logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
নূরজাহান বেগমের বর্ণাঢ্য জীবন
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
২৩ মে, ২০১৬ ১৩:০৫:৩০
image



ঢাকা: নূরজাহান বেগমের জন্ম ১৩৩১ (১৯২৫) সালে চাঁদপুর শহরের অন্তর্গত চালিতা গ্রামে। তার বাবা মুহাম্মদ নাসিরউদ্দিন পত্রিকা সম্পাদনা ও পরিচালনার জন্য কলকাতায় থাকতেন। মায়ের সঙ্গে দেশের বাড়িতে থাকার সময় ছোট নূরজাহান বেগম পানিতে ডুবে দুবার মুমূর্ষু অবস্থা থেকে বেঁচে যান। এ দুর্ঘটনার পর নাসিরউদ্দিন স্ত্রী ও মেয়েকে নিজের কাছে কলকাতায় নিয়ে আসেন। কলকাতায় আসার পর নূরজাহান বেগমকে আধুনিকা করার জন্য প্রথমেই তার নাকফুল এবং মায়ের সযত্নে বড় করা চুল ছেঁটে বব কাট করা হয়। এ জন্য তার ও তার মায়ের মনে খুব দুঃখ হয়েছিল। অবশ্য পরে এই দুঃখ তারা ভুলে যান।






নূরজাহান বেগমের শিক্ষাজীবনের শুরু সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ওই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করে লেডি ব্রেবোন কলেজে পড়াশোনা করেন। তার 'সম্পাদিকা' হওয়ার পেছনে তার পারিবারিক ও নিজের ধৈর্য, একাগ্রতা এবং নিষ্ঠা কাজ করেছে।






পত্রিকার সঙ্গে জড়িত হওয়ার ভিত্তি তার ছোটবেলায়ই গড়ে ওঠে। ১৩২৪ (১৯১৮) সালে, সেই যুগের ধর্মান্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বাধা অতিক্রম করে তার বাবা প্রকাশ করেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম চিত্রবহুল মুসলিম পত্রিকা মাসিক সওগাত। অনেক কষ্টে নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে তিনি পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠিত করেন। সে সময় সওগাত অফিসের দোতলায় একটি রুমের মেঝেতে ফরাস বা চাদর বিছানো থাকত। সেই ফরাসের ওপর বসে প্রতিদিন বিকালে আসর বসাতেন কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, শামসুদ্দিন (আজাদ পত্রিকার সম্পাদক), আবু লোহানী, আবুল ফজল, ইব্রাহিম খার মতো অনেক বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী ও বিদগ্ধজন। তারা সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে যেমন আলাপ-আলোচনা করতেন, তেমনি হাসি-গল্পে আসরটি মাতিয়ে রাখতেন। ওই আসরে চা পরিবেশন করার দায়িত্ব ছিল ছোট নূরজাহান বেগমের। তার খুব প্রিয় ছিল এ আসরটি। ছোট থাকায় সাহিত্য আলোচনা বুঝতে না পারলেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতেন। এই দাঁড়িয়ে থাকা ও শোনার অনুভূতিটাই আস্তে আস্তে তাকে বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সাংস্কৃতিক জগতের প্রতি প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। এছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাসিরউদ্দিন প্রচুর দেশি-বিদেশি বই আনতেন। বইগুলোর রঙিন ছবিগুলো ছিল নূরজাহান বেগমের দারুণ পছন্দ।






ছোটবেলা নূরজাহান বেগমের প্রধান কাজ ছিল নাসিরউদ্দিনের ফাইলিংয়ে সাহায্য করা। পাশাপাশি লেখার বস্নকগুলো সাজিয়ে রাখা। এসব কাজ তিনি সখ করে, সুন্দরভাবে করতেন। এভাবেই তার পত্রিকার প্রতি আগ্রহ জন্মে।






'বেগম' পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা যখন নেয়া হয় এবং প্রথম যখন সাপ্তাহিক বেগম প্রকাশিত হয় সে সময় মেয়েদের কাজ করার পরিবেশ আজকের মতো এত সহজ ছিল না। মেয়েদের দায়িত্ব ছিল প্রধানত রান্নাঘর ও সন্তান লালন-পালন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই সীমাবদ্ধতা থেকে নারীসমাজকে টেনে তোলার জন্য নাসিরউদ্দিন উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম মহিলা সংখ্যা সওগাত প্রকাশ করেন। এর ফলে কিছু কিছু লেখিকার সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু বছরে একটিমাত্র সংখ্যা বের করে মহিলা সমাজের তেমন কিছু কল্যাণ সম্ভব ছিল না। তাই তারই উদ্যোগ ও প্রেরণায় ১৩৫৩ (১৯৪৭) সালে সাপ্তাহিক 'বেগম'-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। 'বেগম' পত্রিকার প্রথম সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন সুফিয়া কামাল। পরে এ দায়িত্ব দেয়া হয় নূরজাহান বেগমকে। তখন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করছেন।






১৯৯৬ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্রের সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে রোকেয়া পদক পান। পেয়েছেন অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারও। তাকে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, ঋষিজ শিল্প গোষ্ঠী, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠন সংবর্ধনা প্রদান করে। ২০১০ সালে পত্রিকা শিল্পে তার অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮ সম্মাননা পান তিনি।






নূরজাহান বেগম ব্যক্তিগত জীবনে দুই মেয়ের মা। তিনি বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিশু সংগঠক ও সাংবাদিক রোকনুজ্জামান খানের (দাদাভাই) পত্নী।






(ঢাকাটাইমস/২৩মে/এমএম)