logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
আমি পুড়ব কবে?
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ০০:০৬:৪১
image

উত্তরা থেকে বলাকা পরিবহনের একটি বাসে করে মগবাজার আসছিলাম। হরতাল-অবরোধে যখন চারদিকে পেট্রল বোমায় দগ্ধ হওয়ার আতঙ্ক, তখন ফাঁকা সড়কের বুক চিরে গাড়ি বেশ দ্রুত গতিতে গন্তব্যের উদ্দেশে চললেও দারুণ অস্বস্তি মনে। বাসের যাত্রীদের চোখেমুখেও একই আতঙ্কের ছাপ।


সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা সময় দেশের এখানে-সেখানে বাস-ট্রাক-অটোরিকশায় পেট্রল বোমা হামলায় মানুষ ঝলসে যাওয়া, কারও কারও মৃত্যু দিনভর তাড়িয়ে বেড়ায় মানুষকে। একই আতঙ্ক হঠাৎ চেপে বসল আমার মনে। আশপাশের আসনে বসা যাত্রীরাও কথা বলছিল একই বিষয়ে। সব শুনে ভয়টা জেঁকে বসল আরও। জানি না, কখন অতর্কিত ছুটে আসা পেট্রল বোমা ঝলসে দেবে রক্তমাংসের জীবন্ত শরীরটাকে।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের দগ্ধ রোগীদের দগদগে ঘা চোখে ভাসতেই শিউরে উঠছিলাম। মনের অজান্তেই হাত দুটো গুটিয়ে নিচ্ছিলাম জামার আস্তিনে। কেবল বলছিলাম আমি দগ্ধ হতে চাই না। চাই না বার্ন ইউনিটের সাদা বিছানায় শুয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে। কে চায় বলুন? যারা বোমা ছুঁড়ছেন তারাও কি চাইবেন ঝলসে যাওয়ার চামড়ার নিচ থেকে ভেসে উঠুক দগদগে ঘা? চোখ বুজেই বলা যায়, ‘না’।


খানিক সময়ের জন্য চোখ দুটো বুজে আসছিল, অমনি বাসযাত্রীদের চিৎকারে চোখ মেলেই দাঁড়িয়ে গেলাম আসন থেকে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই দেখলাম গেটের কাছে থাকা এক যাত্রী চলতি বাস থেকে সজোরে লাফ দিলেন সড়কে। কী হয়েছে? পাশে বসে থাকা যাত্রী বলে উঠলেন আগুন, আগুন? কিন্তু কোথায়? দেখলাম, বাসের মাঝখানে থাকা মধ্যবয়সী একজন নিজের বুক পকেট চাপড়াচ্ছেন। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে ধোঁয়া। নাকে কিছুটা বারুদ-পোড়া গন্ধও আসছে। ভয় পেয়ে গেলাম আমি নিজেও। কী করব বুঝতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। পরে সব জানতে পেরে বাঁচলাম হাফ ছেড়ে।


জানতে পারলাম, ওই ব্যক্তির বুক পকেটে থাকা দিয়াশলাই থেকে ঘটেছে এই কাণ্ড। ঘষায় ঘষায় বারুদ থেকে জ্বলেছে আগুন। তা দেখেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বাসযাত্রীরা। পেছন থেকে একজন একটু উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘আহারে না বুঝেই এক লোক ঝাঁপ দিয়েছে চলতি বাস থেকে। না জানি কী অবস্থা তার।’ অবস্থা জানার উপায় নেই। কারণ ওই যাত্রী যখন ঝাঁপ দিয়েছিলেন তখন বাস ছিল বনানী-চেয়ারম্যানবাড়ির মাঝামাঝি। আর এখন মহাখালীতে।


যাত্রীদের অনেকেই দুষছিলেন পকেটে আগুন ধরে যাওয়া লোকটিকে। ‘বুঝলেন ভাই, এই আপনাদের মতো কিছু আহাম্মক গোছের লোকের কারণে মানুষ বিপদে পড়ে। কী আতঙ্কই না ছড়িয়ে দিলেন মুহূর্তে।’ বলছিলেন এক যাত্রী।


এবার আর চুপ করে রইলেন না বুক পকেটে আগুন লাগা যাত্রী। ‘ভাই আমার যন্ত্রণা কি আপনি বুঝতে পারছেন? আগুন লেগে আমার শার্ট পুড়েছে, বুকের চামড়া পুড়েছে। এই দেখুন কী অবস্থা।’ বলেই নিজের দগ্ধ বুক এগিয়ে দিলেন সামনে। ‘হ্যাঁ, তাই তো বেশ পুড়ে গেছে।


ভাই, এতটুকু পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণাই সইতে পারছেন না, একবারও কি ভেবে দেখেছেন যাদের শরীরের অর্ধেকের বেশি পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে তাদের যন্ত্রণা কী হতে পারে?’ বলছিলেন আরেক যাত্রী। বোঝা গেল বার্ন ইউনিটে পোড়া যাত্রীদের কষ্ট ছুঁয়েছে গোটা দেশের মানুষকে।


চোখে ভারী চশমা এঁটে বসে থাকা মাঝবয়সী একজন একবুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সারাক্ষণ আতঙ্ক। বুকটা ধক করে ওঠে। কেন জানি মনে হয়, এই বুঝি অবরোধ-হরতালের আগুন তাড়া করছে আমায়। কে জানে, আমি পুড়ব কবে।’


৮-৯ বছরের এক ছেলে একবোঝা পত্রিকা নিয়ে অপেক্ষা করছিল মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের পাশেই। একটু গতি কমিয়ে আনতেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল বাসটিতে। একটি দৈনিক পত্রিকা মেলে ধরে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিল সে। আর দৃষ্টি তো সবার ওইদিকে যাবেই। কারণ পত্রিকার প্রথম পাতার বড় একটি অংশজুড়ে ছাপা হয়েছে আগুনে পুড়ে যাওয়া একজনের মুখ, তার পাশে ব্যান্ডেজ মোড়ানো শরীরের ছবি। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে চলন্ত বাসে ছোড়া পেট্রল বোমায় ঝলসে যাওয়াদের ছবি এটি। দুর্বৃত্তরা ওই রাতে এক বাসে হামলা করেই হত্যা করেছে সাতজনকে। মরদেহগুলোর অবস্থা এতটাই বীভৎস ছিল যে, চাইলেও পত্রিকার পাতায় তুলে আনা যায়নি সেগুলো। কিন্তু মোটা হরফে ঠিকই লেখা হয়েছে নিহতদের কথা।


পত্রিকা হাতে নিয়ে এক যাত্রী বিলাপ শুরু করেছেন অজান্তেই। ‘এরা কি মানুষ? মানুষ হয়ে মানুষকে এভাবে পুড়িয়ে মারা যায়? হায় আল্লাহ এ কোন দেশে পাঠাইলা। আমাদের কি মনুষ্যত্ব বলতে কিছুই রইল না?’ ওই যাত্রীর প্রশ্নগুলোর উত্তর কারো জানা নেই।


একজন সাহস করে বললেন, ‘এই আমরাই আমাদের ভাগ্যের জন্য দায়ী। এই দেশ স্বাধীন করাই ভুল হয়েছে আমাদের। তা না হলে ক্ষমতা নিয়ে এই কামড়া-কামড়ি দেখতে হতো না। আমার ভাই-বোনকে এভাবে পুড়ে মরতে হতো না।’


বাসে পেট্রল বোমা হামলার ভয়ে অনেকে বিকল্প হিসেবে রেলপথকে বেছে নিয়েছিলেন নিরাপদ জেনে। কিছুটা হলেও রেলের যাত্রা বাসের চেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেই মনে করা হতো। কিন্তু সেখানেও রক্ষা নেই। আগে রাতের আঁধারে রেল লাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলা হতো। এখনও হচ্ছে। তবে নতুন যুক্ত হয়েছে পেট্রল বোমা হামলা। দিনে-দুপুরে হামলা চলছে।


লঞ্চ যাত্রাও এখন আতঙ্কের। ‘নদীর মাঝপথে লঞ্চ। আর এই পরিস্থিতিতে যদি আগুন দেওয়া হয় লঞ্চে তাহলে বাঁচার কী উপায় থাকে বলতে পারেন?’ এক যাত্রী প্রশ্ন করেন আমায়। ‘কী আর করা, জীবনের মায়ায় ওই বাসযাত্রীর মতো অথৈ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন যাত্রীদের অনেকে। আর যারা কোনো উপায় খুঁজে পাবেন না তাদের পুড়ে কয়লা হওয়া ছাড়া কি বা করার আছে?’


মুঠোফোনে কল এলো। ধরতেই ওপার থেকে উৎসুক কণ্ঠে আমার এক পরিচিতজন জানতে চাইলেন এসএসসি পরীক্ষার কথা। যিনি কল করেছেন তার মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার টেবিলে বসবে। ‘এভাবে চলতে থাকলে বাচ্চারা পরীক্ষা দেবে কীভাবে বলতে পারেন? একের পর এক পরীক্ষা পেছালে পরীক্ষার্থীদের কী হবে?’


বললাম, ‘তাই তো, আপনার মতো এই চিন্তা ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর অভিভাবকের হয়ত আছে, কিন্তু যারা পরীক্ষার্থীদের জিম্মি করে রেখেছে তাদের কি কোনো চিন্তা আছে।’


‘শুনেছেন তো, বলে কি না যে দেশে গণতন্ত্র নেই সেদেশে পরীক্ষা দিয়ে কী হবে? এটা কি কোনো সুস্থ মানুষের কথা হতে পারে? সরকার তো এই সংকট সমাধানে একটা ব্যবস্থা নিতে পারে। বিএনপির সঙ্গে কথা বলুক, দেখুক তারা কী বলতে চায়। তারা তো বলেছে সরকার কথা বললে আন্দোলন-কর্মসূচি শিথিল করবে...।’


বললাম, ‘ভাই রাজনীতিকদের রাজনীতির খেলা কি আপনার আমার মতো লোক এত সহজেই বুঝবেন?’ পাশ থেকে একজন ফোড়ন কেটে বললেন, ‘হুম, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যখন আমাদের পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়ে তখন সমুচিত জবাবটা দিতে পারি না বলেই আজ আমাদের এই দশা।’


চা স্টল থেকে একেবারে সমাজের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত দু’জন লোক একসঙ্গে হলেই শুরু হয় দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার ঝড়। পক্ষে-বিপক্ষে চলে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি। এসব আলোচনা-সমালোচনায় কি কোনো কাজে আসছে? সাধারণ মানুষের কোনো কথাই কি শুনছেন সরকারি কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ? হয়ত শুনছেন, কিন্তু গায়ে মাখছেন না। কিন্তু নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার কি সাধারণ মানুষের নেই? দুশ্চিন্তা কাটিয়ে একটি মুহূর্তও তারা কাটাতে পারছেন? পারছেন নিজের আদরের সন্তানকে নিরাপদে স্কুলে পৌঁছে দিতে? কাজের সন্ধানে বের হওয়া নিরীহ মানুষটি কি নিরাপদবোধ করছেন পথ চলার জন্য? দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমজীবীদের কী অবস্থা তা কি একটি বার খবর নিয়েছেন কেউ? বলা হয়, মানুষের জন্য রাজনীতি, গণতন্ত্র; আসলেই কি তাই? তাহলে কেন এই নৃশংসতা? সাধারণ মানুষের মনে এমন হাজারো প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি।


আমার পাশের আসনে বসা যাত্রী বললেন, ‘যারা আগুন দিচ্ছেন তাদের একজনকে যদি পুড়িয়ে মারা যেত। আর সেটি যদি সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হতো, পত্রিকার প্রথম পাতাজুড়ে ছাপা হতো, তবে হয়ত অন্য পশুদের হৃদয়ে কিছুটা নাড়া দিত।’


‘চাইলেই কি সম্ভব ভাই? আপনার আমার আশপাশের লোকজনই এগুলো করছে। পারছেন এদের ধরতে? পারবেন না...’ বলতে বলতে নেমে গেলেন এক যাত্রী। বাস তখন দাঁড়িয়ে মগবাজার মোড়ে। বেশ মন দিয়েই কথাগুলো শুনছিলাম, যে কারণে বাইরে তাকানো হয়নি দীর্ঘক্ষণ। জানালার কাচ গলিয়ে বাইরে চোখ যেতেই মনে পড়ল, আমাকে তো নামতে হবে। কিন্তু মন চাইছিল না নামতে। সাধারণ মানুষের মন নিংড়ে বেরিয়ে আসা প্রতিটি শব্দ যেন বিঁধছিল বুকে। থমকে গিয়েছিলাম আমি। মনে মনে বলতে থাকলাম, ‘আমিও নিরাপদ নই। এভাবে চলতে থাকলে আমাকেও হয়ত পুড়তে হবে একদিন। আমি পুড়ব কবে?’ -সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে।


(ঢাকাটাইমস/১১ফেব্রুয়ারি/এমএটি)