আজ ৩ মে সারা বিশ্বে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালিত হচ্ছে। এদিকে সারা বিশ্বেই গণমাধ্যমের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে। আর যেসব দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে, এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে একই কথা- মুক্ত গণমাধ্যম।
আজ সারাবিশ্বে যখন গণমাধ্যম ‘স্বাধীন’ ‘স্বাধীন’ বলে চিৎকার করা হচ্ছে, তখন গণমাধ্যমের বেহাল দশা দেখে খুব কষ্ট হয়। জানতে ইচ্ছে করে গণমাধ্যমের কেন এই বেহাল দশা? নিজের বিবেকের কাছে বারবার পরাস্ত হয় গণমাধ্যম শব্দটি। আসলে কি গণমাধ্যম স্বাধীন? গণমাধ্যম কি স্বাধীনভাবে তার কাজ করতে পারছে? কারো কাছে এই প্রশ্নের কি কোনো সদুত্তর আছে?
সাম্প্রতিককালে ‘গণমাধ্যম’ শব্দটি বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। ইংরেজি ‘মিডিয়া’কথাটি আমাদের পূর্ব পরিচিত। এক সময় ‘সংবাদপত্র’ই ছিল গণযোগাযোগের একটি মাধ্যম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আর ‘প্রিন্ট মিডিয়া’ বা কাগজে ছাপা সংবাদপত্রই গণযোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নয়। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট এমনকি কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহৃত হাতের সেলফোনটিও এখন গণযোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ তথা আমাদের দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর কমবেশি সবারই দৃষ্টি এখন গণমাধ্যমের দিকে। সেটি টেলিভিশন, রেডিও, দৈনিক পত্রিকা কিংবা অনলাইন পত্রিকা হোক না কেন।
এদিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, বাংলাদেশে ৪৪টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম, ৩২টি কমিউনিটি রেডিও, ১১৮৭টি দৈনিক পত্রিকা ও ১০০টিরও বেশিও অনলাইন পত্রিকার অনুমোদন রয়েছে। আর ৩০টির মতো টেলিভিশন বর্তমানে সম্প্রচার কার্যক্রমে রয়েছে।
এবার আসি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে, গণমাধ্যমে চাকরি যেন সোনার হরিণ। বহুল প্রচলিত একটি শব্দ, গণমাধ্যমে চাকরি হয় নিজের যোগ্যতায়। এই কথাটি এক সময় সত্য ছিল। কিন্তু এখন এই কথাটি বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে যোগ্যতায় নয়, গণমাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কোনো পরিচিত ব্যক্তির সুপারিশে এখন চাকরি হয়। কাজ জানা কিংবা না জানা সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা গণমাধ্যমে পরিচিত কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছে কি না। যদি না থাকে তাহলে যতই অভিজ্ঞতার পরশ হক না কেন তাদের জন্য গণমাধ্যম নয়। তাহলে গণমাধ্যম কাদের জন্য? উত্তরটা এমন, গণমাধ্যম হলো সুপারিশওয়ালাদের জন্য।
গণমাধ্যমকে চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। গণমাধ্যমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের একটি সার্বিক চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ইলেকট্রনিক ও মুদ্রণ মাধ্যম এ দুই ধরনের গণমাধ্যম বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চালু আছে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বিগত নব্বই দশকের গোড়া থেকে আমাদের দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে এর পরিসর। একসময় ক্যাবল বিটিভি ও দু-একটি পত্রিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল গণমাধ্যম।
গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিবাদী হবে, লড়াকু হবে, আপসহীন হবে- এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু তা যদি গড্ডলিকা প্রবাহ হয় অথবা একটু নম্র করে বলতে গেলে বলতে হয়, দালালি বা ভাঁড়ামি হয় তাহলে সেটা কি গণমাধ্যমের পর্যায়ে পড়ে। হয়ত এটি ভাবার মতো এখন কারো সময় নেই।
বর্তমানে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ আর কড়াকড়ির বেড়াজালে আবদ্ধ। মন খুলে, স্বাধীন ও নির্ভয়ে প্রকাশের পরিবেশ অনুপস্থিত। এরপরও গণমাধ্যম থেমে নেই তার অসঙ্কোচ প্রকাশের পথচলায়। যদিও বিভিন্ন সময় অদৃশ্য কোনো কালো পর্দায় ঢাকা পড়ে গণমাধ্যমের খোলা জানালা।
আমাদের দেশে গণমাধ্যমকর্মী ও সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে। এদিকেগণমাধ্যমের কণ্ঠ স্বাধীন রাখার প্রয়াসে প্রতিবছর প্রাণ হারাচ্ছেন অনেক সাংবাদিক। তারা বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হচ্ছেন এবং কারাভোগ করছেন। তারপরও পেশাগত দায়বদ্ধতার কথা স্মরণে রেখে সত্য উদঘাটন ও প্রকাশ করার তাগিদে পা ফেলেন তারা।
কিন্তু গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও গণমাধ্যম নেতাদের কি উচিত নয়, পাঠক ও দর্শকদের আস্থা অর্জন করা। সঠিক ও নিরপেক্ষ তথ্য প্রকাশে দৃঢ় থাকা উচিত। সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে যা আরও শক্তিশালী হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠিন ঐক্য থাকতে হবে। মতভিন্নতাকে দূরে ঠেলে এগিয়ে যেতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতা ও বিভিন্ন কারণে যেসব গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে সেগুলো আবার চালুর ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, আমাদের সমাজে এক শ্রেণির সুবিধাবাদী গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের আখের গোছানোর জন্য তেলবাজিতে মত্ত থাকেন। আমার মনে হয় তারা হয়ত ভুলেই গিয়েছেন, তারাও একসময় রাস্তার সাংবাদিক ছিলেন। কেননা সাংবাদিকতার শুরু তো রাস্তা থেকেই হয়।
আমরা গণঅধিকারের দাবিতে সোচ্চার হই, কিন্তু গণঅধিকারের রক্ষাকবচ যে গণমাধ্যম তথা সংবাদমাধ্যম, তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কুণ্ঠাবোধ করি। সাংবাদিকদের যথার্থ মর্যাদা দেয়ার পাঠ এখনো আমরা গ্রহণ করিনি, এমনকি করার ইচ্ছাও নেই। অগণতান্ত্রিক পর্যায় থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণে অবাধ তথ্যপ্রবাহের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হই বরাবরই। নিজেদের সঙ্কীর্ণতাকে ঢেকে রাখতে ভালোবাসি বলেই যারা সত্য প্রকাশে উদ্যোগী, তাদের নাস্তানাবুদ করতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করি না আমরা।
গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালনে অটল থাকবে, ঐক্যবদ্ধ থাকবে সাংবাদিক সমাজ, বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন রোধে ভূমিকা রাখবে এটিই তো ব্রত হওয়া উচিত কিন্তু প্রেক্ষাপটে চিত্র তার ভিন্ন। কোনো কারণে গণমাধ্যমের চলার পথ রুদ্ধ হোক, খর্ব হোক স্বাধীনতা এটি আমরা চাই না।
গণমাধ্যম কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। এটিকে সমাজে শোষিত, বঞ্চিত আর নিপীড়িত গণমানুষের পক্ষে থাকা উচিত। কিন্তু আসলে কি গণমাধ্যম এখন শোষিত, বঞ্চিত আর নিপীড়িত গণমানুষের কথা বলছে? যে গণমাধ্যম সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে আর সেই গণমাধ্যম আজ তোষামোদি বা তেলবাজিতে মত্ত। মনে রাখা জরুরি গণমাধ্যমের দায়িত্ব ব্যালান্স করা নয়। সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরাই গণামাধ্যমের কাজ।
তাই আজ একটি কথা বলতে বড়ই ইচ্ছা করছে, গণমাধ্যম হোক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। গণমাধ্যম হোক সবার জন্য। মূল্যায়ন হোক অভিজ্ঞতার। একই হাতে হাত রেখে কাজ করার সুযোগ হোক সবার।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।