logo ২০ এপ্রিল ২০২৫
আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব: ড.তৌফিক এম সেরাজ
০৫ জুলাই, ২০১৪ ১১:৩৭:২৩
image


তিনি একজন নগর পরিকল্পনাবিদ। বৃটেন থেকে নগর পরিকল্পনা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বুয়েটে শিক্ষকতা করেছেন সুনামের সঙ্গে। আশির দশকে প্রাইভেট সেক্টরে নতুন হাওয়া বইছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পেশাগত শিক্ষার সঙ্গে তাল রেখে আবাসন শিল্পের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান শেল্টেক লিমিটেড। তার এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তানিম আহমেদ।

রিয়েল স্টেট খাতে ভালো করার উপায় কী?

মুক্তবাজার অর্থনীতি ভালো করার সরাসরি কোনো উপায় থাকে না। ২০১০ সালের পর থেকে এই খাতে খারাপ অবস্থা চলছে। এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে তা অতিরিক্ত খারাপ। ২০১২ সালের সঙ্গে তুলনা করলে সেটা অর্ধেক হয়ে গেছে। এ রকম কোনো খাত যদি চরম মন্দার  ভেতরে পড়ে তখন সরকারের তরফ থেকে নিয়মনীতি থাকা উচিত, যা ব্যবসাবান্ধব হতে পারে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দাম অনেক বেড়েছিল। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছিল। অ্যাপার্টমেন্টের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ জমির দাম বৃদ্ধি। নির্মাণ সামগ্রীর দাম যতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে জমির দাম। সরকারের  সহায়ক ভূমিকা এই সেক্টর কোনো দিন পাইনি। এটা হয়েছে সবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এখন যে সমস্যাগুলো আবাসন শিল্পে হচ্ছে, সেটা দূর করতে পারলে কিছুটা ভালো অবস্থানে যাবে এই খাত। সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্ল্যান। এটি দীর্ঘমেয়াদি হয়ে গেছে। সরকারি সংস্থাগুলো একটু ভূমিকা নিলেই এটা দূর করা যায়। রেজিস্ট্রেশন খরচ অনেক বেশি। এবারের বাজেটেও কিছুটা বেড়েছে। যেখানে কমানো উচিত সেখানে বাড়ানোটা যৌক্তিক হচ্ছে না। অন্যদিকে গত কদিনের পত্রপত্রিকায় দেখছি অপ্রদর্শিত অর্থ এই খাতে বিনিয়োগ করা হয়। এটা সবসময়ই হয়। কিছু দিন পরপর গণমাধ্যমে উঠে আসে এটা খারাপভাবে। অবৈধ বা অপ্রদর্শিত অর্থ অর্থনীতিতে না থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি স্বচ্ছ অর্থনীতি উন্নয়নের সূচক। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যদি সবাই প্রতিযোগিতামূলকভাবে স্বচ্ছ ব্যবসা করে এবং সরকারের নিয়মনীতি যদি স্বচ্ছ থাকে তাহলে অপ্রদর্শিত অর্থ সমাজে বেশি মাত্রায় থাকা উচিত নয়। পৃথিবীর সব সমাজে, অর্থনীতিতে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা থাকে, কিছু অপ্রদর্শিত অর্থ থাকে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে উন্নয়নশীল দেশে তথা আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে এটির মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। এটা বাস্তবতা। এই বাস্তবতার উৎস যদি আমরা বন্ধ করতে না পারি তাহলে বিনিয়োগে উৎসাহিত করলেও লাভ হবে না।

এবারের বাজেট অনুযায়ী অপ্রদর্শিত অর্থ উপযুক্ত কর প্রদান সাপেক্ষে এই খাতে বিনিয়োগ করা যাবে। এটা সরকারের ইতিবাচক অবস্থান। এতে এই খাতের কিছুটা হলেও উন্নতি হবে। যদি না সাংঘর্ষিক কোনো নীতিমালা সরকারের অন্য নীতিতে থাকে। কেননা আমি একদিকে বলব আপনি বিনিয়োগ করতে পারবেন, অন্যদিকে অন্য সংস্থা এসে বলবে তুমি বিনিয়োগ করছ, কর দিয়েছ? এই টাকা কোথায় পেলে?

কাজেই সরকারকে প্রথমেই ঠিক করতে হবে এই অপ্রদর্শিত অর্থগুলো কর পাওয়া সাপেক্ষে। সেক্ষেত্রে এই খাতে যদি আবার বিনিয়োগ বাড়ে, যেটা গত তিন বছরে একদম কমে গেছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য ভালোভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। হস্তান্তর ব্যয়টা যেভাবে বাড়ানো হয়েছে সেটা এভাবে বাড়ানো উচিত হয়নি। বাজার মূল্য এবং রেজিস্ট্রেশন মূল্যের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। এই ব্যবধানটা কমানো উচিত। এটার সঙ্গে টেক্স রেজিস্ট্রেশন সরাসরি জড়িত। এতে করে অপ্রদর্শিত অর্থের মাত্রা ভবিষ্যতে কমতে পারে। বাজারে জমির দাম এবং নির্মাণ সামগ্রীর দাম অনেকটা কারেকটেড হয়ে এসেছে। কারণ যখন অর্থনীতি ভালো থাকে তখন এটাকে বাবেল অর্থনীতি বলে। আবাসন খাতে এটা সব দেশে হয়েছে, এ দেশেও হয়েছে, এটা স্বাভাবিক। অপ্রতাশিত কিছু নয়।

গত দুই-তিন বছর ধরে মন্দাভাব যাচ্ছে। এতে অ্যাপার্টমেন্টের দাম অনেকটা কমে গেছে। একটা স্থিতাবস্থা আজ-কাল কিংবা ছয় মাস পরও আসবে। সরকারের উচিত হবে এই ক্রমবর্ধমান খাত যেন ওপরের দিকে যেতে পারে সে জন্য সচেষ্ট হওয়া। আবার আমাদের দেশে লোনের সুদের হার অনেক বেশি। এটাকে ছয়-সাত-আট শতাংশে নামানো উচিত। যেখানে উন্নত বিশ্বে সুদের হার তিন থেকে ছয় শতাংশের মধ্যে, সেখানে আমাদের দেশে যদি ছয় থেকে নয় শতাংশের মধ্যে থাকে তাহলে এ খাতে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে আমরা সুদ দেই ১৪ থেকে ১৬ শতাংশের বেশি। যা মধ্যবিত্ত আবার অনেক উচ্চবিত্তের জন্য অনেক কঠিন।

আবাসন খাতের সম্ভাবনা কতটুকু?

এ খাত মানুষের মৌলিক চাহিদার একটি পূরণ করে। অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রথম দুটি পূরণ হওয়ার পর তিন নম্বরটা লাগবেই। বাসস্থান একটা মানুষকে মর্যাদা দেয়। যেকোনো মধ্যবিত্তের সফলতার প্রথম স্বাক্ষর হচ্ছে তার নিজের একটা জমি, একটা বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বাসস্থানের চাহিদা পূর্ণ হবে। কাজেই আবাসন খাতের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছুই নেই। এটা সব দেশের জন্য একই উত্তর। আবাসন শিল্প একটা দেশের উন্নয়নের সূচক। কারণ যেকোনো মানুষের ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে নিজের বাড়ির ওপরে আর কিছু নেই। যখন তার নিজের বাড়ি হয় তখন তার অবস্থান, ছেলেমেয়ের অবস্থান এবং সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়। মানুষের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আমাদের দেশে সরকার এটা ইচ্ছা করলেই পারবে না। বেসরকারি সংস্থাগুলো গত ত্রিশ বছর এগিয়ে এসেছে। সরকার সহায়ক শক্তি হিসেবে এটাকে ব্যবহার করা উচিত।     

এই খাতের বর্তমান সমস্যাগুলো কী?

গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগে কবছর অনেক অসুবিধা ছিল। তা এখন  আস্তে আস্তে কমছে। এটাকে আরো কমিয়ে আনতে হবে। এগুলোও মানুষের মৌলিক চাহিদা। বাড়িতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি থাকবে এটা স্বাভাবিক। এটা আবাসন শিল্পের হোক বা না হোক। একজন বস্তিবাসীরও পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অধিকার রয়েছে। এটা যদি আমরা দিতে না পারি তাহলে আবাসন খাত থাকবে কি করে? আর এটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, সরকারকেই দিতে হবে। আমি মনে করি এক ঘণ্টা লোডশেডিং হলেও ভালো, তারপরও যেন মানুষের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির চাহিদা পূরণ হয়।

 রিহ্যাব বা রিহ্যাববহির্ভূত অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গ্রাহকরা প্রতারণার শিকার হচ্ছে, এটা কেন?

আমি যেহেতু এখন রিহ্যাবের কার্যকরী পরিষদে নেই, তাই এর উত্তর দেওয়াটা আমার জন্য সমীচীন হবে না। রিহ্যাব এখন অনেক বড় সংগঠন। সেই সঙ্গে তাদের কাজের পরিধি এবং দায়িত্বও বেড়েছে। জনগণ সচেতন হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেমন এখন মানুষ ফরমালিন নিয়ে সচেতন হচ্ছে, এর সুফল মানুষ পাবে। আমি কেন অচেনা আবাসন কোম্পানির কাছে যাব? আমি খোঁজ নিব না? আমি কোনো কাপড় কিনতে গেলে কটা দোকান যাচাই করে কিনি। আবাসন শিল্প অনেক বড় একটা বিনিয়োগ। শুধু একটি চটকদার বিজ্ঞাপনের ওপর মানুষের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়। তাই সবাইকে যাচাই-বাছাই করে কেনা উচিত।

 এ খাতে সরকারি নজরদারি বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন?

বিগত বছরগুলোতে এই খাতে নজরদারি অনেক বেড়েছে। অনেক উন্নতি হয়েছে। নজরদারি বাড়ানো উচিত। স্বচ্ছতা থাকা উচিত।

আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কিছু বলুন...।

আমরা যখন ব্যবসা শুরু করি তখন তো আবাসন ব্যবসার ধারণাটি তেমন  প্রচারই পায়নি। ২৫ বছরের ব্যবধানে আজকে আবাসন ব্যবসা একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটা অনেক বড় একটি বিষয় বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে গত দশকের শুরুতে আবাসন ব্যবসার দ্রুত উন্নতি ঘটেছে। ২৫ বছর ধরে এ খাতে কাজ করছি। আমাদের আজ পর্যন্ত আদালতের বারান্দায় যেতে হয়নি। অর্থাৎ আমরা এমনভাবে কাজ করেছি যাতে এসব ঝামেলায় জড়াতে না হয়। এমন আরও কেউ থাকতে পারেন। আমার জানা মতে কাউকে পাইনি। চেষ্টা করি একটি প্রকল্পের কাজের বিষয়ে যাতে কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে করতে না পারে। অন্য জায়গায় অভিযোগ করবে তো দূরের কথা।

এছাড়া আমরা এখানে পরিবারের মতো কাজ করি। আমরা স্থায়ীভাবে প্রায় ৭০০ জনের পরিবার। ফ্লাইং ওয়ার্কার মিলিয়ে ২০০০ বেশি হবে। আমাদের পরিবারে যারা গ্রাহক হিসেবে যোগ দেন তাদের সঙ্গে তো একটি স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হয়। এখানে যারা টিমমেট হিসেবে যোগদান করেন তারাও দীর্ঘমেয়াদে আমাদের সঙ্গী হন। এগুলো আমাদের অর্জন বলে মনে করি।

ভবিষ্যতের জন্য কী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন?

এতই মন্দার ভেতরে আছি যে, এখন কোনো পরিকল্পনা নেই। এখনকার পরিকল্পনা হচ্ছে এই সংকট মুহূর্ত ঠেকানো।