নুহাশ পল্লীতে গিয়েছিলাম ২৩ সেপ্টেম্বর বিকালে। সঙ্গে ছিল জান্নাত ও গল্প আব্বু।
এটা কী নুহাশ পল্লীতে যাওয়া, নাকী কথাশিল্পের রাজকুমারের কাছে যাওয়া?
জান্নাত তো বটেই, গল্প আব্বুও এই প্রথম নুহাশে গেলো। লালন হাতের কাছে মেঘনা থাকতেও যে কারণে জল পিপাসায় মরছিলেন, কাতর হয়েছিলেন, অথবা হাতের কাছে ভরা কলস থাকতেও তেষ্টা মেটাতে পারেন নি; ঠিক একই কারণে এতকাল জান্নাত ও গল্প আব্বুকে নিয়ে নুহাশ পল্লীতে যাওয়া হয়নি! অথচ নুহাশ পল্লী আমার বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ ছয় কিলোর দূরত্বে, পশ্চিম দিকে। এ নিয়ে আমার অনুশোচনা ছিলো। আজ অনুশোচনা কিছুটা কমলো।
আমার বন্ধু, জীবন সঙ্গিনী জান্নাত হুমায়ূন আহমেদ স্যারের লেখার গভীর অনুরাগী। আমি জান্নাতের ঘরে, রাজশাহীতে হুমায়ূন আহমেদের বই যতটা যত্নে সংগ্রহে রাখতে দেখেছি, ততটা যত্নে আমার বইগুলো রাখতে দেখিনি। এ নিয়ে আমার খেদ নেই। উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের কাছে একশো ওয়াটের বাল্ব আর তেমন কী? আমি যখন বি.বি.এ তে পড়ছি, তখন অনেকের মতো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে গ্রাস করেছিলেন। আমি সুনীল দার সঙ্গে কোলকাতায় গিয়ে দেখা করবো ভাবতাম। পূর্ব পশ্চিম, প্রথম আলো, সুদূর ঝর্ণার জলে সহ বেশ কিছু উপন্যাস এমনকি তাঁর কবিতা আমাকে বড্ড টেনেছিলো। আর টেনেছিলো শক্তি বেলাল চৌধুরীদের সঙ্গে তাঁর তুমুল আড্ডাবাজি, মদ খেয়ে হরদম খিস্তি আওড়ানো। ও মা, তারপর দেখলাম সুনীল একদিন কবি বেলাল চৌধুরী ও সুবিখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনসহ স্নান করছেন নুহাশের অর্গানিক ফর্মে ডিজাইন করা সুইমিং পুলে! মধ্যমণি হুমায়ূন আহমেদ। এটা প্রথম আলোর সাময়িকীতে দেখলাম তখন, যখন সুনীল ফের পশ্চিম বঙ্গে চলে গেছেন। আমার সৌভাগ্য, আমার গুরু আহমদ ছফা আমাকে কিছুটা এপার বাঙলা ওপার বাঙলার রাজনীতি শিখিয়েছিলেন। নয়তো বড্ড কষ্ট হতো এ বাঁধন ছিন্ন করা! এই সুইমিং পুলেই আমার বন্ধু ফরেস্ট অফিসার আনিসুর রহমান ঝাপিয়ে পড়ার জন্য তোরজোড় করছিলেন। সেই তিনটা থেকে বেচারা প্রতীক্ষায় ছিলেন। কাহাতক আর ধৈর্য কুলোয়। বারবার ফোন দিয়েও না পেয়ে কোয়ার্টার প্যান্ট আর গায়ে গামছা জড়িয়ে সুইমিং পুলে নামতে যাচ্ছেন, তখনি গিয়ে আমরা হাজির। গল্পকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়েই আমাদের সম্মানে যতোটা করা দরকার তার সবটুকু করে নেমে পড়লেন স্বচ্ছ নীল জলে! নুহাশ পল্লীর ম্যানেজার বুলবুল ভাই আগেই নেমে পড়েছিলেন। সুইমিং পুলে থেকেই ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন। এই ফাঁকে আবারো ধন্যবাদ জানালাম বুলবুল ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি ঈশ্বরদী থেকে টসটসে রসে ভরা বেশ কিছু লিচু এনে গত সিজনে উপহার দেয়ার জন্য।
গল্প আব্বু বেশ কিছু মজার কাণ্ড করলেন। কী কী করলেন তা তো আর সব বলা যাবেনা! এটা যতোদিন বাঁচি আমি আর জান্নাতই মনে করে হাসবো, আনন্দে চোখের জলে সুখের কাব্য লিখবো। শুধু দু’চারটি কথা বলি। ওই যে ফলের ঝুড়ি নিয়ে টান টান ধনুকের গতির তারুণ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতী, তাকে দেখেই গল্প আব্বু প্রথমে কী ভেবে ধরলেন চুলের ঝুটি! আমরা যখন ছবি তোলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন গল্প আব্বু ঝুটি ছেড়ে দিয়ে ফের যুবতীর হাতে থাকা ঝুড়িতে হাত রাখলেন। একে একে তুলে নিতে চাইলেন আপেল কুল কলা ও আঙ্গুর! ক্যামেরার দিকে ওর নজর নেই! হুমায়ূন স্যারের ক্রিয়েটিভ ভাবনা এখানে অমরত্ব পেলো, আমি ধরে নিলাম!
তারপর গল্প গেলো ওয়েস্টার্ন কিশোরীর কাছে। কিশোরী তখন জাম জলপাই পামের ছায়ায় লোহার ছোট্ট খাটিয়ায় উপুড় হয়ে শুয়ে কারো কবিতা পড়ছিলেন। ধরে নিলাম এটা শেলী বা কীটসের কবিতা। এগারো মাস বয়সী গল্প আব্বু কিশোরীকে অবাক করে দিয়ে তার মাথা ও পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে হিব্রু ভাষায় (দোহাই কথাশিল্পী বাসুদেব মালাকর দাদা) বলতে থাকলো, আপু, পড়ো, মন দিয়ে পড়ো। তুমিতো বাইবেল পড়েছো বা পড়ার চেষ্টা করেছো। জানতো পবিত্র কোরআন যখন প্রথম নাযিল হয় প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) উপর, তখন বলা হলো, ইকরা! অর্থাৎ পড়ো! তুমি এই কাজটি করছো দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। হুমায়ূন আঙ্কেলকে ধন্যবাদ তোমার পড়াশুনার সুবিধার্থে এতো সুন্দর ব্যবস্থা করে রাখার জন্য! কিশোরীটি বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গল্পের দিকে ঘাড় কাত করে তাকালো। বললো, দেখো গল্প, আমি কিন্তু ঠিকই পড়ছি, সব সময়ই পড়ি। আমার জন্মই হয়েছে পড়াশোনা করার জন্য। হুমায়ূন আঙ্কেল ওসিয়ত করে গেছেন, আমি যেনো কোন অবস্থাতেই পড়াশুনা না ছাড়ি! কিন্তু তুমি পড়াশুনা না করে ঘুরছো কেনো বালক? গুল্প ঝটপট উত্তর করে, দেখো আপু, আঙ্কেল কিন্তু আমাকে বলে গেছেন তুমি পড়াশুনায় ফাঁকি টাকি দাও কীনা তা দেখার জন্য!
হুমায়ূন স্যারের ঘুমানোর মূল চত্বরে জান্নাত যেতে চাইলোনা। কেনো যায়নি তার ব্যাখ্যা একটু পরেই দেবো। সমাধীর চারদিকে যে কাঁচের বেষ্টনী, সে বেষ্টনী গল্প আব্বু কী অতিক্রম করতে চেয়েছিলো? জানিনা। শুধু যা ভাবছি, কাঁচের এপারে থেকে, ওই যে জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, মরনের পরপারে বড় অন্ধকার, এইসব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো! একটু পরেই এই আবহটা তৈরি হবে। এখন এই মুহূর্তে আমরা বিপন্ন, বিষণ্ণ! নুহাশের সবুজ সবুজ আর সবুজ মখমল ঘাস মাড়িয়ে আমরা যখন বৃষ্টিবিলাস পেরিয়ে পৌঁছালাম ভেষজ বনে, দাঁড়ালাম করবী রক্তের কাছে; চারদিকে অজস্র ভেষজ বৃক্ষ ও পিছনে নাম না জানা প্রকান্ড বৃক্ষের ডাল পালা ও সবুজ অন্ধকার আমাকে বিপুল ভাবালো। এতো ভালো লাগে জাম জলপাই বাঁশ পাতার সবুজ অন্ধকারের মতো এই ভেষজের অন্ধকার, এর আগে এমন করে কখনো বুঝিনি! জান্নাত ও গল্প আব্বু আমার সঙ্গে আছে বলেই কী এতো ভালো লাগা, জীবনের প্রবল ইতিবাচক উপলদ্ধি, মুগ্ধতা? হতে পারে!
বৃষ্টিবিলাস পেরোবো, হুমায়ূন স্যারের প্রিয় বৃষ্টি আমাদেরকে নতুন জীবনে ভাসাবেনা তা কী করে হয়? জান্নাত মনে মনে তা ভাবতে না ভাবতেই হঠাৎ করেই শুরু হলো বৃষ্টি। হালকা বৃষ্টি থেকে ঝুম বৃষ্টি! যখন বৃষ্টি পড়ছে গল্প আব্বুকে নিয়ে বৃষ্টি বিলাসের দিকে দিলাম দৌড়! গল্প আব্বু দু’ দাঁতের সে কী খেল দেখালো! সঙ্গে যোগ হলো ঠোঁট মুখ চোখ চিবুক ভ্রু। আব্বু খলখলিয়ে হাসছেন। জান্নাত বাপ বেটার দৌড় আর হাসি দেখে যা ভাবলেন তা মনে রাখার মতো। বৃষ্টি বিলাসের চেয়ারে বসে যখন টিনের চালের বৃষ্টি সংগীত শুনছি, জান্নাত বললো, আমার মন বলছিলো বৃষ্টি না হয়ে যায় না! বৃষ্টি বিলাসে বসে বৃষ্টি যাপন!! প্রকৃতির কমন সেন্সকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ চিরো সুন্দরের আধার!
ও হে প্রিয় কবি শহীদ কাদরী, আপনি কোথায়? বৃষ্টি তাহলে নস্টালজিক হওয়ার জন্য বড় টনিক হিসেবে কাজ করে? তাহলে একই সঙ্গে আমি আমার প্রিয়তমা জান্নাত ও হৃৎপিণ্ড গল্প আব্বুর সঙ্গে বর্তমান হয়ে যাপন করছি এ দুটি বিপুল সুন্দর ছাপিয়ে হাহাকার জাগানিয়া নুহাশের অন্ধকার সবুজ, একই সঙ্গে অতীত অতীত, নস্টালজিক ক্যানভাস; যে ক্যানভাসে হুমায়ূন আহমেদের মতো ক্ষণজন্মা পুরুষের মুখ, অসংখ্য পান্ডুলিপি!
‘বৃষ্টির বিপুল জলে ভ্রমণ-পথের চিহ্ন
ধুয়ে গেছে, মুছে গেছে
কেবল করুণ ক’টা
বিমর্ষ স্মৃতির ভার নিয়ে সহর্ষে সদলবলে
বয়ে চলে জল পৌরসমিতির মিছিলের মতো
নর্দমার ফোয়ারার দিকে,–’
আনিস ভাই কী এক জরুরি কাজে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। নুহাশের বাইরে এসে শালবনের নিবিড় নির্জনতা ও আলো আঁধারে বসে চা খেলাম। রাজীব মাষ্টার ভাই আতিথেয়তায় এতোটুকু কার্পণ্য দেখালেন না।
যখন ফিরছি, জান্নাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো পিছনে ফিরে। গল্পকে বললো,তোমার হুমায়ূন আঙ্কেলকে টা টা দাও আব্বু! গল্প কী যেনো ভেবে পিছন ফিরে টা টা দিতে থাকলো। গভীর বনের অন্ধকার ঠেলে আমরা ফিরতে থাকলাম ঘরের দিকে। যেরকম একটি ঘর এক সময় হুমায়ূন আহমেদ স্যারের ও ছিলো। জান্নাত বললো, জানো কেনো আমি হুমায়ূন স্যারের কবরের কাছে যাইনি? আমার মনে হচ্ছিলো আমি নিতে পারবোনা ভার, কেঁদে ফেলবো!
আমি জান্নাতকে কিছু না বলে ডুব দেই নিজের ভেতর অল্প সময়ের জন্য। নিজের গহনে দেখি হুমায়ূন স্যারের মুখ। সাহসী মুখ! ঘুমানোর জন্য এবং নিমগ্নতার জন্য এরকরম সবুজ নিবিড় নির্জনতার বিকল্প নেই, আমি ভাবি, ভাবতে থাকি!
আমার ভাবনায় আছড়ে পড়ে কিছুদিন আগের এক রাত, যে রাতে পিরুজালীর হাটখোলা সেতুতে ছিলাম মধ্যরাতে। মধ্য রাতের সঙ্গী ছিলো আমার বন্ধু মনজুর আলম মন্ডল। শালদা নদীর উপর ঝুলে থাকা সেতুটিকে দূর থেকে মনে হচ্ছিলো অপার্থিব দড়ি। এ দড়ির উপর মধ্য রাতে কেবল দাঁড়াতে পারে ভাবুক ও শিল্পী, এছাড়া আর কারো দাঁড়ানোর নৈতিক অধিকার নেই। মাথার উপর অপার আকাশ, আকাশ ও নদীর জলে ঝুলে থাকা চাঁদ, নিঃশব্দ চরাচরে লিলুয়া বাতাস। অন্ধকার ও মৌনতায় অনতি দূরে দোলছে কালো নৌকা ও লন্ঠন। সংগ্রাম চলছে জেলের জল ও জীবনের। অন্ধকার অন্ধকার অন্ধকার, লিলুয়া বাতাস ও ঝুলে থাকা চাঁদ, নিঃশব্দে ধীর গতিতে প্রবাহমান নদী- আহা আহা, আমার ভেতরে মরমী স্বত্ত্বা জেগে উঠতেই মনে পড়ে নদীর কোনাকুনি অল্প দূরেই ঘুমিয়ে আছেন রূপকথার যাদুকর, কথাশিল্পের যাদুকর ও রাজকুমার হুমায়ূন আহমেদ! চরাচর ব্যাপী বিমূর্ত কেউ একজন অবিরত বুক চাপড়ে কাঁদে, কাঁদতে থাকে; সেই সঙ্গে বলতে থাকে, শিল্পী ও ভাবুকদের এতো অকালে ঘুমাতে নেই, ঘুমানো মানায় না! এটা অন্যায় ও নিষ্ঠুরতা! রাত বাড়ে, বাড়তে থাকে। আমি লিখি-