logo ২৩ এপ্রিল ২০২৫
চাই গভীরতা সম্পন্ন সাময়িকী
প্রণব সাহা
২৫ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:১৪:১০
image




নতুন দিনের নতুন আশা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন ব্যবস্থাপনা। এমনকি গণমাধ্যমকেও ভাবতে হচ্ছে নতুন করে। যারা ছাপার মাধ্যম অর্থাৎ পত্রিকা করছেন, তারা বাধ্য হচ্ছেন পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে যেতে। এমনকি দেশের অনেক টেলিভিশন চ্যানেলকেও নিজেদের ওয়েবসাইটকেও জোরালো করতে হচ্ছে। কেউ কেউ আলাদা করে জোর দিচ্ছেন অনলাইনের বিষয়টির প্রতি। হাতেগোনা কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ছাড়া দেশে প্রকাশিত বেশিরভাগ পত্রিকার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। সাংবাদিকদের বেতন, কাগজ ও ছাপা খরচসহ সব মিলিয়ে এক কপি (তা ৮ থেকে ২৪ পাতা পর্যন্ত যাই হোক না কেন) পত্রিকার উৎপাদন খরচ কোনোভাবেই তার বিক্রীত মূল্য থেকে উঠে আসা সম্ভব হয় না। নির্ভর করতে হয় বিজ্ঞাপনের ওপর। যত বেশি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে তত সংকুচিত হচ্ছে বিজ্ঞাপনের বাজার। আবার গত পাঁচ বছরে এত বেশি টেলিভিশন চ্যানেল এসেছে এবং আরো আসছে।



 বিজ্ঞাপনের বাজেট থেকে বড় অংশ এখন চলে যাচ্ছে সম্প্রচার মাধ্যমে। ফলে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগুতে হচ্ছে পত্রিকাগুলোকে। আরো শঙ্কার বিষয় হচ্ছে যে, দেশে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ম্যাগাজিনগুলোও আছে একই রকম চাপের মুখে। আগে আমরা ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক পত্রিকাগুলোতে ভোগ্যপণ্য এবং প্রসাধনের বিজ্ঞাপন বেশি দেখতাম। এখন এসব পণ্যের বেশি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে। এত কিছুর পরও দেশে সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এখনো বড় আকারের, ভালো ম্যাগাজিন করার সুযোগ আছে। দৈনিক এবং ২৪ ঘণ্টার টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলের দাপট সত্ত্বেও যে কজন হাতেগোনা সাহসী সাংবাদিক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছেন তারা আমার সঙ্গে একমত। দরকার ভালো উদ্যোক্তা এবং সঠিক পরিকল্পনা। তবে হ্যাঁ হয়ত এর প্রাথমিক উদ্যোগ নিতে হবে কোনো একজন ভালো বিনিয়োগকারীকেই। দেশের অনেক কর্পোরেট বিজনেস হাউস টেলিভিশন চ্যানেলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কেউ কেউ তো পত্রিকা, টেলিভিশন এবং রেডিও পর্যন্ত করছেন।



এই সুযোগে একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতে চাই। ২০০৯ সালে যখন প্রথম আলো ছেড়ে একুশে টেলিভিশনে যোগ দিয়েছিলাম, তখন কালের কণ্ঠে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। বসুন্ধরা গ্রুপের সম্মানিত চেয়ারম্যন আহমেদ আকবর সোবহানের সঙ্গে তার বাসভবনে গিয়ে দেখা করে বিনীতভাবেই আমার অপারগতা জানিয়ে এসেছিলাম। সেদিন বেশকিছু সময় দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলাম যদি কখনো আপনাদের গ্রুপের উদ্যোগে টেলিভিশন চ্যানেল হয় তখন ডাকবেন, কাজ করব। আরো আলোচনা হয়েছিল যে, একটি সম্পাদনা পরিষদ একই সঙ্গে পত্রিকা, টেলিভিশন এবং রেডিও পরিচালনা করতে পারে কি না তা নিয়ে। এখন দেখছি একমাত্র বসুন্ধরা গ্রুপই তা করছে। দুটি বাংলা এবং একটি ইংরেজি দৈনিকের পাশাপাশি এখন এই ব্যবসায়িক গ্রুপই টেলিভিশন ও রেডিও করছে। এরই মধ্যে আমরা দেখছি যে, তাদের টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ ২৪ এর লোকবল নিয়োগ শুরু হয়েছে। হয়ত কিছুদিনের মধ্যে তাদের রেডিও আত্মপ্রকাশ করবে। আমরা শুধু চাইব যে, গণমাধ্যম জগতে পেশাদারিত্ব বজায় রাখা শুধু নয়, তার গুণগত মানোন্নয়নেও যথাযথ ভূমিকা রাখবে দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা বসুন্ধরা গ্রুপ।



বেশ কিছু দিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে সাপ্তাহিক ২০০০। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন একজনের সঙ্গে আলোচনা করে জানলাম পত্রিকাটি এক সময় লাভজনক ছিল। এমনকি বড় অঙ্কের টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়েছিল পত্রিকার আয় থেকে। যদিও ক্রমাগত লোকসানের অভিযোগের দায়েই বন্ধ হয়েছে পত্রিকার প্রকাশনা। যে সব উদ্যোক্তা দেশের সফল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার পরিচালনা করছেন, তারা কেন একটি ভালো সাপ্তাহিকের প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারলন না, সেটাও এক বড় প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার কোনো শিক্ষার্থী কি তার এমফিল থিসিস হিসেবে এ বিষয়ে একটি গবেষণা করতে পারে? অনেকের কাছে বিষয়টি কৌতুকপ্রদ হতে পারে যে, যেখানে দৈনিক পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা, যে অনলাইন আর ওয়েবভার্সনের ধাক্কায় আদৌ প্রতিদিন সকালে ৮/১২/১৬/২৪ পৃষ্ঠার দৈনিক সকালে কেউ পড়বেন কি না, চায়ের কাপে চুমুক দিবেন কি না? সেখানে সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক ম্যাগাজিন আদৌ চলবে কি না? আমার বিশ্বাসটা এমন যে, আন্তরিক উদ্যোগ, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং সত্যিকারের নতুন চিন্তার সাংবাদিকরা মিলে উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের একটি আউটলুক বা ইন্ডিয়া টুডে, ফ্রন্টলাইন বা টাইম ম্যাগাজিনের মতো বড় প্রভাবশালী সাময়িকী প্রকাশ করা সম্ভব।



আমি তো দেখি ঢাকায় এখন রান্নাবিষয়ক বিশেষ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে। ফ্যাশনজগতের অনেক ভালো সাময়িকী প্রকাশ পাচ্ছে। দেশের প্রকাশনা জগতের অনেক আধুনিকায়নও হয়েছে। গত ২৭ বছর সাংবাদিকতায় টিকে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আমার এখনো বিশ্বাস যে, দেশে কোনো এক সময় একটি গুণেমানে ভালো এবং অনুসন্ধানী রিপোর্টিং ও গভীর বিশ্লেষণের একটি প্রভাবশালী সাময়িক বাংলাদেশে হবেই হবে। তবে এই সবই এখন ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর হবে বলেই আমার বিশ্বাস। এখনো আমরা যেভাবে বিশ্বের সব দৈনিক নিজের ল্যাপটপে বা মোবাইল ফোনে পড়ে নিতে পারি, হয়ত সেভাবেই সারা বিশ্বের যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আছে তারাও ঢাকা থেকে প্রকাশিত সবচেয়ে ভালো মানের সাময়িকী পড়ে নিবে, তা তিনি যেখানেই অবস্থান করুক না কেন। কেন আমরা ইকোনোমিস্ট পড়ি। কেন ভারত থেকে প্রকাশিত ইন্ডিয়া টুডেতে সেই দেশের রাজনীতির বিশ্লেষণটাকে আমলে নেই। অথবা বলা যায় যে, ফোবর্সে প্রকাশিত শক্তিমান রাজনীতিকদের খবর কেন আমরা ঢাকার পত্রিকা বা টেলিভিশনে পুনঃপ্রচার হতে দেখি। এখানে মূল হলো বিষয়টা কি, আর অনুসন্ধানটা কত গভীর?



আপাতত আমরা দেশের চলমান বিষয়ে কোনো কোনো জাতীয় দৈনিকের গোলটেবিল আলোচনা বা টিভি চ্যানেলগুলোর টক শোতে নানামুখী আলোচনা পড়ি বা শুনি। কিন্তু আমরা ঢাকার যানজট বা বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখি না। শুধু সমস্যা তুলে ধরা নয়, সমস্যা সমাধানের আলোকপাত করা এবং দীর্ঘদিন একই বিষয়ে চর্চায় মনোনিবেশ করতে পারার মতো মেধাবী সাংবাদিক যে নেই, তা তো নয়। কিন্তু আগ্রহী এবং যোগ্য ব্যক্তিকে তেমন সুযোগ দেওয়ার মতো সংবাদ প্রতিষ্ঠানের অভাব অনুভূত হয় প্রায়ই। নিজে এক দশক কাজ করেছি প্রথম আলোতে। সেখানে প্রতিরক্ষাবিষয়ক রিপোর্টিং করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সম্পাদক মতিউর রহমান নিজেই। এখন বলাই যায় যে, সিনিয়র রিপোর্টার থেকে বিশেষ সংবাদদাতার পদে পদোন্নতি পাওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছিল সেই সময়। প্রধান প্রতিবেদকের পদ ছেড়ে প্রায় এক বছর প্রতিরক্ষা বিষয়ে বেশকিছু প্রধান শিরোনামের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পরই প্রথম আলোতে আমি বিশেষ সংবাদদাতা পদে পদোন্নতি পেয়েছিলাম। তারপরও আমাকে প্রধান প্রতিবেদকের মতো ‘ধন্যবাদহীন’ দায়িত্বটি আবারো করতে হয়েছিল। সে আরেক প্রসঙ্গ।



আমরা এখন সম্প্রচার সাংবাদিকতার রমরমা অবস্থায় আছি। ২৪টি টেলিভিশন চ্যানেল থাকার পরও অনেকেই উদ্যোগ নিচ্ছেন নতুন নতুন চ্যানেল করার। তাতে অন্য আরো কিছুর সঙ্গে সাংবাদিকদের পেশার বিস্তৃতি ঘটছে। যদিও গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তারপরও আমি একটি গভীরতা সম্পন্ন সাময়িকীর অভাব অনুভব করি। তথ্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ধারায় আমরা এগিয়ে চলছি। তাহলে কেন সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীর কাছে জনপ্রিয় কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ ও সানন্দার প্রতিদ্বন্দ্বী সাময়িকী ঢাকা থেকে প্রকাশিত হবে না?



লেখক : সাংবাদিক