বিংশ্ব শতাব্দী বিজ্ঞানের ইতিহাসে দারুণ সব আবিষ্কারের দরুন যেমন অক্ষয় হয়ে থাকবে, তেমনি বড় বড় বেশ কিছ যুদ্ধ এর ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে রাখবে। বিশেষ করে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং হিরোসিমা-নাগাসাকি ট্রাজেডির কথা মহাকাল ভুলবে কখনো? বিশ্ব রাজনীতিকে এই ট্রাজেডির নায়ক আর ভিলেনই সবচেয়ে নিকৃষ্ট অবদান কিন্তু বিজ্ঞানেরই।
বিজ্ঞানের সবচেয়ে শক্তিশালী সন্তান নিউক্লিয়ার বোমা আবির্ভূত হয়েছে পৃথিবীর ভিলেন হিসেবেই। যেকোনো আবিষ্কারের একটা মহৎ উদ্দেশ্য থাকে, কিন্তু পারমাণবিক বোমা তৈরির পেছনে কি আদৌ কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছিল।
১৯৩৭ সাল। ইউরোপজুড়ে চলছে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। ইউরোপের বাইরের দেশগুলোও তখন নাৎসি আক্রমণের ভয়ে তটস্থ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। ওদিকে হিটলারের সাথে হাত মিলেয়েছে আরেক পরাশক্তি জাপান। সে বছর ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের কাছে একটা চিঠি আসে আমেরিকার বড় বড় বিজ্ঞানীদের তরফ থেকে। মূলত সেটা একটা প্রস্তাবপত্র।
সাধারণ জনগণের মতো বিজ্ঞানিরাও নাৎসি আক্রমণের আশঙ্কা করছেন। তাদের ধারণা হিটলারের অনুগত বিজ্ঞানীরা এতোদিনে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করতে বসে গেছে। হিটলারকে ঠেকানোর একটাই উপায় হিটলারের আগেই আমেরিকার নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করা। তাই তারা ম্যানহাটন প্রজেক্ট নামে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির একটা বৃহৎ কর্সসূচিতে হাত দিতে চান। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের অনুমতি ও বিপুল পরিমাণ অর্থ দুটোরই প্রয়োজন। রুজভেল্ট সেই প্রস্তাবে রাজি হতেন কিনা কে জানে পত্রের শেষে প্রস্তাবকারীদের নামের জায়গায় আলবার্ট আনস্টাইন ও ওপেনহাইমারের দস্তখত দেখে তিনি আর দ্বিধা করেননি। শুরু হলো ম্যানহাটন প্রজেক্টের যাত্রা।
অনেকে হয়তো ভ্রুকুঁচকে বলবেন নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির মতো অমানবিক একটা কাজে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ আইনস্টাইন কীভাবে নিজেকে জড়ালেন? আসলে আইনস্টাইন নিজেকে জড়াতে চাননি। সত্যি কথা বলতে কী আইনস্টাইন বিশ্বাসই করতেন না তার ই=এমসি২ সূত্রটি পরীক্ষাগারে প্রমাণ করা সম্ভব আর সেটা দিয়ে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব হবে। ওপেনহাইমার তাকে পুরো প্রক্রিয়াটা বুঝিয়ে বললেন। ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা নিয়ে তিনি আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। শুধু তাই নয়, তিনি রুজভেল্টের কাছে পাঠানো প্রস্তাবপত্রে সাক্ষর করতেও প্রথমে রাজী হননি। ওপেনহাইমারসহ বেশ কজন বিজ্ঞানী তাকে হিটলারকে রুখে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বুঝালেন, আমেরিকা না করলেও হিটলারের বিজ্ঞানীরা এতোদিনে হয়তো সেটা তৈরি করতে আদাজল খেয়ে নেসে গেছে। তাদের প্রতিহত করার একটাই উপায়; আমেরিকারও নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করা। অবশেষে আইনস্টাইন প্রস্তাব পত্রে সই করতে রাজি হলেন, তবে একটা শর্ত আদায় করে নিতে হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে, নিউক্লিার বোমা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমেরিকা নিজে থেকে নিউক্লিয়ার বোমা ব্যাবহার করতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আইনস্টাইনের সে প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন।
কিন্তু যখন হিরোসিমা নাগাসাকিতে বোমা ফেলা হয়, ততোদিনে রুজভেল্ট এই রুজভেল্ট এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আমেরিকার মসনদে তখন হ্যারি এস ট্রুম্যান। আইনস্টাইনের শর্তকে মর্যাদা দেখানোর প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। আমেরিকার সেনারা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমাতে এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে। নরকের ভয়বাহতা টের পায় পৃথিবীর মানুষ।