতাল ডেকে দাবি আদায়ের চেষ্টা হয়েছে। অবরোধের ডাক এসেছে। সিটি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পরও দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে সাহস করেনি দলটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চার সিটি নির্বাচনের উদাহরণ টেনে তাদের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব এমন দাবি করেছিল। কিন্তু বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের উদাহরণ জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নিতে চায়নি।


বিএনপিবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে। জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও উপজেলা নির্বাচন থেকে পিছু হটেনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। চারদফায় অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপের তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। প্রথম দুই দফাতেই আওয়ামী লীগের চেয়ে এগিয়ে ছিল বিএনপি। নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা শুরু হয় তৃতীয় দফা থেকে। প্রচার-প্রচারণা চলাকালেও সহিংসতা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ভোটে হস্তক্ষেপের ব্যাপক অভিযোগ তো ছিলই বিএনপি তরফে। প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ পিছিয়ে থাকলেও পরের দুই ধাপে বিএনপিকে ছাড়িয়ে গেছে দলটি। এরপর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হস্তক্ষেপের জোরালো দাবি তুলে ভোটের দিন নির্বাচন বয়কট করেছে বিএনপি। এই পরিস্থিতিতে বর্তমান কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বারবার বলে আসছে বিএনপি। তারপরও দলীয় প্রতীকে বর্তমান কমিশনের অধীনেই পৌর নির্বাচনে অংশ নিয়েছে দলটি।


শুরুতেই চাপে নির্বাচন কমিশন


দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচনেও সরকারি দলের হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছে দলটি। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাপ সৃষ্টির অভিযোগ আছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের নিজ জেলা ফেনীতেই ঘটেছে এমন কাণ্ড। ফেনী সদর ও পরশুরাম পৌরসভায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র হতে চলেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। কাউন্সিলরদের অবস্থাও একই। এমনও হয়েছে কাউন্সিলর হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার মতো প্রার্থী ছিল না বিএনপির পক্ষে। যে কারণে কাউন্সিলররাও বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার অপেক্ষায় আছেন।


ফেনী বিএনপির প্রথম সারির একজন নেতা এই সময়কে বলেন, ‘মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সেটি বাতিল হয়ে যাবে এমন সম্ভাবনা থাকলে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে লাভ কী? ফেনীতে তাই হয়েছে।’ অভিযোগ আছে, অনেক পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীকে প্রচারণার জন্য মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার চাপও দেওয়া হচ্ছে। প্রকাশ্য সহিংসতাও ছড়িয়েছে জামালপুর, দিনাজপুরসহ বেশ কয়েকটি জায়গায়। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হামলায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে দিনাজপুরে।


এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। পৌরসভার মেয়র প্রার্থীদের দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আছেন বিদ্রোহীরাও। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্থানীয় সংসদ সদস্যের আস্থাভাজন প্রার্থী দলের টিকিট পেয়েছেন। আবার আওয়ামী লীগের মধ্যে যে অংশ বঞ্চিত হয়েছে তারা মাঠে আছেন তাদের পছন্দের প্রার্থী নিয়ে, নির্বাচনের ভাষায় যিনি বিদ্রোহী। পত্রপত্রিকার খবর এবং স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগের মূলে রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সরাসরি মদদ। তৃণমূল নেতা-কর্মী এবং পৌরসভা নির্বাচনের প্রার্থীরা এই ‘বলকে’ ভরসা করে এগিয়ে যাচ্ছেন।


স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষেও সংসদ সদস্যদের মতের বাইরে গিয়ে কিছু করা কঠিনই বটে। দু-একজন মন্ত্রীও জড়িয়েছেন এমন কাণ্ডে। যদিও নির্বাচন কমিশনের ঠিক করে দেওয়া আচরণবিধিতে স্পষ্টই বলা আছে, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও সরকারের সুবিধাভোগীরা কোনোভাবেই নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। তবে তিনি ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে পারবেন। নির্বাচনের আচরণবিধি ভাঙলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বরং কমিশন সরাসরি দায়িত্ব এড়িয়ে রিটার্নিং অফিসারের ওপর তা চাপিয়ে দিয়েছেন।


যেখানে ইসির কমিশনাররা সংসদ সদস্যসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না সেখানে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষে এটি কতটুকু সম্ভব তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। যদিও কদিন আগে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ পৌর নির্বাচনে অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি এভাবে সরকারপ্রধানের সহযোগিতা চাইতে পারেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘নির্বাচনের সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তিও জড়িত। এক্ষেত্রে সরকারপ্রধানের সহযোগিতা ইসি চাইতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই।’ নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারের সহযোগিতা চাওয়া দোষের কিছু না থাকলেও এ থেকে নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা প্রকাশ পায়।


জয়ের জন্য দলীয় প্রতীক নিয়ে পৌর নির্বাচনে লড়তে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। তবে এই লড়াইটা নির্বাচন কমিশনেরও। কোনো প্রতীকের পক্ষে নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অবাধ করার লড়াই। অথচ এই লড়াইয়ে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা অনেক আগেই প্রশ্নের মুখে। কারণ, গত উপজেলা নির্বাচন, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ জমা পড়েছিল কমিশনে তার কোনোটারই সুরাহা হয়নি। কমিশন নিয়ম রক্ষায় একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়া কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। অথচ আচরণবিধি লঙ্ঘনে শাস্তির কথা কাগজে-কলমে ঠিকই আছে।


আচরণবিধি ভাঙলে কী হয়?


কমিশনের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা এই সময়কে বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ব্যবস্থা নেওয়া ইসির পক্ষেই সম্ভব ছিল। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের এই দায়িত্ব দেওয়ায় তারা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। তাদের পক্ষে স্থানীয় সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আকাশ কুসুম কল্পনা। তাছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি ইসি। সর্বোচ্চ কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া পর্যন্তই।


নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে ইসিকে এর দায় নিতে হবে। তারা জনরোষেরও শিকার হতে পারে। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকÑসুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এই সময়কে বলেন, ‘পৌরসভা নির্বাচন অবাধ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি (জাতীয়, উপজেলা, সিটি করপোরেশন) নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কাজেই ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু না হলে নির্বাচন কমিশন, সরকার ও প্রশাসনকে জনরোষের মুখে পড়তে হবে।’


তবে ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করে নির্বাচন কমিশন সরকারের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করতে পারত বলে মনের করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি। নির্বাচন কমিশন যদি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারত তাহলে শুধু তাদেরই নয়, সরকারের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হতো। জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপের প্রধান নির্বাহী নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘এর আগেও বিভিন্ন কারণে নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হয়েছে। এবার একটা সুযোগ ছিল এই পরিস্থিতি থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসার। অথচ তারা এ যাত্রায়ও বিতর্ক এড়াতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।’


বিব্রত ইসি নিরুপায়


পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থীসহ দলীয় লোকজনের আচরণবিধি মানার ব্যাপারে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও কেউ শুনছেন না। বরং যে যার মতো চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচার। আচরণবিধির থোরাই কেয়ার করছেন তারা। প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে এসব খবর। বিব্রত হচ্ছে ইসি। কিন্তু ব্যবস্থা নিতে পারছে না কারো বিরুদ্ধে। অনেকটা নিরুপায় হয়ে পড়েছে তারা। কাগজে-কলমে নিয়ম আছে, প্রয়োগের ক্ষমতা হারিয়েছে কমিশন। এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


ইসির উপসচিব রকিব উদ্দিন মণ্ডলকে প্রধান করে একটি পত্রিকা মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো নিয়ে প্রতিবেদন করে ইসিকে জানান। ইসি তাতে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুমোদন দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারণ দর্শানোর নোটিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ওদিকে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের। তারা ব্যবস্থা নিয়ে ইসিকে জানানোর কথা। অথচ এখনো মাঠ পর্যায় থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার খবর আসেনি ইসিতে।


আচরণবিধি লঙ্ঘনে ক্ষুব্ধ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদও। কথা ছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যেন কোনো প্রার্থী একই অনুষ্ঠানে না থাকে। কিন্তু ৮ থেকে ১০ এলাকায় এই নির্দেশনা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। পৌর নির্বাচনের অনিয়ম ও বিধি লঙ্ঘন মনিটরিং কমিটির সভাপতি উপসচিব রকিব উদ্দিন ম-ল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিজয় দিবসে ভোটের প্রচারে না যেতে বলার পরও গণমাধ্যমে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের বিধি লঙ্ঘনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন সিইসি।’


সম্প্রতি আওয়ামী লীগের তিন সংসদ সদস্যকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ করেছিল ইসি। সেই জনপ্রতিনিধিরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন ইসির কাছে। এরপর মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও মতিউর রহমানসহ ১০ এমপির বিরুদ্ধে বিধি ভঙ্গের দায়ে ইসি কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নিয়ে তা জানানোর নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে প্রতিদিন সকাল ৯টার মধ্যে আগের দিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিধি ভঙ্গের দায়ে কী ব্যবস্থা নিয়েছে তার প্রতিবেদনও একটি ছক আকারে পাঠাতে বলে গত ১৫ ডিসেম্বর। কিন্তু এখন পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কেউ এসে প্রতিবেদন দাখিল করেননি। এ বিষয়ে পত্রিকা মনিটরিং কমিটির প্রধান ও ইসির উপসচিব রকিব উদ্দিন মণ্ডল বলেন, ‘মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তা ইসিকে জানানোর জন্য বলা হলেও রিটার্নিং কর্মকর্তারা এখনো কোনো প্রতিবেদন পাঠায়নি। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেটরাও কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। তবে কিছু প্রতিবেদন হয়ত আসবে।’


ডাইরেক্ট অ্যাকশনহবে কি?


আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে চিঠি না দিয়ে সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। তিনি বলেন, ‘এখন ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ নেওয়া হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তিনি মন্ত্রী-এমপি যে-ই হোন না কেন, যদি কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালান, তাহলে সেই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হবে।’ নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত রয়েছেন। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে এখন থেকে আর কাউকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হবে না। যে-ই আচরণবিধি লঙ্ঘন করবে, তার বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন নেওয়া হবে।’


নির্বাচন কমিশনার জানান, পৌরসভা নির্বাচন সামনে রেখে এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ জনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বলেছিল ইসি। রিটার্নিং কর্মকর্তারা এ অভিযোগগুলোর অধিকাংশেরই কোনো তদন্ত প্রতিবেদন ইসিতে পাঠাননি। যেসব প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে সেসবে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ ধরনের হুঁশিয়ারি এর আগেও নানা সময় দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু আদতে কখনও প্রার্থিতা বাতিলের মতো ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। আর সরকার দলীয় প্রার্থীরা তো আরও বেশি পার পেয়ে গেছেন বারবার। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনকে কথা না বলে কাজ করে দেখাতে হবে। তাহলেই মানুষের আস্থা ফিরবে তাদের ওপর।


সাংসদদের বিরুদ্ধে অভিযোগের হিড়িক


পৌরসভা নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বড় অভিযোগ আছে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন জায়গায় সংসদ সদস্যরা প্রকাশ্যে প্রার্থীর হয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের নিয়েও আলাদা বৈঠক করছেন। অথচ সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নিতে পারেনি ইসি। নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী কাজ করলে তাদের ভাবমূর্তির পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হতো বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হলে এর দায় এসে সরকারের ঘাড়েও পড়বে। সবাই আঙুল তুলবে সরকারের দিকে। এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে যারা আন্দোলন করে আসছিল তারাও তাদের দাবিকে আরও জোরদার করতে পারবে।


সর্বশেষ ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেছিল বিএনপি। কিন্তু কমিশন বিষয়টি খতিয়ে না দেখে দায়সারা গোছের মনোভাব দেখিয়েছে। এতে কমিশনের ওপর মানুষের আস্থারও চরম সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। পৌর নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে অন্তত ছয় থেকে সাতজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। তবে ১৫ জন সংসদ সদস্য কোনো না কোনোভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন বলে ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এদের অনেকের আত্মীয়স্বজন মেয়র প্রার্থী। ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে তাদের জয়ী হিসেবে দেখতে নানামুখী তোড়জোড় চালানো হচ্ছে।


এ ছাড়া বিভিন্ন পৌরসভায় রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। কর্মকর্তারা নিজেই প্রার্থীর হলফনামার তথ্য ভুল করে দিয়ে টাকার বিনিময়ে মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন। অন্যদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে তিনজন সংসদ সদস্যকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। আরও চার এমপিকে শোকজ করার ফাইল তৈরি করা হচ্ছে। ইসি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের শীর্ষে থাকা সংসদ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা-২০ আসনের এম এ মালেক, নাটোর-২ আসনের শফিকুল ইসলাম শিমুল, বরগুনা-২ আসনের শওকত হাচানুর রহমান রিমন, সিরাজগঞ্জের হাসিবুর রহমান স্বপন, হবিগঞ্জের আবু জাহির ও শরীয়তপুরের নাহিম রাজ্জাক। কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ক্লিপিং দেখে আরও কয়েকজন সংসদ সদস্যের আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার সচিত্র তথ্য রয়েছে কমিশন সচিবালয়ে।


নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক পড়েছে দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিতব্য পৌরসভা নির্বাচনে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে মনোনয়নপত্র জমাদান ও নির্বাচনী প্রচারণায় বিভিন্ন এলাকায় আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ মেয়র প্রার্থীর পক্ষে বিধি লঙ্ঘন করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনী কাজে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে প্রার্থীর পক্ষে কর্মিসভা করারও অভিযোগ রয়েছে ইসিতে। এ ছাড়া নিজ মেয়র প্রার্থীর পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় উপস্থিত থাকার অভিযোগ উঠেছে অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে।


ইসির কর্মকর্তারা জানান, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় ও নির্বাচনী প্রচারণায় যেসব সংসদ সদস্য আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনী এলাকায় গেছেন এবং প্রচারণা চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে যাদের কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে তারা হলেন ঢাকা-২০ আসনের এম এ মালেক, নাটোর-২ আসনের মো. শফিকুল ইসলাম শিমুল ও বরগুনা-২ আসনের শওকত হাচানুর রহমান রিমন। তবে ইসির নোটিশ পেয়েও আচরণবিধি লঙ্ঘন করার অভিযোগ আছে শওকত হাচানুর রহমানের বিরুদ্ধে। কিন্তু দ্বিতীয় দফা নোটিশ করা ছাড়া তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি কমিশন।


আচরণবিধিতে যা আছে


পৌরসভা (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচন-পূর্ব সময়ে নির্বাচনী প্রচারণায় বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, উল্লিখিত ব্যক্তিরা নির্বাচনী এলাকার ভোটার হলে তিনি কেবল তার ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে পারবেন। আচরণবিধি অনুযায়ী সরকারের সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা তাদের সমমর্যাদার কোনো ব্যক্তি, সংসদ সদস্য ও সিটি করপোরেশনের মেয়র বোঝানো হয়েছে।


উপজেলা নির্বাচনে সিইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ


গত উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব অনেকটাই ছিল শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ। তেমন একটা অভিযোগ উঠেনি তৃতীয় দফা। কিন্তু চতুর্থ ও পঞ্চম পর্বে সহিংসতা হয়েছে বেশি। ওই পরিস্থিতিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ ব্যক্তিগত ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। নির্বাচন চলাকালে এর আগে কোনো সিইসিকে ছুটি নিয়ে বিদেশ যেতে দেখা যায়নি। যেমনটা করেছিলেন কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ।


নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা ও সাবেক একজন মন্ত্রীর আচরণে কমিশন রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিল। ওই দুই ব্যক্তি সব সময় ইসির ওপর খবরদারি করতেন। তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই বিদেশ গিয়ে কিছুটা স্বস্তিতে ছিলেন সিইসি। তবে নিজের গা বাঁচাতে সিইসির এমন সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই দায়িত্বশীল আচরণ ছিল না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পৌর নির্বাচনে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা আগামী রাজনীতির গতি-প্রকৃতি অনেকটাই নির্দিষ্ট করবে বলে মনে করছেন তারা।


সৌজন্যে: সাপ্তাহিক এই সময়