logo ২১ এপ্রিল ২০২৫
ছাত্ররাজনীতিমুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
শেখ আবু হাসান, খুলনা
২৬ আগস্ট, ২০১৬ ০৮:৩১:৩৪
image



দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি)। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হলেও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কোনো ইতিহাস নেই।  এ ছাড়া নেই কোনো সেশনজট কিংবা ছাত্ররাজনীতি।






খুলনাবাসী, ছাত্র-শিক্ষকদের নিরলস প্রচেষ্টায় এমন অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এর ধারাবাহিকতা ধরে রেখে আগামী দিনে এটি দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন উপাচার্য ড. ফায়েকউজ জামান।






মহানগরী থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক সংলগ্ন ময়ূর নদীর পাশে এক মনোরম পরিবেশে অবস্থিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।






প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নবম। একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হলেও সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এখানে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা, ব্যবসায় প্রশাসন, পরিবেশবিজ্ঞান এবং বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কোর্স খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চালু করা হয়। এ ছাড়া স্থাপত্য শিক্ষা কোর্স ঢাকার বাইরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চালু হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বুয়েটের পরই ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে এখানে কোর্স ক্রেডিট পদ্ধতি চালু করা হয়। 






বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, এর প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের নিরলস প্রচেষ্টা ও দীর্ঘদিনের আন্দোলন।  ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরকারি সিদ্ধান্ত গেজেটে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৯০ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়, যা গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ওই বছরের ৩১ জুলাই।






১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবারের মতো ৪টি ডিসিপ্লি¬নে ৮০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি  করা হয়। ১৯৯১ সালের ৩০ আগস্ট প্রথম ওরিয়েন্টেশন এবং ৩১ আগস্ট ক্লাস শুরুর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা হয়। একই বছর ২৫ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়।






এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত ব্যাচেলর ডিগ্রি, ব্যাচেলর অব অনার্স ডিগ্রি, মাস্টার্স ডিগ্রি, এমফিল এবং পিএইচডি দেয়া হয়।






বর্তমানে এখানে ৫টি স্কুল (অনুষদ) ও ১টি ইনস্টিটিউটের অধীনে ২৬টি ডিসিপ্লিনে (বিভাগ) শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্কুলগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুলের আওতায় রয়েছে আর্কিটেকচার, আরবান এন্ড রুরাল প্লানিং, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত, পদার্থ, রসায়ন বিজ্ঞান এবং পরিসংখ্যান বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন। জীব বিজ্ঞান স্কুলের আওতায় রয়েছে ফরেষ্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি, ফিশারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রোটেকনোলজি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ফার্মেসী ও সয়েল সায়েন্স ডিসিপ্লি¬ন। ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন স্কুলের আওতায় রয়েছে ব্যবসায় প্রশাসন ও হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ডিসিপ্লি¬ন। কলা ও মানবিক স্কুলের আওতায় রয়েছে ইংরেজী এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ডিসিপ্লি¬ন। সমাজ বিজ্ঞান স্কুলের আওতায়  আছে অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, ডিভেলপমেন্ট স্টাডিজ ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লি¬ন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ইনস্টিটিউটের নাম চারুকলা ইনস্টিটিউট। এ ইনস্টিটিউটের আওতায় প্রিন্ট মেকিং, ড্রইং এন্ড পেইন্টিং ও ভাস্কর্য ডিসিপ্লিন চালু হয়েছে।






এ ছাড়া সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড স্টাডিজ অন দ্য সুন্দরবনস (সিআইএসএস), রিসার্স সেল, মডার্ণ ল্যাংগুয়েজ সেন্টার ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মান বিশ্বমানে উন্নীত করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেন্টার ফর টিচিং অ্যান্ড লার্নিং (সিইটিএল) এবং ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি)। শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশাসনিক কাজে তথ্য প্রযুক্তির সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।






বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষকসংখ্যা ৩৯৮। ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে ছয় হাজারের বেশি, এর মধ্যে বিদেশি ছাত্রছাত্রী ১২ জন। এ ছাড়া কর্মকর্তা ২৩৯ জন এবং কর্মচারী রয়েছেন দুই শতাধিক।






খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিশেষ করে নবীন শিক্ষকরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ, অস্ট্র্রেলিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে উল্লে¬খযোগ্য সংখ্যায় স্কলারশিপ পাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি সংস্থার গবেষণা সহায়তাও বাড়ছে। শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকা-ের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। কানাডা, জাপানসহ কয়েকটি দেশের সাথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ বাড়াতে ক্যাম্পাসে ইতোমধ্যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার স্থাপিত হয়েছে। 






খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে তিনটি একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবন, তিনটি আবাসিক হল, মেডিকেল সেন্টার; শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ৫টি বাসভবন, অগ্রণী ব্যাংক ভবন, ডাকঘর ও মসজিদ। রয়েছে সমৃদ্ধ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবন ও শার্লী ইসলাম গ্রন্থাগার ভবন। এ ছাড়া ছাত্রদের জন্য আরও একটি হল নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।  প্রাথমিক নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে মেয়েদের আরও একটি হলের। 






বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. ফায়েকউজ জামান বলেন, গত বছর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ধারাবাহিক শিক্ষাসাফল্য অর্জিত হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রমের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছাত্র সংঘর্ষ, হানাহানি হয়নি। সেশনজট, সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অনন্য নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। একই সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখার উন্মিলনে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পরিগ্রহ করছে। 






খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তার স্বপ্ন কী জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, এর অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। দেশ ও জাতির উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখুক, র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পাক এবং সর্বোপরি একটি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাদৃত হোক এ বিশ্ববিদ্যালয়, এটিই তার স্বপ্ন।






ছাত্ররাজনীতি থাকা-না থাকার সুবিধা বা অসুবিধার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নেই, তাই বলে যে এখানকার ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন নয় তা কিন্তু নয়। তবে তারা লেজুড়বৃত্তিক দলীয় ছাত্ররাজনীতি করে না। তারাই কিন্তু ২৫ বছর ধরে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু ধারা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।






ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিষয়ে উপাচার্য বলেন, “ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে এক কথায় বললে, আসলে সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধমে সংসদের যেসব ভূমিকা পালন করার কথা, তা করলে তো প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল হতো, ছাত্রদের উপকার হতো, নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতো। কিন্তু সে পরিবেশ আছে কি? ছাত্ররাজনীতির নামে যেভাবে বাণিজ্য চলে তাতে এই রাজনীতি দিয়ে দেশ অগ্রসর হবে না। ”






গত ৫ বছরে  খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন কি, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় অর্জন শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধিতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ। এর ফলে আমাদের কোর্স-কারিকুলা, শিক্ষাদান, মূল্যায়ন, গবেষণা পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবহ সৃষ্টি হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় জোরদার হয়েছে গবেষণা।






বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস না হওয়ার কারণ সম্পর্কে উপাচার্য বলেন, গত ২৫ বছর ধরে যে মূল্যবোধ লালিত হয়ে আসছে, তা ধরে রাখতে চায় সবাই। শিক্ষার্থী-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই এ ব্যাপারে একমত। এ ছাড়া খুলনার রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ সব স্তরের মানুষ এ পরিবেশ বজায় রাখার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন।






জঙ্গিবাদবিরোধী মনিটারিং ব্যবস্থা সম্পর্কে উপাচার্য বলেন, “আমরা ক্যাম্পাসকে জঙ্গি তৎপরতামুক্ত রাখতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। ক্লাসে ক্লাসে ছাত্রদের কাউন্সিলিং করা ছাড়াও আবাসিক হলে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ঢেলে সাজানো হয়েছে। একাডেমিক ভবনসহ গোটা ক্যাম্পাসকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে।






(ঢাকাটাইমস/২৬আগস্ট/মোআ)