বিজ্ঞানীরাও মানুষ। সাধারণ মানুষের মতো তারাও মাঝে মাঝে দ্বন্দ্বে মেতে ওঠেন। তাঁদের কাজ-কারবার বড়বড় ও বিজ্ঞান নিয়ে। তাঁদের দ্বন্দ্বের কারণও তাই বিজ্ঞানের বড়বড় বিষয়।
বিজ্ঞানে বিবাদের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে একজন বাঙালি বিজ্ঞানীর নামও। তিনি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। বেতার যন্ত্রের আবিষ্কারকের নাম কী? আমরা সবাই জানি ইতালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কোনির কথা। আসল সত্যি হলো মার্কোনির আগেই জগদীশ চন্দ্র বসু বেতার যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। তাঁর সেই যন্ত্রের কথা জানতেন ইউরোপের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরাও। জগদীশ চন্দ্র বসুকে তারা প্রশংসাও করেছেন এজন্য। সে সময় ইউরোপের এক বিখ্যাত ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি জগদীশ চন্দ্র বসুর বেতার যন্ত্রের নকশটা কিনতে চায়। কিন্তু তিনি সেটা বিক্রি করতে রাজি হননি। এর কিছুদিন পরেই মার্কোনিও বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করেন। তখন সেই ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি মার্কোনির যন্ত্রের নকশটা কিনে নেয়। ফলে মার্কোনির তৈরি বেতারযন্ত্রই ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। আবিষ্কারকের মর্যাদা তিনিই পেয়ে যান। এ নিয়ে অবশ্য জগদীশ চন্দ্র বসুর মনে কোনও দুঃখছিল না। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞান হলো সাধনা, ব্যবসার বস্তু নয়।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিবাদটা বাঁধে সুব্রহ্মাণন চন্দ্র শেখর আর আর্থার এডিংটনের মধ্যে। ১৯৩০ সাল। চন্দ্র শেখর তখন একেবারেই তরুণ। সমুদ্র জাহাজে চেপে তিনি ভারত থেকে চলেছেন বিলেতে। জাহাজে চড়ে বিলেত যেতে তখন কয়েকমাস সময় লেগে যেত। বিজ্ঞানী মন বলে কথা। আর সবার মতো তিনি হৈ চৈ করে কাটালেন না জাহাজের দিনগুলি। ভাবতে বসলেন নক্ষত্রের মৃত্যু নিয়ে। সেময় বিজ্ঞানীদের মধ্যে এ বিষয়ে একটা শক্ত ধারণা প্রচলিত ছিল। তাঁরা মনে করতেন সবনক্ষত্রই পুরোপুরি মৃত্যুর আগে শ্বেতবামনে পরিণত হবে।
নক্ষত্রগুলোর ভেতরে জ্বালানি একসময় ফুরিয়ে যায়। তখন এদের পরমাণুগুলো মহাকর্ষ বলের কারণে পরস্পরকে আকর্ষণ করে। সবাই সবার কাছাকাছি আসতে চায়। নক্ষত্র সংকুচিত হতে শুরু করে। একটা সময় গিয়ে পরমাণুগুলো গায়ে গায়ে লেগে যায়। তখন আর নক্ষত্র সংকুচিত হতে পারে না। নক্ষত্রের এই দশাকে বলে শ্বেতবামন।
জাহাজে বসে বসে অঙ্ক কষলেন চন্দ্রশেখর। তাঁর হিসাব থেকে বেরিয়ে এলো, সব নক্ষত্রই শ্বেতবামনে পরিণত হবে না। কোনও নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের দেড়গুণের বেশি হলে সেই নক্ষত্র আর শ্বেতবামনে পরিণত হবে না। সূর্যের ভরের এই দেড়গুন সীমা পরে ‘চন্দ্র শেখর লিমিট’ নামে বিখ্যাত হয়ে যায়।
বিলেতে চন্দ্র শেখরের শিক্ষক ছিলেন জ্যোতির্বিদ আর্থার এডিংটন। তিনি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্বের একটা প্রমাণ দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানী মহলে তাঁর প্রভাব বিরাট।একদিন এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে চন্দ্র শেখর জাহাজেব সে যে হিসেব কষে ছিলেন সে কথা বললেন। তার গাণিতিক তত্ত্বও দাখিল করলেন। অনেকেই তাঁর হিসাব মানতে পারলেন না। চন্দ ্রশেখরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল সূর্যের ভরের দেড়গুনের চেয়ে বেশি ভরের নক্ষত্র হলে কীভাবে মৃত্যু বরণ করবে?
চন্দ্র শেখর তার জবাব দিতে পারেন নি। তখন সবচেয়ে বড় আঘাতটা এলো শিক্ষক এডিংটনের কাছ থেকে। চন্দ্র শেখর লিমিটকে পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিলেন তিনি। মেজাজ হারিয়ে অনেক কটু কথাও শুনিয়েছিলেন ছাত্রকে।
ক্ষোভে-দুঃখে চন্দ্র শেখর মহাকাশ বিষয়ক গবেষণা ছেড়ে দেন। ব্রিটেন থেকে চলে যান আমেরিকায়। কিন্তু তার তত্ত্ব মনে ধরেছিল বেশ কয়েকজন তরুণ বিজ্ঞানীর। কিন্তু এডিংটনের ভয়ে সেদিন কেউ মুখ খুলতে পারেন নি। তারা নীরবে চন্দ্রশেখর লিমিট নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। ১৯৮৩ সালে আমেরিকার ক্যালটেকের বিজ্ঞানী উইলিয়াম আলফ্রেড ফাউলার চন্দ্র শেখর লিমিটের যথার্ততা প্রমাণ করেন। তখনও চন্দ্রশেখর বেঁচেছিলেন। তাই সে বছর ফাউলারের সাথে চন্দ্রশেখরকেও নোবেলপ্রাইজ দেওয়া হলো ৫৩ বছর আগে আবিষ্কার করা এক তত্ত্বের জন্য। এডিংটন অনেক আগে ইমারা গেছেন। বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই অর্ধশতাব্দী আগের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেন!