logo ১০ মে ২০২৫
জিপিএ-৫ আর শিক্ষার গুণগত মান এক নয়
০২ অক্টোবর, ২০১৪ ১৪:০৯:২৪
image


পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া আর শিক্ষার গুণগত মান এক নয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার মান নির্ণয় করা যায় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ও শিক্ষার সার্বিক মান নিয়ে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের মুখোমুখি হয়েছেন অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহিউদ্দিন মাহী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে। বিষয়টি নিয়ে বলুন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল করেছে এটি ঠিক নয়। মূল বিষয়টি হল যারা এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছে তারা সবাই মেধাবী। কিন্তু এই মেধাবীদের মধ্য থেকে আরও বেশি মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করতে হয়। এজন্য অনেকে বাদ পরে।

কেন এমনটি হল?

আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য বাছাই পরীক্ষা নিয়ে থাকে। আমাদের প্রধান টার্গেটই থাকে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে আমরা বাদ দিবো। কারণ আমাদের আসন সংখ্যা সীমিত। এজন্য আমাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী পাস করলেই হয়। এবারও তো আমাদের প্রয়োজনীয় আসনের চেয়েও বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে। এটা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।

অনেকে বলছেন প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে। আপনার মত কী?

প্রশ্ন কঠিন হয়েছে এ অভিযোগ আসলে ঠিক নয়। শিক্ষার্থীরাও বলেছে, প্রশ্ন তেমন কঠিন হয়নি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা তো একটু উঁচু মানের হবে এটাই তো স্বাভাবিক।  

ইংরেজি বিষয়ে দুইজন পাস করল। বিষয়টি কী অস্বাভাবিক নয়?

আসলে আমরা প্রতি বছরই পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করি।  এবছর ইংরেজি বিষয়ে পড়তে আগ্রহীদের জন্য ইলেকটিভ ইংলিশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এরআগে সবাই জেনারেল ইংরেজি বিষয় উত্তর দিতো। তবে ইলেকটিভ ইংরেজি বিষয়টি আগেও ছিল, সেটা ছিল ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু এবার আমরা ইলেকটিভ ইংরেজি বিষয়টি শুধু ইংরেজি সাবজেক্টে যারা ভর্তি হতে চাইবে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছি। এরফলে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছে।

ইংরেজি বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী তো আপনারা পাচ্ছেন না। কি করবেন?

আগামী ১৪ অক্টোবর জেনারেল অ্যাডমিশন কমিটির বৈঠক আছে। ঐ বৈঠকে ইংরেজি বিভাগের জন্য যারা সাধারণ ইংরেজিতে ভাল করবে তাদের মধ্য থেকে আমরা শিক্ষার্থী নিবো। এটা মোটামুটি চূড়ান্ত করেছি। পুরো বিষয়টি ১৪ অক্টোবর ঠিক হবে।

এবার তো অনেক আসন খালি থাকবে। কারণ অনেকে শর্ত পূরণ করতে পারছে না।

আমরা শিক্ষার্থীদেরকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো আসন খালি থাকবে না। কারণ আমাদের প্রয়োজনীয় আসনের চেয়ে শিক্ষার্থী পাসের হার বেশি। সুতরাং এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।

সর্বোচ্চ জিপিএ পেয়েও শিক্ষার্থীরা ফেল করছে। এটি কি শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্য দশা বলে আপনার মনে হয়?

সর্বোচ্চ জিপিএ -৫ পাওয়া আর গুণগত শিক্ষার মান এক কথা নয়। শিক্ষার মান নিশ্চিত করা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। মানটিও সেভাবেই বাড়ে। এটা নির্ধারণের কোনো মানদণ্ড নেই।

শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে করণীয় কী?

আগেই বলেছি শিক্ষার মান নিশ্চিত করা একটা চলমান প্রক্রিয়া। একজন শিক্ষক কখনও শিক্ষার মান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। মান ভাল করার জন্য সে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায়। ফলে শুধু ভাল ফলাফল করলেই যে শিক্ষার মান উঁচুতে উঠবে সেটা ঠিক নয়। তবে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। জালিয়াতি বন্ধ করতে হবে।

জালিয়াতি বলতে কী বুঝিয়েছেন?

জালিয়াতি বলতে ইদানিং পাবলিক পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। একারণে অনেক শিক্ষার্থী পড়া-লেখা না করেই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে যায়। আবার অনেকে দিনরাত লেখাপড়া করেও ভাল ফলাফল করতে পারে না। সুতরাং এই জালিয়াতি ও অবৈধ পন্থা বন্ধ করতে না পারলে শিক্ষার মান ভাল করা যাবে না। সমাজের দুষ্ট চক্রকে প্রতিরোধ করতে হবে।

এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফলধারীদের রেকর্ড সংখ্যক ফেল করায় অনেকে সার্বিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মত কী?

আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার মান যাচাই করা ঠিক হবে না। কারণ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা একটু কঠিনই হয়। মান উঁচুতে রেখেই প্রশ্নপত্র প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়।

বেশ কয়েক বছর যাবৎ সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষা হচ্ছে। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে হয়েছে। অনেকেই বলছেন, সৃজনশীল পদ্ধতি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্যাটার্ন এক নয়। যার কারণে এই খারাপ ফলাফল হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

আসলে এ অভিযোগ মোটেও সত্ত্ব নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রশ্নপত্র তৈরি করে তখন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের অধিকাংশ সৃজনশীল প্রশ্নপত্রকেই অনুসরণ করে থাকে।    

এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থী জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। এটি রোধে করণীয় কী?

মানব সমাজে অপরাধ থাকবে না, এটা কামনা করা যায় না। প্রত্যেকটা সমাজেই কিছু দুষ্কৃতিকারী থাকে। তাদের বিরুদ্ধে যদি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় তাহলে এটি অনেকটা কমে আসে।

এবার তো আপনার বেশ কিছু জালিয়াত চক্রের সদস্যদের ধরেছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। এটাই কি যথেষ্ট বলে আপনি মনে করেন?

এবার যে জালিয়াতিটা হয়েছে সেটা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে। এটা রোধ করতে হলে আমাদের আইনটাকে আরও শক্তিশালি করতে হবে। বিদ্যমান আইনটি দুর্বল বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। আর এ কারণে অনেকে অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। আমরা জালিয়াত চক্রকে আটক করে পুলিশের কাছে সপর্দ করেছি। তারা আইনী প্রক্রিয়া টা দেখবেন। এছাড়া তো আমাদের কিছু করার নেই। কারণ তারা তো এখনও আমাদের শিক্ষার্থী হয়নি।

আইনটি কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

তথ্য-প্রযুক্তির বিদ্যামন আইনটা সংস্কার করে নূন্যতম একজন অপরাধীর ১০ বছর সশ্রম কারাদ- হওয়া উচিত। আর অপরাধী যেন জামিন না পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এটির ভাল ব্যবহার যেমন আছে। তেমনি এটির খারাপ ব্যবহারও আছে। তাই এটি যেন খারাপভাবে ব্যবহার না হতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

আর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আমরা আরেকটি বিষয়কে প্রাধ্যন্য দিচ্ছি যারা এই ধরনের অসৎ কাজ করে ধরে পড়েছে তারা যেন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হতে না পারে সেটির ব্যবস্থা করা। এছাড়া জালিয়াতি করে কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিও হয়ে যায়। তাহলে যেই পর্যায়ে এসে আমরা জানতে পারবে সেখান থেকেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা ত্রুটিপূর্ণ। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

শিক্ষামন্ত্রী এটা বলতেই পারেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময়ই মুক্তমনের চর্চা করে। এখানে নতুনকে গ্রহণ করা হয়। ভুলকে সংশোধন করার মানসিকতা লালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং শিক্ষামন্ত্রী যদি নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন যে ঐ জায়গা সমস্যা সেটা আমরা সমাধান করবো। তবে ঢালাও কথা বলা সমীচীন নয় বলে আমি মনে করি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তির বিষয় চিন্তা করা হচ্ছে বলে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

এই পদ্ধতি নিয়ে আরও আগেই আলোচনা হয়েছিল। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ঐ আলোচনায় অংশ নিয়েছে। আমিও সেখানে ছিলাম। বিষয়টি নিয়ে আমি আমাদের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা করেছি। কিন্তু অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সেটিতে মত দেয়নি। কারণ সকল বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিত পরীক্ষা নিলে জালিয়াতি আরও  বেশি হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রত্যাবেক্ষণ মানটা আর ধরে রাখা যাবে না। সেটি হবে অত্যন্ত দুরূহ কাজ।

প্রত্যাবেক্ষণ মান কেন ধরে রাখা যাবে না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় যারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে তারা মূলত বাইরের সেন্টারগুলোতে ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রগুলোতে তারা সেটি করতে সাহস পায়নি। প্রত্যেকটি সেন্টারেই আমাদের নিজস্ব টিম থাকে । তারা সকল কিছু মনিটরিং করে। এর মধ্যেও জালিয়াতি হয়ে থাকে। আর যদি সমন্বিত পরীক্ষা হয় তখন তো জেলা উপজেলাগুলোতেও পরীক্ষা নিতে হবে। তখন ঢালাওভাবে এই জালিয়াতি হবে। সে কারণেই বলছি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যাবেক্ষণ মানটা তখন নিশ্চিত করা কঠিন হবে।

মেডিকলে কলেজগুলোতে সমন্বিত পরীক্ষা হয়। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কেন নয়?

মেডিকেল কলেজগুলোতে সমন্বিত পরীক্ষা চালুর বিষয়ে আমরাই মত দিয়েছিলাম। কারণ মেডিকেলটা হলো একটি মাত্র ডিসিপ্লিনের শিক্ষা ব্যবস্থা। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মাল্টি ডিসিপ্লিনের শিক্ষা ব্যবস্থা। এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় ৪০টিরও বেশি ডিসিপ্লিনে লেখা পড়া হয়। সেটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা খুবই কঠিন হবে বলে আমি মনে করি।  

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, পাবলিক পরীক্ষায় পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

এটির সাথে আমি একমত নই। কারণ পাবলিক পরীক্ষায় ভালফল করা আর বিশ্ববিদ্যালয় ভাল ফলাফল করা আলাদা বিষয়। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেই ছেলেটি ক ইউনিটে প্রথম হয়েছে সে এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায়নি। কিন্তু অনেকে জিপিএ-৫ পেয়েও পরীক্ষায় ফেল করেছে। তাহলে এখানে পরীক্ষা না থাকলে মেধা কীভাবে যাচাই হবে?

ভাল ফলাফল করে যারা পরীক্ষা দিল কিন্তু তারা কী তাহলে মূল্যায়ন পাবে না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দুইটি বিষয়কে সমন্বয় করে প্রকাশ করা হয়। একটি হল এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। আরেকটি হল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল। এখানে ভাল ফলাফলধারীরাও কিন্তু মূল্যায়িত হচ্ছে। ফলে ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়া এবং আমাদের শিক্ষার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্নর তোলার অবকাশ নেই।

শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিবর্তন করার কথা বলেছিলেন। সেটিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

আগেই বলেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব সময়ই ইতিবাচক পরিবর্তনের পক্ষে। বিশ্ববিদ্যায় ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশ ধারা পরিচালিত হয়। এটির অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা রয়েছে। তবে পরিবর্তন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানকে আরও উন্নয়নের জন্য করা হয় তাহলে সেটা আমরা মেনে নিবো।