গত ছয় বছর ধরেই রাজধানীর মালিবাগ এলাকার ফুটপাতের টং দোকানে চা বিক্রি করছেন ৫৫ বছর বয়সী আবদুল হালিম (ছদ্মনাম)। হরতাল-অবরোধে বেচাকেনা কম থাকলেও নিস্তার মেলে না দৈনিক চাঁদা থেকে।
: ‘কত টাকা দিতে হয়?’
: ‘দিনে ৫০ টেকা।’
মালিবাগ এলাকার ফুটপাতে যতগুলো দোকান আছে সবাইকে টাকা গুনতে হয়। টাকা না দিলে পুলিশ দোকান উঠিয়ে দেয়।
আবদুল হালিমের কাছে জানতে চাইলাম ‘টাকা কি পুলিশ এসে নিয়ে যায়?’
জবাব এলো, ‘পুলিশ টেকা নিতে আসে না। লাইনম্যান আছে, হের কাছে দিয়া দেই। আর রাতে এসে তার কাছ থেকে পুলিশ টেকা নিয়া যায়।’
: টাকা না দিলে কোনো সমস্যা হয় কি?
: ‘হ, দোকান উডাইয়া দেয়। আর পুলিশকে টেকা না দিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা করার কথা চিন্তা করা যায় না।’
: ‘কি করুম ভাই, গরিব মানুষ, বইতে অইবো, নইলে পেডে ভাত থাকবে না’Ñবলছিলেন আবদুল হালিম।
কেবল মালিবাগ নয়, রাজধানীর এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করতে পারে হকাররা। শীত, গ্রীষ্ম, রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, সরকারি কর্মদিবস বা ছুটির দিন, হরতাল, অবরোধ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি যাই থাকুক না কেন, মুক্তি মেলে না এই চাঁদা থেকে।
‘যেদিন বেচাকেনা ভালো সেদিন ট্যাকা দিতে গায়ে লাগে না, কিন্তু এই যে এক মাস ধইরা হরতাল-অবরোধের লাইগ্যা বেচাকেনা কম, তাও তো দিতে হয় টেকা। মাপ দেয় না একদিনও’-বলছিলেন কাশেম নামে এক ফল বিক্রেতা।
ফুটপাতের এই চাঁদাবাজি নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এ সমস্যাটির সমাধান হয় না। অভিযোগ আছে, পুলিশ যেহেতু টাকা তোলে, তাই অবৈধ সত্ত্বেও পথচারীদের হাঁটার জায়গা দখল করে পণ্যের পসরা নিয়ে বসে দোকানিরা। মাঝেমধ্যে ঘোষণা দিয়ে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালানো হলেও কিছুদিন পর একই এলাকায় বসে একই হকার। আর চাঁদাবাজি জিইয়ে রাখার সুযোগ করে দিতেই হকার পুনর্বাসনের উদ্যোগ বছরের পর বছর ধরে আলোর মুখ দেখে না বলেও অভিযোগ আছে।
হকারদের হিসাবে বছরে রাজধানীতে ফুটপাত থেকেই চাঁদাবাজি হয় হাজার কোটি টাকা, এর দুই-তৃতীয়াংশই যায় পুলিশের পকেটে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশÑটিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পুলিশ যেটা করছে সেটা অপরাধ। আমাদের গবেষণা বলছে, চাঁদাবাজির এই টাকা ভাগ হয় পুলিশের একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের সদস্য থেকে শুরু করে বড় কর্মকর্তাদের মধ্যেও। তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে শোনা যায়, ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করছে পুলিশ। কিন্তু সেটা আইনের প্রয়োগের কারণে নয়। তাদের চাঁদা না দেওয়ার জন্যই এই কাজটি করে।’
হকারদের সংগঠন বাংলাদেশ হকার্স সমিতির সভাপতি এম এ কাশেম বলেন, ‘ফুটপাতে চাঁদাবাজি এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়। যে দল ক্ষমতায় আসে সে দলের কিছু নেতাকর্মী এগুলো করে। আমরা এগুলো মেনেই ব্যবসা করি। আর যে টাকা চাঁদা হিসেবে দেই তা ক্রেতাদের কাছ থেকেই তুলতে হয়। পাঁচ টাকার জিনিস সাত টাকায় বেচতে হয় এ কারণে।’
চোখের সামনে চলা এই চাঁদাবাজির কিছুই স্বীকার করতে চায় না পুলিশ। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেনি কেউ। কেউ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে তদন্ত করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেব।’
একেক হকারের জন্য একেক চাঁদা
গুলিস্তানে একেক ধরনের ব্যবসায়ীর জন্য চাঁদার হার আলাদা করা আছে। যারা শরবত বিক্রি করে তাদের দিতে হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা, ডিম বিক্রেতাদের গুনতে হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকা, যারা জামা-কাপড়ের দোকান দেয় তাদের দিতে হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। কাকরাইলে হকারদের টাকা দিতে হয় দিনে দুই বেলা। এক বেলায় ৮০ টাকা করে।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা কয়েক হাজার। এগুলো থেকে দিনে কয়েক কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয় বলে অভিযোগ করেছেন হকার নেতারা। হকাররা জানায়, কেবল পুলিশকে নয়, চাঁদা দিতে হয় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা ও মাস্তানদের। টাকা নেয় সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, নেয় সরকারসমর্থক হকার সমিতিও। এভাবে চাঁদার কারণে প্রভাব পড়ে পণ্যমূল্যে।
একজন হকার বলেন, ‘চান্দা দিতে না অইলে আরও কম দামে জিনিস বেচতে পারতাম।’
সূত্র জানায়, ফুটপাতের চাঁদা আদায়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচশ লাইনম্যান কাজ করে। স্বাভাবিক সময়ে ফুটপাতে আড়াই লাখের মতো হকার থাকে। কিন্তু রমজানে ও ঈদ মৌসুমে হকার আরও বেড়ে যায়। এরা বিভিন্নভাবে প্রতিদিনই বিভিন্ন অঙ্কের চাঁদা দিতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিক সময়ে যেহারে চাঁদা নেয়, রোজার সময় দিতে হয় আরও বেশি। ঈদের আগে কাপড়ের দোকানিদের চাঁদা বাড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
মাসে চাঁদা ওঠে শত কোটি টাকার বেশি
হকার সমিতির হিসাবে রাজধানীর ফুটপাত ও মার্কেটগুলোতে প্রতিদিন সাড়ে চার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। কোনো হকার টাকা না দিতে পারলে পরদিন তার বসার জায়গা মৌসুমি হকারদের কাছে বেশি টাকার বিনিময়ে ভাড়া দেওয়া হয়।
হকাররা জানান, পুলিশের কাছে ফুটপাতের কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে তারা এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করে না, কারণ পুলিশ নিজেই জড়িত এর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন হকার জানান, তিনি অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার পর নেতাদের সঙ্গে আপস করে ব্যবসা করতে পরামর্শ দেন এক কর্মকর্তা।
হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাশেম বলেন, ‘ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়মিত ঘটনা। তার মতে, বছরে হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে ফুটপাত থেকে। এই হকার নেতা বলেন, ‘পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ সম্ভব নয়। তবে সরকার অবৈধ এই চাঁদাবাজি বন্ধ করে হকারদের কাছ থেকে ফুটপাতের খাজনা আদায় করতে পারে।’ হকাররা সরকারকে রাজস্ব দিতে আগ্রহী বলে জানান তিনি।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মিয়া বলেন, ফুটপাত থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ অভিযান চলমান রয়েছে। কিন্তু আমরা অভিযান চালিয়ে চলে আসার পর আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ফুটপাত থেকে পুলিশের চাঁদাবাজি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের রমনা অঞ্চলের ডিসি আবদুল বাতেন বলেন, ‘আমার কাছে এই বিষয়টি জানা নেই। আপনার কাছে জানা থাকলে আপনি নিউজ করে দেন।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা অস্বীকার করলেও ফার্মগেট, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা কলেজ, কলাবাগান, গ্রিন রোড, মিরপুর, পল্লবী, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, কাপ্তান বাজার, সদরঘাট, মহাখালী, উত্তরখান, দক্ষিণখান, মালিবাগ, মগবাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় টানা সাতদিন ঘুরে দেখা গেছে ফুটপাতে এবং মার্কেটে চাঁদাবাজির চিত্র।
ফার্মগেটের পশ্চিম পাশে রাজাবাজার গলি থেকে শুরু করে এমার গলি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার শতাধিক হকার ফুটপাতে এবং রাস্তার পাশে বিভিন্ন রকমের পসরা নিয়ে বসেছে। ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের সামনে বেল্ট-মানিব্যাগ বিক্রি করছিল হানিফ। কিছুক্ষণ পরে মোটাসোটা এক লোক আসলেন এবং ৭০ টাকা নিয়ে চলে গেলেন। তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি হানিফকে দেখিয়ে চলে গেলেন। হানিফ জানায়, ‘এই লোকের নাম মোক্তার। তিনি পুলিশের সোর্স।’
ফার্মগেট পূর্ব পাশ। তেজগাঁও রেলগেট থেকে ফার্মগেট ফুটওভারব্রিজ পর্যন্ত তিন শতাধিক হকার রয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিন হকারপ্রতি ২৪০ টাকা চাঁদা তোলেন লাইনম্যান শফিক। তেজতুরীবাজার স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতার নামেই এই টাকা তোলা হয় বলে জানিয়েছেন হকাররা।
নিউমার্কেটের পূর্বপাশ নীলক্ষেত মোড় থেকে নিউ এলিফ্যান্ট রোড ট্রাফিক সিগন্যাল পর্যন্ত ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন চার লাইনম্যান এবং এক সোর্স। এদের মধ্যে আমজাদ এবং মিলন নামে দুইজন টাকা তোলেন হকার সমিতির নামে। তারা নেন হকারপ্রতি ৩০০ টাকা। নিউমার্কেট থানার সোর্স পরিচয়ধারী মহসিন একই হকারের কাছ থেকে নেন ৬০ টাকা করে।
ভাগাভাগি হয় চাঁদার টাকা
নিউমার্কেট এলাকার পশ্চিম পাশের ফুটপাতের চাঁদা চার ভাগে ভাগ হয় বলে লাইনম্যানরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে স্থানীয় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ, মার্কেট সমিতির নেতা, পুলিশ এবং হকার সমিতির নেতারা এর ভাগ পায় বলে জানা গেছে।
মিরপুর এক নম্বরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট এলাকার হকারদের চাঁদা তোলেন কবির নামে এক লাইনম্যান। তিনি মাঝেমধ্যে পুলিশের হয়েও চাঁদা তোলেন। অন্যদিকে শাহআলী মার্কেটের হকারের চাঁদা কালেকশন করেন আবুল হোসেন কালু। তিনি পুলিশের সোর্স হিসেবে সবার পরিচিত।
পল্লবী মোল্লা সুপার মার্কেটের হকারদের কাছ থেকে প্রতিদিন সরোয়ার নামে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির সহযোগী চাঁদা আদায় করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পূরবী সুপার মার্কেটের সামনে থেকে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতা হাজি রজ্জবের নামে প্রতিদিন হকারপ্রতি ২৮০ টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ডিসিসি উত্তরের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘ফুটপাত থেকে অবৈধ হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা একদিকে উচ্ছেদ করে এলেও তারা আবার বসে পড়ে। এক্ষেত্রে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী তাদের বসতে সহযোগিতা করছে।’
সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে