logo ১৯ এপ্রিল ২০২৫
নিজেকেই অপমান করেছেন এ কে খন্দকার
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ১৮:৩৫:৫৫
image


মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, সনদ জালিয়াতি, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণসহ নানা বিষয়ে। আলাপচারিতায় ছিলেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ



সাবেক মন্ত্রী এ কে খন্দকারের ‘১৯৭১ : ভেতরে-বাইরে’ বইতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠেছে।

স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসে এ কে খন্দকার সাহেবের মধ্যে এ ধরনের তথ্য বিভ্রাট ঘটার কারণ পরিষ্কার নয়। হতে পারে তিনি বয়সের কারণে মানসিকভাবে ভারসাম্য হারাতে বসেছেন। কিন্তু তাই বলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ হেয় করে কিছু লিখতে বা বলতে পারেন না। এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে অপমানিত করেছেন।

৪৩ বছর পর এসে লেখা বইতে এ ধরনের তথ্য তিনি কেন লিখতে পারেন বলে মনে করেন?

যখন আন্তর্জাতিক জঙ্গিচক্র, আইএস, আল কায়দা বাংলাদেশকে লক্ষ্যবস্তু করার চেষ্টা করছে, তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করলেন। এর পেছনে বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। তবে সংসদে এ ঘটনার সমালোচনায় সদস্যরা বলেছেন, খোন্দকার মুশতাকদের পাশে আরেকটি নাম যুক্ত হলো। সেটা হচ্ছে এ কে খন্দকার।

৭ মার্চের ভাষণে কি বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন?

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে আমি উপস্থিত ছিলাম। আমরা কেউ শুনলাম না, কিন্তু দূরে বসে রেডিওতে শুনলেন এ কে খন্দকার। এটা কী বিশ্বাসের কথা? তাছাড়া লাখ লাখ মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছে। আর তো কেউ এ কথা কোনোদিন বলেনি।

মুক্তিযুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছিল না বলে বলা হয়েছে বইতে।

প্রস্তুতি না থাকলে এতবড় সংগ্রাম হলো কী করে? এই পল্টনে ইব্রাহিম ম্যানশনে বিচারপতি ইব্রাহিম সাহেবের একটা আমবাগান ছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধু আমাদের সবাইকে নিয়ে জড়ো হয়ে মাটি ছুঁয়ে শপথ করিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ আমি করেছি তার শাস্তি ফাঁসি। ক্ষুদিরামের মতো আমারও ফাঁসিতে ঝুলতে হতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমি তাতে রাজি আছি। কিন্তু যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে আমার মৃত্যুর পরও তোমরা তা চালিয়ে যেও।

যখন দায়িত্ব নিলেন তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ঘিরে অনেক বিতর্ক। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

হয়ত পরিস্থিতিটা একটু ভিন্ন। তবে আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছি। জীবনে পরাজয়ের ইতিহাস কম। মুক্তিযুদ্ধ করেছি। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে কাজ করব।

মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে স্বয়ং একই মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে...

আসলে জালিয়াতি সব জায়গায়ই কম-বেশি হচ্ছে। তবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব নিয়ে জালিয়াতি নিঃসন্দেহে দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত। এ ধরনের কাজ কখনই মেনে নেওয়ার মতো নয়।

অভিযুক্ত সচিবদের ব্যাপারে আপনারা কী ব্যবস্থা নেবেন?

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদন এবং সুপারিশ দেখে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও চান বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান হোক।

সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ায় তারা পার পেয়ে যেতে পারেন বলে অনেকে অভিযোগ তুলছে।

অনেকে নানা কথা বলতে পারে। কিন্তু পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে।

সনদ জালিয়াতির অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধে। এই পাঁচ সচিবের বিষয়টি গুরুত্ব পেল কেন?

পত্রপত্রিকায় তাদের বিরুদ্ধে সংবাদ এসেছে। সেগুলোর ভিত্তিতেই আমরা বিষয়টি তদন্তের জন্য দুদকের কাছে পাঠিয়েছি। আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে কিছু করিনি।

সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অতীতে এ ধরনের তদন্তের নজির নেই।

১৯৭১ সালে তারা কেউ সরকারের কর্মকর্তা ছিলেন না। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক ছিলেন। দুদকের তদন্তে সেই বিষয়টিই দেখা হয়েছে। এখানে কে সচিব, কে মন্ত্রী তা দেখার সুযোগ নেই।

এর বাইরেও তো অনেক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সনদ জালিয়াতির অভিযোগ আছে।

অভিযোগ তো অনেকের বিরুদ্ধে থাকতে পারে। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অভিযোগ প্রমাণ হতে হবে। ইতিপূর্বে যাদের অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে তাদের সনদ বাতিলসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যারা ভুয়া সনদ দেখিয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন তাদের কাছ থেকে তা ফিরিয়ে নেওয়া হবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ নিয়ে জালিয়াতি বন্ধের উপায় কী?

আসলে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না কীভাবে এই জালিয়াতি পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে। তবে আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) অনুমোদন ছাড়া কাউকেই সনদ দেওয়া হচ্ছে না। কোনো ধরনের সুপারিশও গ্রহণযোগ্য হবে না।

স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসেও অনেকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। এই প্রক্রিয়ার শেষ কোথায়?

এরই মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে। আর কেউ নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার সনদ কিংবা গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন না। এই আবেদন করার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে।

নতুন আবেদনকারীরা কবে সনদ পাবেন?

নতুন আবেদনগুলো উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে প্রকাশ্যে সবার সামনে এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে। এক্ষেত্রে জালিয়াতির কোনো সুযোগ থাকবে না। সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর।

সনদের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ঠিক করে দেওয়া চার মানদ- মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।

এখন আর এ ধরনের অভিযোগ থাকার কথা নয়। কারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে কাউকেই সনদ বা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।

মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধুদের সম্মান জানাতে দেওয়া স্মারক ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতি হয়েছে। কীভাবে দেখছেন?

আসলে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই ঘটনা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে এ ব্যাপারে খুব বেশি মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। কারণ এখনো বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। তদন্ত শেষ হলেই বোঝা যাবে আসলে কী হয়েছে।

 নতুন ক্রেস্ট দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা কি আছে?

না, এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই। তদন্ত শেষ হোক। পরে কমিটির সুপারিশ দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা কি সরকারের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলছে না?

যেকোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিই সরকারের জন্য নেতিবাচক। এটা সরকারের ভাবমূর্তি কিছুটা নষ্ট করেছে। তবে আমরা তো দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দিচ্ছি না। দুর্নীতি-অনিয়ম হলে তা সহ্য করা ঠিক নয়। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এটাই সুশাসন।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অনেক সম্পদ। কিন্তু তারপরও তারা সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করতে পারছেন না কেন?

আসলে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের যেসব সম্পদ দিয়ে গিয়েছিলেন তা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যেত তবে তাদের অসচ্ছলতা বলতে কিছু থাকত না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পদ ভোগদখল করছে অন্যরা। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছি। বেদখলে থাকা সম্পদগুলো দখলে আনার চেষ্টা চলছে। আশা করি শিগগির আমরা একটা ভালো জায়গায় যেতে পারব।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে বলে আপনি মনে করেন?

আসলে তারা আমার সহকর্মী। আমি তাদের সঙ্গেই কাজ করি। সংসদের নতুন নেতৃত্বের বয়স তো বেশিদিন হয়নি। দেখা যাক সামনে অনেক সময় আছে। আশা করি তারা ভালো কাজ করবে।

অতীতে যারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ছিলেন তারা অনেক বিতর্ক নিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তো আপনার সুনাম আছে।

অতীতে কে কী করেছে তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। তবে আমার ব্যাপারে বলতে পারি, সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রেখে দেশের স্বার্থে কাজ করব। রাজনৈতিক অঙ্গনে আমার যে সুনামের কথা বলছেন, মন্ত্রী হিসেবেও শেষ পর্যন্ত তা রাখতে পারব বলে বিশ্বাস আছে।

বিএনপি বলছে এই সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছে।

কেউ যদি নিজেদের ভুলের কারণে পস্তায় তার দায় তো সরকার নিতে পারে না। বিএনপি নির্বাচনে না এসে যে ভুল করেছে এর খেসারত তাদের দিতে হচ্ছে। তাছাড়া সব নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এটা তো ঠিক নয়। আমরা তো বিএনপিকে ডেকেছিলাম। তারা আসেনি।  

৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলা হয়...

১৯৭০ সালের নির্বাচনে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যাননি। তাই বলে কি ’৭০ সালে নির্বাচন হয়নি? যদি ৫ জানুয়ারি নির্বাচন না হতো তাহলে সামরিক শাসন কিংবা তৃতীয় পক্ষ ক্ষমতায় আসত। সেটা তো কারো জন্যই ভালো হতো না। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে তা নিয়েও তো প্রশ্ন আছে।  এই সময়ের সৌজন্যে