একজোড়া সিপাহী বুলবুল আসে প্রতিদিন ভোরে। উঠোনে একটা ডালিম গাছ। সাথে একটা বড়সড় বেলিফুল গাছ। গাছটা পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছে ডালিম গাছের সাথে। তার পাশে একটা গোলাপ গাছ। সব মিলিয়ে বেশ ঝোপ-ঝাড় বলা চলে। পাখি দুটো ডালিম গাছে বসে। কিচকিচ করে ডাকে। ইতিউতি করে তাকায় এদিক-সেদিক। আসলে পর্যবেক্ষণ করে। সিপাহীদের প্রজনন ঋতু। বুঝতে অসুবিধা হয় না ওরা বাসা করবে।
অনুমান ঠিক। কিছুদিন পর খড়–কুটো মুখে নিয়ে এসে বসে ডালিম গাছে। তারপর বেলি ঝোপের ভেতর ঢুকে যায়। বাইরে থেকে দেখা যায় না বললেই চলে। কয়েকদিন ধরে চলে বাসা বানানো। একবারে শিল্পীর কারুকাজ। ছোট্ট বাটির মতো বাসা। এমন জায়গায় বসানো হয়েছে, পোষা বিড়ালের চোখে পড়বে না। যদি পড়েও তবে গোলাপ আর ডালিমের কাঁটার খোঁচা হজম করে বাসা পর্যন্ত পৌছানোর ক্ষমতা হবে না। ওই ঝোপের ভেতরে দৃষ্টি যাবে না কাক-চিলেরও।
সিপাহী বুলবুল বুলবুলি প্রজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। ২০ সেন্টিমিটার লম্বা আর ২৮ গ্রাম ওজনের ছোট্ট পাখি। পেট, বুক আর গলা সাদা। পিঠ বাদামি রঙের। কানের নিচে টকটকে লাল পট্টি সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। মাথায় কালো ঝুঁটি। ঝুঁটি ফুলিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে থাকে গাছের ডালে কিংবা বিদ্যুতের তারে। তখন দেখলেই যেন সৈনিক সৈনিক মনে হয়। একারণেই এর নাম সিপাহী বুলবুল।
সাধারণত মাঠেই থাকে বেশি। জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। কখনো কখনো দলবেঁধে পাটক্ষেতে অভিযান চালায়। পেট ভরায় পাটের পোকা খেয়ে। পাটেরও উপকার, উপকার চাষিরও। পাখিতে পোকা খেয়ে সাবাড় না করলে শুধু কীটনাশকে ফসলের পোকাদমন কখনোই সম্ভব নয়। তবে এরা শুধু পোকাই খায় না। পিঁপড়া, মাকড়সা, ফুলের কুড়ি, ফুল, ফুলের রস, ছোট-বড় পাকা ফলও রয়েছে এদের খাদ্য তালিকায়।
মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এদের প্রজনন ঋতু। এসময় এরা ঝোপের ভেতর বাসা বাঁধে। শুকনো পাতা, গাছের শিকড়, মানুষের মাথার পরিত্যাক্ত চুল একসাথে জড়িয়ে বাসা বোনে। ছোট্ট বাসায় ৩টি ডিম পাড়ে। ১২-১৫ দিনে ডিম ফুটে ছানা বের হয়।
মাঠে ডিম আর ছানা শিকারী পাখির অভাব নেই। হাঁড়িচাঁছা, কানাকুয়া, লাটারোদের মতো শিকারী পাখি সুযোগ পেলেই সিপাহীর বাসায় হানা দেয়। চুরি খায় ডিম আর ছানা। তবে সিপাহীও কম চতুর নয়। বাসা বানায় বেছে বেছে ঝোপের ভেতরে। বাসা করে কাটাভরা কুলগাছেও। বেশি অসুবিধা হলে চলে আসে লোকালয়ে। বাড়ির উঠোনে ফুলবাগানে বাসা করে। শিকারী পাখিদের থেকে একদম নিরাপদ এইসব ফুলবাগানে।
সিপাহী বুলবুল ভীষণ সাহসী পাখি। যুদ্ধটা শিকারী পাখির বিরুদ্ধে। হাঁড়িচাঁছা বা কানাকুয়া বাসার আশপাশে তেড়ে যায়। শক্তি আকার যাইহোক লড়াই করতে পরোয়া করে না। বেশিরভাগ যুদ্ধেই তারা জেতে। আশপাশের অন্য পাখিরাও তখন ওদের দেখে সাহস পায়। একজোট হয়ে লড়ে যায় বড় বড় শিকারীদের বিরুদ্ধে। এমনকি মানুষকেও পরোয়া করে না সিপাহী বুলবুল। কোনো দুষ্টু ছেল অতি উৎসাহী হয়ে বাসার কাছে ভিড়লে আর রক্ষা নেই। চিৎকার করে, দরকার হলে ঠুকরে তাকে তাড়িয়ে ছাড়ে।
ডিম ফুটে ছানা বের হয়। তারপর দুই সপ্তাহ নিবিড় পরিচর্যা। এরপর ছানার গায়ে পালক গজায়, ঝুঁটিও বেশ বড় হয়। কিন্তু লেজটা তখনো বড় হয়নি। বাবা-মায়েরা কীভাবে জানি বুঝে যায়, ছানারা উড়তে পারবে।
আবার ফিরে যায়, বেলিফুল গাছের সেই পাখিদুটো বাসায়। ছানারা বড় হয়েছে। উড়তেও পারবে নিশ্চিত। তবে ডিম তিনটি পাড়লেও একটা নষ্ট হয়ে গেছে। রয়েছে দুটো ছানা। বেশ আদুরে একটা ভাব চেহারায়। বাব-মা পাখি দুটো ছানাদের নিয়ে উড়াল দেয়। প্রথমদিনেই বেশিদূর যেতে পারবে না। তাই ছানাদের নিয়ে যায় একটা ঘন কাঁটাওয়ালা কুলগাছে। পাতার ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রাখে কয়েক ঘণ্টা। পোকা ধরে এনে খাওয়ায়। তারপর আবার উড়াল দেয়। এবার আর কাছে নয়, দূরে বহুদূরের গন্তব্যে।