খুলনার ডুমুরিয়ায় চিংড়ি শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। অতিবর্ষণে চিংড়িঘের প্লাবিত, চিংড়িঘেরে বিষ প্রয়োগ, চুরি, ভাইরাস ও চিংড়ি মাছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ বলে জানান চিংড়িচাষ সংশ্লিষ্টরা। ফলে এ অঞ্চলের চিংড়িচাষিরা এখন দিশাহারা হয়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন।
চিংড়িচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ উপজেলায় আশির দশক থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। ক্রমশ চিংড়ি চাষ ব্যাপকতা লাভ করে। স্থানীয় মৎস্য অধিদপ্তর বিভিন্ন প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের সহায়তার ফলে উপজেলার মানুষ চিংড়ি চাষে ঝুঁকে পড়ে। অল্প পুঁজিতে অধিক লাভ করে অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে হাজারও পরিবার।
ডুমুরিয়া মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলার ১২ হাজার ৬০০ ৫৮ হেক্টর জমিতে চিংড়িসহ অন্যান্য বিভিন্ন সাদা জাতীয় মাছের চাষ হয়।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খণ্ড খণ্ডভাবে ছোট-বড় ১২ হাজার ৯০০ ৪৮টি ঘের রয়েছে। প্রতি বছর চিংড়িসহ অন্যান্য বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, উৎপাদন হয় ছয় হাজার ৯৪৩ মেট্রিকটন। তার মধ্যে বাগদা ছয় হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে, চার হাজার ৫৯১টি মাছের ঘের রয়েছে। বছরে উৎপাদন হয় এক হাজার ২৬৫ মেট্রিক টন মাছ। গলদা চিংড়ি চাষ হয় পাঁচ হাজার ৩১২ হেক্টর জমিতে, ঘের রয়েছে আট হাজার ৩৫৭টি। বছরে উৎপাদন হয় দুই হাজার ৩৯৫ মেট্রিক টন মাছ। ওই সব ঘেরে চিংড়ি চাষের সাথে মিশ্র জাতীয় অন্যান্য বিভিন্ন প্রজাতির মাছও চাষ করে বছরে উৎপাদন হয় দুই হাজার ৬৮৩ মেট্রিক টন মাছ।
এ এলাকায় মাছের চাহিদা পূরণ করেও দেশ-বিদেশে চিংড়ি ও সাদা জাতীয় মাছ রপ্তানি করে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু এ উপজেলায় এখন প্রতি বছর অতি বর্ষণে চিংড়িঘের প্লাবিত, ভাইরাস, ভারতীয় ভাইরাসযুক্ত রেনুপোনা আমদানি, মাছ চুরি ও দুষ্কৃতিকারীদের চিংড়ি বিষ প্রয়োগের কারণে চাষিরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে নদী-খালে আড়া-আড়ি বাঁধ ও নেট পাটা দিয়ে মাছ চায় করার ফলে পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার আরেকটি কারণ। এসব নানা কারণে চিংড়িচাষিরা দিন দিন সর্বশান্ত হচ্ছে। ফলে প্রতি বছর বেকারত্বের একটি সমস্যা।
ডুমুরিয়া মৎস্য চাষী আহম্মেদ আলী জানান, এ উপজেলায় প্রতি রাতেই অবিরাম চিংড়ি মাছ চুরির ঘটনা ঘটছে। গত বছর তার ঘেরে প্রায় ৯০ হাজার টাকার মাছ চুরি হয়েছে। চিংড়ি চাষি এলাহী শেখ বলেন, চিংড়ি চাষ এখন খুবই মুশকিল হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি তার চিংড়ি ঘেরে দুস্কৃতিকারীরা বিষ প্রয়োগ ও চুরিসহ প্রায় সাত লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া ঘেরে রাত জেগে পাহারা দিয়েও মাছ রক্ষা করা যাচ্ছে না। এমনকি সম্প্রতি অতি বৃষ্টির ফলে পানিতে শত শত চিংড়ি ঘের ভেসে গেছে। এমন ঘটনা নিত্য দিনের। তবে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি ঘেরের আইলে (অবশিষ্ট জায়গায়) সবজি উৎপাদন করেই অর্থনৈতিকভাবে কোনো মতে টিকে আছেন চিংড়ি চাষিরা বলে তারা জানান।
উপজেলার রংপুর ইউনিয়নের চিংড়ি চাষি বাদল কুমার মন্ডল বলেন, গত বছর কে বা কারা তার চিংড়িঘেরে বিষ দিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকার চিংড়ি মাছ নিধন করেছে। একই গ্রামের কৃষ্ণ মহালদার বলেন, গত ৮/৯ বছর যাবৎ চিংড়ি চাষ করছি কিন্তু প্রতিবছর বিষ প্রয়োগের কারণে তিনি দুই লাখ টাকার দেনা। অবশেষে কাঁকড়া চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
একজন চিংড়ি চাষী জানান, চিংড়িঘেরে বিষ প্রয়োগ বা চুরির ঘটনা কেবল থানায় জিডি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। এ পর্যন্ত কোনো দুষ্কৃতিকারীকে পুলিশ ধরতে পারিনি বা কোনো প্রতিকারও পাওয়া যায়নি। ডুমুরিয়া মৎস্য অফিস জানায়, মৎস্য ঘেরে বিষ প্রয়োগ ও চুরি ঘটনা প্রতিনিয়ত শোনা যায়, অভিযোগও আসে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার মাছ নষ্ট হচ্ছে বলে তারা এ কথা শিকার করেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো ক্লু-খুঁজে পাওয়া যায় না।
ডুমুরিয়া মৎস্য চাষী, প্রভাষক খান নুরুল ইসলাম, মতিয়ার রহমান, সুকেশ, অমল রায়, আকরাম, রবিন মন্ডল ও রিজাউল করিম জানান, চিংড়িঘেরে এক সময় প্রচুর লাভ ছিল। এখন আর তেমন লাভ হয় না। এর কারণ জানতে চাইলে চিংড়ি চাষীরা জানান, অকাল বন্য, মৎস্যঘেরে বিষ, ভাইরাস, দেশে গলদাপোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিতে নিম্নমানের পোনা বাজারজাত, ফিসমিল, শামুকের মাংসের দামে ঊর্ধ্বগতি।
চিংড়িচাষিরা আরও জানান, এ এলাকার বেশি ভাগ চিংড়িচাষি ব্যাংক, বিমা, বিভিন্ন এনজিও বা চড়া সুদে গ্রাম্য মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করে থাকে। বর্তমানে এমন পরিস্থিতে লাভতো দূরের কথা দেনার ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন মৎস্যচাষিরা।
ডুমুরিয়া থানার ওসি মো. তাজুল ইলাম জানান, মৎস্যঘেরে বিষ প্রয়োগ বা চুরির ঘটনা প্রতিনিয়ত থানায় অভিযোগ আসে সত্য কিন্তু দুষ্কৃতিকারীরা এলাকার পূর্ব-শত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে এ ধরনের ঘটনা ঘটায়। সুকৌশলে দুষ্কৃতকারীরা সময় বুঝে দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে বিষের বোতলের মুখ খুলে ঘেরের পানিতে ছুড়ে ফেলে চলে যায়। এদেরকে চিহ্নিত করা বা ধরা খুবই মুশকিল হয়ে পড়ে। এর ফলে প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় চিংড়িচাষিদের।
ডুমুরিয়া সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরোজ কুমার মিস্ত্রী জানান, এলাকার নদী ও খালগুলো খননের প্রয়োজন আর ঘেরে চিংড়ি চুরি ও বিষ প্রয়োগ রোধে ব্যাপক পাহারার ব্যবস্থা করে ওই চক্রগুলো ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য চিংড়িচাষিদের সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।