logo ১৯ এপ্রিল ২০২৫
ঢাকার বাইরেও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে
০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ১১:৩৯:৩১
image


নাইমুল হাসান। জন্ম ১৯৬৬ সালে। রিহ্যাবের জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন তাঁর বড় ভাই প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান। তিনিই হাসান অ্যান্ড এসোসিয়েটস লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দেন নাইমুল। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠানটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই সময়কে দেওয়া  সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন আবাসন খাতের নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিলকিছ ইরানী

আবাসন খাতে ভালো করার উপায় কী?

আমার মতে, আবাসন খাতে ভালো করার উপায় হচ্ছে সরকারের এগিয়ে আসা। এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত কিছু দেশসহ আমেরিকায়ও দেখা যায় তাদের মূল থিম হচ্ছে ভোক্তাদের সহযোগিতা করা। সহযোগিতা করা মানে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। গ্রাহকরা যদি সাড়ে ১২০০ স্কয়ার ফিটের কম ফ্ল্যাট কেনে তাহলে তাদের ৯ শতাংশ হারে লোন দেওয়া হবে। কিন্তু এখন সে ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ডেভেলপারদের কাছ থেকে ১৫-১৬ শতাংশ সুদ নেওয়া হচ্ছে। ডেভেলপারদেরও সুদের হার কমাতে হবে। সাধারণত পোশাক শিল্পের পরই সবচেয়ে বেশি অদক্ষ শ্রমিক নিয়ে আবাসন খাত কাজ করে।

এই খাত বাঁচাতে হলে সরকারের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া এগোনো সম্ভব নয়। এছাড়া রেজিস্ট্রেশন খরচ কমাতে হবে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বেশি খরচ হয় না রেজিস্ট্রেশনের জন্য। উন্নত দেশে যেখানে ২ থেকে ৫ শতাংশ হারে রেজিস্ট্রেশন ফি নেওয়া হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে ১২ শতাংশ নেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে রেজিস্ট্রেশন ফি বেশি হওয়ার কারণে ফ্ল্যাটের মূল্য এক কোটি টাকা হলে সেখানে হয়ত দেখানো হলো ৫০ লাখ টাকা। যদিও এটা সরকারি নিয়মেই করা হয়। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন ফি কমানো হলে আমরা তখন পুরো ভেল্যুটাই দেখাতে পারি। আর সরকারও ভ্যাট-ট্যাক্স সবই পেয়ে যাবে।

আমরা মধ্যবিত্তদের নিয়ে ফ্ল্যাট তৈরি করি। তাদের কাছে তো ২ লাখ বা ৪ লাখ অনেক টাকা। যারা ১ কোটি বা ২ কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনছে তাদের কাছে ১০-২০ লাখ কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু যারা ৫০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কিনছে তাদের ৫-১০ লাখ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে গায়ে লাগে। তাদের জন্য এটা বোঝা হয়ে যায়।

এই খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলুন।

গত দুই বছর ধরে আবাসন খাত খুবই কঠিন সময় পার করে আসছে। অবস্থা এখন মন্দা চলছে। গত দুই বছর ধরেই বিক্রি অনেক কম। যেহেতু ক্রেতারা লোনের ভরসা পাচ্ছে না, ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে না, এ জন্য যাদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা নেই তারা ফ্ল্যাট কিনতে পারছে না। অথচ আগে যারা সর্বনি¤œ আয় করত তারাও ভাবত ফ্ল্যাট কিনে ফেলবে। এছাড়া চাকরির বাজারও এখন মন্দা। অনেকেই ছাঁটাই হচ্ছে, অনেকেরই পদোন্নতি হচ্ছে না বা বেতন বাড়ছে না। তখনই মানুষ বিনিয়োগে উদ্যোগ নেবে যখন সে দেখবে তার অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আছে কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেগুলো যতদিন স্থির করতে না পারব ততদিন আবাসন খাতের মন্দাভাব কাটবে না।

আমাদের দেশে আবাসন খাতের সম্ভাবনা কতটুকু?

সম্ভাবনা অনেক। মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। সরকার অন্যান্য মৌলিক চাহিদাকে যেভাবে জোর দিচ্ছে তেমনি বাসস্থানকে যদি নিশ্চিত করে তাহলে আবাসন খাত অনেকদূর এগিয়ে যাবে। ঢাকাতে যেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তেমনি ঢাকার বাইরেও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে শহরের মতো গ্রামেও একই সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। এর সম্ভাবনাও অনেক। তাই সব দিক দিয়ে এর সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।

বর্তমান সমস্যাগুলো আসলে কী?

এই খাতে মূল সমস্যা হচ্ছে রাজউকের দীর্ঘসূত্রতা। রাজউক সংক্রান্ত সমস্যা অনেকদিন ধরেই চলছে। এ বিষয়ে মন্ত্রীর সদিচ্ছার অভাব আছে বলে মনে হয় না। তবে আমাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাগুলো কোনোভাবেই সরাতে পারছি না। যেমন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন যে, ৪৫ দিনের মধ্যে লাইন দিতে হবে। তারা খুব ভালো ভালো কথা বলে দেন। কিন্তু কাজটি যারা সম্পাদন করেন তারা ঠিকমতো করেন না।

আমাদের একটি সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে যে, তারা যা বলে দেবে তাই যেন সময়মতো করা হয়। রাজউকে একটি প্ল্যান জমা দেওয়ার পর দেখা যায় তা পাস করতেই এক থেকে দুই বছর লেগে যায়। এগুলো তো কোনো পদ্ধতি হতে পারে না একটি দেশের। প্রতিটি বিষয়েরই একটি টাইম থাকতে হয়। এ রকম হওয়া উচিত যে, এটা তিন মাসের মধ্যে পাস করে দেব। এছাড়া ঘুষ তো আছেই। বলা হয় যে, রাজউকের দেয়ালও পয়সা চিনে। এসব কিছুই আবাসন খাতে অন্তর্ভুক্ত করে নেই।  

আমরা আসলে পয়সা দিয়ে সময় কিনি। আর তা যদি না পারি তাহলে লাভ হবে না। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে এই সময়ের মধ্যে আমরা এই জিনিসগুলো পেয়ে যাব। এতে ক্রেতাদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। দেখা যাচ্ছে ক্রেতাদের ডিসেম্বরে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের কথা, আর গ্যাসও ডিসেম্বরে আসবে। কিন্তু সেই গ্যাস পাচ্ছি মার্চে কিংবা বিদ্যুৎ পাচ্ছি কয়েক মাস পর। এভাবে ক্রেতাদের সঙ্গেও আমাদের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্রেতারাও আমাদের টাকা ঠিকমতো দিচ্ছে না। আমরাও কাজ ঠিকমতো করতে পারছি না। একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কযুক্ত। একটা সমস্যা সৃষ্টি হলে আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর একটা সমস্যার সমাধান হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সব সেক্টরেই অল্প অল্প করে কারেকশন করে আমাদের শুদ্ধ করতে হবে। রাজউক থেকে শুরু করে ওয়াসা, বিদ্যুৎ সব জায়গা যেন সময়মতো সার্ভিস দেয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রেখে এগিয়ে আসতে হবে। আর জমির সমস্যা তো আছেই। বর্তমানে জমির মূল্য এমন একটি পর্যায়ে এসেছে যে, তা বাড়ছে না, আবার কমছেও না। এ ক্ষেত্রে এলাকা বুঝে জমির দাম বাড়ে-কমে। যেখানে জমির মূল্য কম সেখানে ফ্ল্যাটের দাম কম হবে। আর জমির দাম ও কন্সট্রাকশন খরচ অনুযায়ী আমরা ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করি। যেহেতু জমি কম সেহেতু কীভাবে কাজে লাগানো যায় সেটাই ভাবতে হবে।

সরকার অনেক ফ্ল্যাট করছে। সরকার রাজউকের একটি অংশ স্বল্পমূল্যে রিহ্যাবকে দিয়ে দেখুক। আমরা বিক্রি করব রাজউকও বিক্রি করবে। তখন রাজউকের সঙ্গে তুলনা করতে পারব যে, আমরা বেশি নিচ্ছি নাকি রাজউক বেশি নিচ্ছে।

রিহ্যাব বহির্ভূত অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভোক্তা বা গ্রাহকরা প্রতারণার শিকার হচ্ছে। এই প্রতারণা নামিদামি প্রতিষ্ঠানও করে থাকে। যেমন নির্ধারিত সময়ে প্লট বা ফ্ল্যাট পাচ্ছে না। প্রতারণা বন্ধের উপায় কী?

ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে প্রতারণা সাধারণত একই ফ্ল্যাট দুইজনকে দেওয়া হয়ে থাকে। যে ঠিকমতো কিস্তি না দিচ্ছে দেখা যাচ্ছে তাকে একটি চিঠি দিয়ে ফ্ল্যাটটি অপরজনকে দিয়ে দিচ্ছে। এ বিষয়ে প্রথমত ক্রেতাদেরই সচেতন হতে হবে। ক্রেতারা এসে বলে যে, আমরা ওমুক জায়গায় কমে পাচ্ছি আপনারা কেন দিবেন না। ক্রেতাদের সেক্ষেত্রে বোঝা উচিত যে, আমরা কম দামে দিতে পারছি না, অন্য জায়গায় কম দামে দিচ্ছে, তার মানে নিশ্চয়ই এখানে কোনো ঘাপলা আছে। তখনই কিন্তু প্রতারণার বিষয়টি কমে যায়। আমরা একই ফ্ল্যাট দুইজনকে দেই না। যদি ক্রেতা সচেতন হয় তাহলে প্রতারণার কোনো সুযোগ থাকবে না। আর ডেভেলপারদের শুদ্ধ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে রিহ্যাবে অনেক আগে থেকেই একটি গ্রাহক সেবা সেল করেছিলাম। অনেক ঘটনা আমরা সমাধান করেছিলাম। ফ্ল্যাট দুইজনকে দেওয়ার ব্যাপারে ডেভেলপারকে ও ক্রেতা দুইজনকেই ডেকে অমরা সমস্যার কথা জেনেছি। ক্রেতাদের বলে দেই যে, ভুল হয়েছে, ভুল হতেই পারে। আর ডেভেলপারকে বলেছি ওই প্রজেক্টে কোনো ফ্ল্যাট থাকলে দিন কিংবা অন্য প্রজেক্টের ফ্ল্যাট দিয়ে দিতে। এভাবে করলে প্রতারণা আর থাকছে না। কোনোভাবেই আমাদের মনে আনা যাবে না যে, যেনতেনভাবে ক্রেতাকে বুঝিয়ে দিয়ে টাকা কামাব। আমি মনে করি এখন যে ডেভেলপাররা আছে তাদের এ লক্ষণটা একদমই নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে।

এই খাতে সরকারি নজরদারি বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন?

অবশ্য বাড়ানো দরকার। আমি ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে জোর দিয়ে বলেছি। সরকার সুযোগ-সুবিধা দিবে এবং নজরদারিও বাড়াবে। সরকার বলবে যে, আমি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি কিন্তু কেউ নিয়মের বাইরে যেতে পারবে না। তখন আমার মনের মধ্যে এটাই জাগবে যে, আমি তো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি তাহলে কেন আমি নিয়মের বাইরে যাব। আমি ভালো থাকব।

আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সংক্ষেপে জানতে চাই।

১৯৯১ সাল থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম থেকেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের নিয়েই আমরা কাজ করে আসছি। তবে মূল হচ্ছে মধ্যবিত্ত। একসময় ঢাকা শহরে  ৫ থেকে ৮ লাখ টাকায়ও ফ্ল্যাট দিয়েছি। এখন পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেছি। আমার প্রতিষ্ঠানের মূল মার্কেটিং করে ক্লায়েন্টরা। আমি যদি ক্লায়েন্টকে সন্তুষ্ট করতে পারি তাহলে তারা আমার কথা বলবে। তারাই আমার এম্বাসেডর। আমরা এখন ঢাকার বাইরে কাজ করছি। চট্টগ্রামে একটি প্রজেক্ট শেষ করে আরেকটি করছি। সিরাজগঞ্জে একটি প্রজেক্ট করছি। এছাড়া পাশাপাশি আমাদের ফার্ম কুশলী নির্মাণ, স্বাধীনতা টাওয়ার, কৃষি বিজনেস ইনস্টিটিউট, বাপেক্স-এর কন্সট্রাকশন করেছি। এছাড়া অটোরিয়া ও টোটাল সলিউশন নামে দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠান আছে।

ভবিষ্যতের জন্য কী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন?

এই খাতে সরকার কীভাবে কাজ করে তার ওপর নির্ভর করে আমরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করব। এর আগে আমরা অনেক ছোট ছোট ফ্ল্যাট কম দামে দিতে পেরেছি। ভবিষ্যতেও ইচ্ছা আছে এ রকম কম দামে ছোট ছোট ফ্লাট দেওয়া।