logo ১৯ মে ২০২৫
স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত বিমান কর্মকর্তারাই!
ইব্রাহিম খলিল, ঢাকাটাইমস
১৮ মে, ২০১৫ ১৫:৫৭:১২
image

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত বিমান কর্মকর্তারাই। এমন তথ্য জানিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সম্প্রতি দুই কোটি ৩০ লাখ টাকা মূল্যের ৪০টি স্বর্ণের বারসহ বাংলাদেশ বিমানের দুই কর্মচারীকে আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।


শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দেশের প্রধান দুই বিমান বন্দরকে ঘিরে দেশি-বিদেশি ১০টি প্রভাবশালী স্বর্ণ চোরাচালানি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা শাহজালালে ছয়টি, চট্টগ্রাম শাহ আমানতে তিনটি ও সিলেটে একটি সিন্ডিকেট সক্রিয়।


এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে সাতজন স্বর্ণ এবং তিনজন মানি এক্সচেঞ্জ চোরাচালান ব্যবসা করেন। পাশাপাশি তাদের সহযোগিতায় রয়েছে বাংলাদেশ বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা। তবে এসব চক্রের মূল হোতারা সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে দুবাই থাকেন। আর চট্টগ্রামে ১২ জনের একটি চক্র স্বর্ণ চোরাচালানের বিষয়টি স্থানীয়ভাবে তদারক করেন।


গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরো জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত বাংলাদেশ বিমানের পাঁচ কর্মকর্তা কর্মচারী ইতোপূর্বে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দরের সিন্ডিকেটটি অধরাই ছিল। তবে গত ৩ মে প্রথমবারের মতো শাহ আমানত বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের দুই কর্মচারীকে দুই কোটি ৩০ লাখ টাকা মূল্যের ৪০টি স্বর্ণের বারসহ আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।


চট্টগ্রাম বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ মোসতাকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে আসা প্রত্যেকটি স্বর্ণ ও মানি এক্সচেঞ্জ চোরাচালানের সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের লোকজন জড়িত। তারাই মূলত স্বর্ণের বার ও মুদ্রা বিমান বন্দর পার করে দেয়। এর বিনিময়ে দশ তোলা ওজনের প্রতিটি বারের জন্য এক থেকে দুই হাজার টাকা কমিশন পান তারা।


তিনি বলেন, কমিশনের অর্থ বিমানের সিন্ডিকেট সদস্যরা ভাগ করে নেন। তবে কমিশনের বড় একটি অংশ যায় ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ এক রাজনীতিকের পকেটে। এছাড়া আরও অন্তত সাতজন রাজনীতিককেও কমিশনের ভাগ দিতে হয়। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব রাজনীতিকের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।


সিন্ডিকেটের দেশীয় এজেন্টরা তাদের পাঠানো স্বর্ণ জায়গা মতো পৌঁছে দেয়। সেই স্বর্ণ ভারতে পাচারের পর ভারতীয় সিন্ডিকেট সদস্যরা দুবাইয়ে তাদের মূল্য পরিশোধ করে। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হলেন শফিউল আজম তালুকদার ওরফে মিন্টু। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। বর্তমানে তিনি দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। স্বর্ণ চোরাচালানের আরেক সিন্ডিকেটের মূল হোতা হলেন মাসুম আল আজাদ ওরফে সুমন। সোনা চোরাচালানে জড়িত সন্দেহে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ১১ কর্মকর্তাকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।


শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়া থেকে স্বর্ণের চোরাচালান বাংলাদেশে আসছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চোরাচালান চক্র ভারতে স্বর্ণ পাচার করার লক্ষে বাংলাদেশের এই রুট ব্যবহার করছে বলেও তথ্য দিয়েছে গোয়েন্দারা।


কিন্তু বিমানবন্দরে বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৭টি এজেন্সি কাজ করার পরও কীভাবে বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে বিষয়টি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০৪৬ ফ্লাইটে কেবিন ক্রু মাজহারুল আফসার রাসেলকে দুই কেজি ৬০০ গ্রাম স্বর্ণসহ বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গত বছর শেষের দিকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ স্বর্ণ চোরচালানের ক্ষেত্রে বিমানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ অনেকের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়।


এর সূত্র ধরেই বাংলাদেশ বিমানের তিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিমানের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম-ফ্লাইট) মো. এমদাদ হোসেন, বিমানের প্ল্যানিং অ্যান্ড সিডিউলিংয়ের প্রধান মো. আসলাম শহীদ ও সিডিউলিং ম্যানেজার মো. তোজাম্মেল হোসেনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।


অন্য দুজন হলেন, বাংলাদেশ বিমানের ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ ও ফারহান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক মো. হারুন অর রশীদ। এই চক্রটি বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের মূল নিয়ন্ত্রক বলে জানায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ফ্লাইট শিডিউল থেকে শুরু করে বিমানের সব ধরনের শিডিউল চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করতো।


সূত্র জানায়, বেশিরভাগ চোরাচালানের ক্ষেত্রে কোন ফ্লাইটে চালানটি আসবে, তা আগে থেকেই পাচারকারীরা বিমানবন্দরের অসাধু কর্মকর্তাদের জানিয়ে দেয়। এর মধ্যে লেনদেনের বিষয়টিরও দফারফা হয়। পরে ওই কর্মকর্তা তার টিমের সদস্যদের ম্যানেজ করেন। প্রতিটি চালানেই থাকে আলাদা এজেন্ট। এজেন্টরা পেশাদার চালান বহনকারীকে (পেইড ক্যারিয়ার) চালান বুঝিয়ে দেয়। এসব ধাপের কোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলেই বেহাত হয়ে যায় কোটি টাকার চালান। আবার আচমকা কোনো অসাধু কর্মকর্তার ডিউটি পরিবর্তন হলেও ধরা পড়ে যায় চালান।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামে স্বর্ণ পাচারে জড়িত রয়েছে তিন ব্যবসায়ীর একটি শক্তিশালী চক্র। তাদের কাছে বিভিন্ন দেশের একাধিক পাসপোর্টও রয়েছে। চোরাচালানে সহায়তা করেন দুবাই ও সিঙ্গাপুরের একটি মাফিয়া চক্র। নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার, নিউমার্কেট, হাজারী গলি, ভিআইপি টাওয়ার, হোটেল টাওয়ার ইন ও চকবাজারে চক্রটির একাধিক অফিস রয়েছে। চক্রটির সাথে জড়িত রয়েছে আরও প্রায় ১৫ থেকে ২০টি উপ-সিন্ডিকেট।


২০১৪ সালের পুরো বছর জুড়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিণত হয়েছিল পুরোপুরি সোনার খনিতে। কয়েক দফায় যাত্রীর লাগেজ তল্লাশি ও পরিত্যক্ত অবস্থায় প্রায় ২৫৪ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। মণ হিসেবে যা প্রায় সাত মণ। বিমানবন্দর কাস্টমস-এর হিসেবে উদ্ধারকৃত এসব স্বর্ণের আনুমানিক মূল্য প্রায় ১২৭ কোটি টাকা। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে চলতি বছরও।


চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, শাহ আমানতে প্রতি মাসেই ধরা পড়ছে একাধিক স্বর্ণের চালান। তবে চোরাচালানে জড়িত বাংলাদেশ বিমানের কেউ প্রথমবারের মতো ধরা পড়লো চট্টগ্রামে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ গ্রামের জন্য শুল্ক দিতে হয় মাত্র ১৫০ টাকা। আর ভারতে ১০ গ্রামের শুল্ক চার হাজার টাকা। ১০টি স্বর্ণের বার ভারতে চোরাই পথে বিক্রি করতে পারলে প্রায় আট লাখ টাকার মতো লাভ পাওয়া যায়। এই সুযোগটা ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে চোরাকারবারিরা।


(ঢাকাটাইমস/১৮মে/আইকে/জেবি)