ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজধানীর মিরপুর পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরিতে। নিরীহ বাঙালি নারী-পুরুষ ও শিশুদের ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হতো মিরপুরের জল্লাদখানায়। এ থেকে বাদ যাননি দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবীরাও। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা এসব হত্যাকা- চালাত। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদের মূল নায়ক ছিলেন জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা। গত ১২ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি দেয়া হয় তাকে।
স্বাধীনতার পর মিরপুর এলাকায় ২৩টি বধ্যভূমির খোঁজ মিলেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এর মধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে মাত্র তিনটি। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, মিরপুরে হত্যা করা হয়েছে- সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, আবু তালেব, কবি মেহেরুন্নেসা, ড. সিরাজুল হক, সন্তোষ ভট্টাচার্য্য, ড. ফয়জুল্লাহ, ডা. মুর্তজা, ড. এমএ খয়ের, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, প্রকৌশলী আবু সালেহ, মোহাম্মদ এরশাদুল্লাহ প্রমুখকে। পরবর্তী সময়ে মিরপুর পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয় ’৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি।
স্থানীয়রা বলছেন, মিরপুরে এখনও অনেক বধ্যভূমি আছে যেগুলো শনাক্ত করা যায়নি। এ ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। কেবলমাত্র জল্লাদখানা বধ্যভূমি ছাড়া কোনটিই সংরক্ষিত হয়নি। এটি সংরক্ষিত করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। মিরপুরের নূরী মসজিদের একটি কূপে দেড়শ’ মানুষের মাথার খুলি পাওয়ার পরও বধ্যভূমি হিসেবে তা সংরক্ষিত করা যায়নি।
বধ্যভূমি সংরক্ষণ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য তারেক আলী বলেন, ‘আমার জানা মতে ’৯৯ সালে মিরপুরের জল্লাদখানা সংরক্ষণের পর আর কোনো বধ্যভূমি সংরক্ষিত হয়নি।’ নিজ নিজ এলাকার বধ্যভূমিগুলো যদি প্রাথমিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তারপর সরকার নিশ্চয় তা সংরক্ষণে এগিয়ে আসবে।
’৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয়ের চারদিন পর ‘দৈনিক বাংলা’র ২০ ডিসেম্বর সংখ্যায় লেখা হয়, জামায়াতে ইসলামীর বর্বর বাহিনী আল-বদরের নিষ্ঠুরতম অভিযানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের লাশ শনাক্তহীন অবস্থায় বধ্যভূমিতে পড়ে রয়েছে। এসব লাশ শনাক্তের অযোগ্য। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মারক চিহ্ন বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হলে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা কত ভয়াবহ ছিল তা মানুষ অনুভব করতে পারবে।’
জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠে গেলে জানা যাবে অন্য বধ্যভূমির নাম। ১৯৯৯ সালের কথা। একটি পাম্প হাউজের ত্রিশ ফুট গভীর কূপ থেকে উদ্ধার করা হয় ৭০টি মাথার খুলি। পাঁচ হাজার ৩৯২টি অস্থিখ- ও শহীদদের ব্যবহৃত সামগ্রী। এ পাম্প হাউজটি এখন বধ্যভূমির অংশ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ করেছে মিরপুর দশ নম্বর সেকশনের এ জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠটি। এটি ২০০৭ সালের ২১ জুন উদ্বোধন করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসররা এখানে ২০ হাজারের বেশি বাঙালিকে হত্যা করেছে। এখানে শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বধ্যভূমির নাম। এ ছাড়া এখানে বিশ শতকের জঘন্য কয়েকটি গণহত্যার ঘটনার নাম ও নিহতদের সংখ্যা উল্লেখ রয়েছে।
মিরপুর মুসলিম বাজার বধ্যভূমি হয়ে রইলো পরিত্যক্ত। ’৯১ সালে মিরপুর ১২নং সেকশনের মুসলিম বাজারের নূরী মসজিদে চলছিল সংস্কার কাজ। ওই বছরের ২৭ জুলাই এ মসজিদের একটি পরিত্যক্ত কূপ থেকে বের করা হয় দেড়শ’ মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড়, শিশুর জামা, জুতা, বাঙালি সেনাদের পোশাক। বিভিন্ন জটিলতার কারণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এখানে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারেনি। তবে নূরী মসজিদের নাম রাখা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মসজিদ’। কূপটি মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ সরকারি নথিপত্রে বধ্যভূমিটি সংরক্ষিত। বর্তমানে এখানে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনার মধ্যে রয়েছে শৌচাগার।
মুসলিম বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিমসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধার হাড়-পাঁজর ও মাথার খুলি। মিরপুরের দুটি বধ্যভূমিতে প্রাপ্ত নিহতদের পাঁচ হাজার ৩৯২টি হাড়গোড় ও ৭০টি মাথার খুলি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা হয়েছে।
মুসলিম বাজার বধ্যভূমির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ওয়ার অ্যান্ড ক্রাইমস প্রধান ড. হাসান বলেন, ‘একটি বধ্যভূমিতে টয়লেটসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ জাতির জন্য অপমানজনক। আর কতদিন আমাদের এসব সহ্য করতে হবে জানি না।’
মিরপুরে আরও রয়েছে হরিরামপুর, কালাপানি, রাইনখোলা, সারেংবাড়ি, আদাবর গ্রাম, শিরনির টেক, অলোকদি, শিয়ালবাড়ি ও গোলার টেক বধ্যভূমি।
মিরপুরের রাইনখোলা বধ্যভূমি ’৭১ সালে ছিল একটি স্যুয়ারেজ রিজারভার। এখানেই ফেলা হতো লাশ। ’৯৩ সালে এখান থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচশ’ মাথার খুলি, হাড়গোড়, গুলির খোসা, জুতা, চশমা, হাতের বালা, চুল ও কঙ্কাল। প্রাপ্ত হাড়গুলো ছিল ছোট ছোট। বোঝা যায় টুকরো টুকরো করে কাটা হয়েছে।
’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মিরপুর ১নং সারেংবাড়িতে এনে হত্যা করেছে অনেক লোককে। সে সময় জঙ্গলঘেরা এ এলাকায় ছিল দুটি কূপ। এখানকার একটি নালার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল পাশের তুরাগ নদীর। এখানকার বাসিন্দা আজিজ শেখ বলেন, কত যে লোক এখানে মারা হয়েছে, তার ঠিক নেই। এখন সেসব বধ্যভূমির ওপরই গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি।
(ঢাকাটাইমস/ ১৫ ডিসেম্বর/ এইচএফ/ ১৪.২১ঘ.)