logo ১৯ এপ্রিল ২০২৫
এ কে খন্দকারের সব অর্জন শেষ হয়ে গেছে: আবু ওসমান চৌধুরী
১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ১৪:১৩:৫০
image


মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) মেজর। ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারও ছিলেন সম্মুখ সমরের এই যোদ্ধা। তিনিই প্রথম বাহিনীসহ পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করেছিলেন। চুয়াডাঙ্গায় হয়েছিল মুখোমুখি সেই যুদ্ধ। এর আগে একাত্তরের ৬ মার্চ আবু ওসমান চৌধুরী মেঘনার ওপারে কুষ্টিয়া থেকে বরিশাল জেলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন নাম দেন। ওই রণাঙ্গনের অধিনায়কও ছিলেন তিনি। সম্প্রতি তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের চেয়ারম্যান এ কে খন্দকারের লেখা বইয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কসহ একাত্তরের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন। আলাপচারিতায় ছিলেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ



৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে নতুন বিতর্ক তুলেছেন এ কে খন্দকার।   

আবু ওসমান চৌধুরী : এ কে খন্দকার তার বইটিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এতকিছু লেখেছেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যা বলেছেন সব আছে তাতে। আর তিনিই বলছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে জয় পাকিস্তান বলেছেন। এটা কি কোনো পাগলেও বিশ্বাস করবে?

এটা তিনি কেন করেছেন বলে মনে করেন?

আবু ওসমান চৌধুরী : কাজটা হয়েছে খুব কাঁচা। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির পক্ষ নিতে চেয়েছেন খন্দকার সাহেব। কিন্তু কৌশলে নিতে পারেননি। কাজেই তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। তার সব অর্জন শেষ হয়ে গেছে। তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে না গেলেও বীর উত্তম উপাধি পেয়েছেন। কিন্তু ওই সম্মান তিনি ধরে রাখতে পারেননি।

তার মানে বীর উত্তম খেতাব নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন?

আবু ওসমান চৌধুরী : ওসমানী সাহেব সব অন্যায়ভাবে করেছেন। সবাইকে খুশি করতে চেয়েছেন। বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিও সবাইকে ভাগাভাগি করে দিয়েছেন। সেনাবাহিনীতে তিনটি, বিমানবাহিনীতে একটি,  নৌবাহিনীতে একটি, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) দুটি দেওয়া হয়েছে। সবাইকে সন্তুষ্ট করতে এটা করা হয়েছে। এটা তো ঠিক নয়।

এ কে খন্দকারকে ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করেন?

আবু ওসমান চৌধুরী : অবশ্যই তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবহার আমি কেনই বা বলব? তিনি জেনেশুনেই তো এ কাজে হাত দিয়েছেন। তিনি তো অবুঝ নন। যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও ধীরস্থির চিন্তাধারার একজন লোক। কারণ তিনি যুদ্ধ বিমানের পাইলট ছিলেন। বিমান যারা চালান তাদের খুব শান্তমস্তিষ্কের হতে হয়। তা না হলে পাইলট হতে পারেন না। তিনি লোভে পড়ে অথবা বাধ্য হয়ে এ কাজ করেছেন।

তাকে বাধ্য করা কি সম্ভব?

আবু ওসমান চৌধুরী : বাধ্য করার কয়েকটি উপায় আছে। সব চেয়ে বড় মাধ্যম অস্ত্র। এখন অস্ত্র দিয়ে মারলে কোনো লাভ হবে না। বরং অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে এ কাজ করা হতে পারে। বলা হতে পারে, কথা না শুনলে নির্মমভাবে মরতে হবে। আর একটি উপায় হলো ধন সম্পদের লোভ দেখিয়ে।

এ কে খন্দকার কি ধন সম্পদের লোভে এটা করবেন বলে মনে করেন?

আবু ওসমান চৌধুরী : তার তো ধন সম্পদের অভাব নেই। এয়ার ভাইস মার্শাল হিসেবে অবসরে গেছেন। সেখানে যে টাকা পাচ্ছেন তাই অনেক বেশি। তার ওপর তিনি মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ছিলেন। টাকা-পয়সার ওনার অভাব নেই। তবে অনেকে বলেন, যার টাকা-পয়সা বেশি, তার লোভও বেশি। এখন তিনি কোনটার শিকার হয়েছেন আমি বলতে পারি না। তবে এই বয়সে তার এ ধরনের অপকৌশলের শিকার হওয়ার কথা নয়।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম কি তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে?

আবু ওসমান চৌধুরী : তাৎক্ষণিকভাবে তো আমরা বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছি। এখন ফোরাম থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে। আমরা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাধারণ বৈঠক করে তাকে বহিষ্কার করব।

ফোরামের সংবিধান বলছে তিনি আজীবন সেখানে থাকতে পারবেন।

আবু ওসমান চৌধুরী : এ রকম পরিস্থিতি আসবে কেউ তো কল্পনাও করেনি। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে, সমাধানও সেভাবেই হবে। আমাদের আইনবিষয়ক উপদেষ্টা আছেন। তার পরামর্শ নিয়েই কাজ করব।

আপনি কি ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে ছিলেন?

আবু ওসমান চৌধুরী : না, আমি তখন ছিলাম চুয়াডাঙ্গায়। আমরা রেডিও চালু করে অপেক্ষায় ছিলাম ভাষণ শোনার। কিন্তু সেদিন তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর যখন আন্দোলন শুরু হয়ে গেল, যখন বাঙালিরা সব অফিস-আদালত বয়কট করা শুরু করল তখন পরদিন ভাষণটি পুনঃপ্রচার করা হয়। এটা আমাদের রেকর্ড করা ছিল।

লেখকের পাশাপাশি প্রকাশকের কি এ ব্যাপারে কোনো দায় নেই?

আবু ওসমান চৌধুরী : প্রকাশকের চেয়ে লেখকের দায় বেশি। কারণ সে নিজে বুঝেশুনে লিখেছেন। খন্দকার সাহেব সব সময় ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করেছেন। বাংলায় ওনার দখল কম। বাংলা বললেও খুব ভালো করে বলতে পারেন না। এই বই লেখার মতো বাংলা বিদ্যা তার আছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

তাহলে কি তিনি বই লিখতে পারেন না?

আবু ওসমান চৌধুরী : অবশ্যই লিখতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সমালোচনা করার মতো কী ধরনের জ্ঞান আছে আমাদের? কিছুই নেই। কারোই নেই। কিন্তু তিনি করেছেন। ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেই ‘জয় বাংলা’ এসেছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে, সেই জয় বাংলাকে তিনি খর্ব করেছেন। এসব ঘৃণিত কাজ তিনি করেছেন।

বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় এ কে খন্দকার লিখেছেন ‘জয় পাকিস্তানের আগে বঙ্গবন্ধু জয় বাংলাও বলেছিলেন।’

আবু ওসমান চৌধুরী : এটা পুরোপুরি মিথ্যা। এখন তিনি বিভিন্ন কথাবার্তা বলে জোড়া লাগাতেন চাইছেন। তাছাড়া পাকিস্তানের স্লোগান তো ছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। এখানে ‘জয় পাকিস্তান’ এলো কোত্থেকে?

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি বলে উল্লেখ করা হয়েছে ‘১৯৭১ : ভেতরে-বাইরে’ বইতে।

আবু ওসমান চৌধুরী : ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল আমাদের জন্য সবুজ সংকেত। তখন আমি চুয়াডাঙ্গার ফোর্স কমান্ডার। তখনকার ইপিআরের উইং কমান্ডার ছিলাম। ২৬ মার্চ যখন শুনলাম ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের হত্যা শুরু করেছে, তখনই বিষয়গুলো আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। বুঝে গেছি, সময় এসে গেছে।

ইতিপূর্বে কখনও এ কে খন্দকারকে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কিছু বলতে শুনেছেন?

আবু ওসমান চৌধুরী : না। কখনই না। তিনি আমাদের সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠান করেছেন। কিন্তু কখনও এসব বলেননি। কিন্তু হঠাৎ করে কেন এটা বললেন তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এই জাতি কখনই খন্দকার সাহেবকে ক্ষমা করবে না। তার উচিত দ্রুত এর জন্য ক্ষমা চাওয়া।



বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলেন?

আবু ওসমান চৌধুরী : কারো সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। কোনো নির্দেশনাও ছিল না, একমাত্র ছিল ৭ মার্চের ভাষণ। ভাষণটি পুরোপুরি আবার শুনলাম। দেখলাম এতে স্বাধীনতার ঘোষণা আছে। যুদ্ধ কীভাবে করব তাও বলা আছে। বলা হয়েছে, ‘যার যা আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’

শুরুটা কীভাবে করলেন?

আবু ওসমান চৌধুরী : ছাত্র, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী সবাইকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলাম। সেখানে আলোচনা  হলো যে, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমাদের পরাভূত করতে পারবে না। কারণ নির্বাচনে তো আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলাম। এটা তারা চায়নি বলেই শেষ পর্যন্ত এই গণহত্যা চালিয়েছে।

পাকিস্তানিরা কি আগে থেকেই যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিল?

আবু ওসমান চৌধুরী : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সংলাপের উদ্দেশ্য ছিল সময়ক্ষেপণ করা। কারণ তারা যুদ্ধের পরিকল্পনা করছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সৈন্য আনা শুরু করেছিল। এটা বঙ্গবন্ধু ও সাধারণ মানুষও জানত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর তো কিছু করার ছিল না। একমাত্র সংলাপ করে যদি সমঝোতা করা যায় সেই চেষ্টা করেছিলেন।

কেন সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু?

আবু ওসমান চৌধুরী : মুখোমুখি যুদ্ধের সামর্থ্য বাঙালিদের ছিল না। কারণ ছিল না কোনো অস্ত্র, প্রশিক্ষণও। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা আগে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিরা বিদ্রোহের মনোভাব গড়ে তুলেছিল। এটাই ছিল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। তাই বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করা যায় কি না। কিন্তু সেই সুযোগ পাকিস্তানিরা দেয়নি।

সেই সুযোগ কেন দেওয়া হয়নি?

আবু ওসমান চৌধুরী : টিক্কাখান তখন ইয়াহিয়াকে বলেছিল আপনি বলুন, আমি তিন-চার লাখ মানুষ মেরে দিয়ে বাঙালিদের বুঝিয়ে দেই বিদ্রোহের শাস্তি কী হতে পারে। তারা আর কখনই বিদ্রোহের নাম মুখে আনবে না। এজন্যই তারা সংলাপের সুযোগ দেয়নি। তারা বুঝতে পারেনি মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা জন্মেছে। একতার বোধশক্তি যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছেÑএটা তারা চিন্তা করতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধু তো সেদিন নিজের বাড়ি থেকে কোথাও যাননি...

আবু ওসমান চৌধুরী : বঙ্গবন্ধু সেদিন আন্ডারগ্রাউন্ডেও যাননি। কিন্তু সব নেতাকে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু জানতেন যে নেতৃত্ব তিনি গঠন করেছেন, তারা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানেও কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন। আর তিনি যদি গা-ঢাকা দিতেন, তবে পাকিস্তানিরা ঢাকার প্রতিটি ঘরে তল্লাশি চালাত বঙ্গবন্ধুকে পাওয়ার জন্য। এতে মানুষের অনেক ক্ষতি হতো। এই কথা চিন্তা করে তিনি আর গা ঢাকা দেননি।  

আপনি তো বেসামরিক লোকদের নিয়ে পাকিস্তানিদের মোকাবেলা করেছিলেন...

আবু ওসমান চৌধুরী :  কোয়ার্টার গার্ডে এসে আমি প্রথমে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেললাম। তারপর আমাদের বানানো পতাকা উড়িয়ে রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার দিয়েছি। আমিই প্রথম ফোর্স নিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করেছি। জেলার হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ করে দুইদিনের যুদ্ধে তাদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাতদিনের মধ্যে একাত্তরের ১ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে শত্রুমুক্ত করেছি।

-এই সময়ের সৌজন্যে