• 
• 
• 

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক আগ্রহী ব্যক্তি বাংলাদেশে আসতেন। এদের মধ্যেই একদিন এলেন ভারতের একজন প্রভাবশালী মাডোয়ারী ব্যবসায়ী। তার সাথে আমারও পরিচয় হলো। আমি তাকে আমার তোলা বঙ্গবন্ধুর অনেক ছবি দেখালাম। এর মধ্যে একটি ছিল বঙ্গবন্ধুর চা পানের ছবি। ঐটি তাকে দেয়ার জন্যে তিনি খুব পিড়াপিড়ী করতে লাগবেন। এমনকি এ ছবির বিনিময়ে আমাকে ৫ হাজার টাকা দেয়ারও অফার দিলেন।
বঙ্গবন্ধুর এতো সুন্দর সুন্দর ছবি থাকতে ঐ চা পানের ছবিটির প্রতি ভদ্রলোকের এতো দুর্বলতা কেন? আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো। খুব করে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, এ ছবিটি আমি চায়ের বিজ্ঞাপনে কাজে লাগাবো।
 
ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার মথা গরম হয়ে গেল। ছবি দেয়ার প্রস্তাব এবার পুরোপুরি নাকচ করে দিয়ে বললাম, যত টাকা দিন এ ছবি আমি দেবো না। আমার নেতা বাঙালী জাতির জনককে আমি চায়ের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার হতে দিতে পারি না।
 
স্বাধীনতার পর ভারত থেকে বাংলাদেশে ঘুরতে এলেন বাংলা গানের কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশ বেতারে প্রচারের জন্যে তার গাওয়া কিছু গান তখন রেকর্ড করা হলো। রেকর্র্ডিংয়ের পর বেতারের তৎকালীন আঞ্চলিক পরিচালক কামাল লোহানীর কক্ষে তাঁকে আপ্যায়িত করা হলো।
জনাব লোহানীর সাথে আলাপচারিতার ফাঁকে শ্রী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদনের বাসনা ব্যক্ত করলেন। আমরা তাঁকে নিয়ে সদল বলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে চলে এলাম। বঙ্গবন্ধু তাঁর সামনে আসতেই তিনি সশ্রদ্ধচিত্তে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, একি করলেন হেমন্ত বাবু, যাঁর গান শোনার জন্যে দেশ-বিদেশের অগণিত মানুষ পাগল, সেই আপনি আমার মত একজন নগন্য ব্যক্তিকে প্রণাম করে আমাকেই লজ্জা দিলেন।
এর জবাবে শ্রী মুখোপাধ্যায় গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, আপনি লজ্জিত হবেন কেন, বাঙালি জাতির জনককে প্রণাম করতে পেরে আমিই বরং ধন্য হলাম।
স্বাধীনতার পর ভারতে বাংলাদেশের যে সমস্ত নোট মুদ্রিত হতো তার মধ্যে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া গেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত নতুন নোট বাজারে ছাড়া হবে। এ উদ্দেশ্যে দেশের বিশিষ্ট আলোকচিত্র শিল্পীদের কাছে বঙ্গবন্ধুর অনেক ছবি ছিল। তার থেকে একটি ছবি আমি প্রেস ডিপার্টমেন্টে জমা দেই।
পরবর্তীতে ছবি নির্বাচন করা হলে দেখা গেল আমার জমা দেয়া ছবিই মনোনীত হয়েছে। খুশিতে আমার তখন দিশেহারা হয়ে যাওয়ার অবস্থা।
 
এরপর বিদেশি বিশেষজ্ঞরা এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই ছবি আমি আর কাউকে দিয়েছি কিনা। আমি চিন্তা করে বললাম, বঙ্গবন্ধুর তিনজন ভক্তকে তিন কপি দিয়েছি। তারা ঐ ছবিগুলি ওদের কাছ থেকে অবিলম্বে ফেরৎ নিয়ে নিতে বললেন এবং তিনজন ফোর্সসহ আমাকে একটি জিপে উঠিয়ে দিলেন। আমি ঐ তিন জনের বাড়ি গিয়ে ছবি তিনটি ফেরৎ নিয়ে নিলাম। আমার কাছ থেকেও ঐ ছবির নেগেটিভ নিয়ে নেওয়া হলো। তারপর রুদ্বশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম কবে আমার তোলা ছবি নোটে দেখতে পাব। এক সময় অপেক্ষার অবসান ঘটলো। আমার নিজের হাতের তোলা বঙ্গবন্ধুর ছবি পাঁচ টাকা ও দশ টাকার নোটে মুদ্রিত দেখতে পেলাম।
 
ঐ ছবির সম্মানি হিসেবে নোট মুদ্রণকারী বিদেশি সংস্থা হোটেল শেরাটনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমার হাতে একটি দামি ক্যামেরা তুলে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে তার প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা সচিবালয়ে ডেকে নিয়ে আমার নগদ ৩ হাজার টাকা তুলে দিলেন।
 
তিনি বললেন, এ টাকার পুরস্কার বড় কথা নয়, তার চেয়ে বড় পুরস্কার সব জায়গাতে সবার হাতে হাতে আপনার ছবি থাকবে। বাস্তবিকই তাই। আমার তোলা ছবি সবচেয়ে মূল্যবান জায়গায় স্থান পেয়েছে একজন ফটোগ্রাফারের জীবনে এর চেড়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।