সাংবাদিক হিসেবে কলম ধরার বয়সটা খুব একটা বেশি দিনের না। সবে বছর দুয়েক হলো। এই সীমিত সময়ের পথচলায় খবরের আনাচে কানাচে যাওয়া না হলেও হেঁটেছি ক্রীড়াঙ্গনের বড় দুই বারান্দা বাফুফে ও বিসিবিতে। কিন্তু এই পথ পরিক্রমায় আগে কখনও এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়নি।
আজ আমার সঙ্গে যেটি হয়েছে এটি কি ঘটনা নাকি দুর্ঘটনা? বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) অনুষ্ঠিত হবে মাস্টার্স ক্রিকেট কার্নিভালের চূড়ান্ত নিলাম। উদ্দেশ্য ওই ইভেন্ট কাভার করা। সেই সুবাদে সকালের নাস্তাটা সেরে আর দেরি না করে রওনা হলাম মিরপুরের দিকে।
বাস থেকে নেমে সোজা মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। দুই নম্বর গেইটে পা রাখা মাত্র প্রতিবারের ন্যয় এবারও তল্লাশির ছায়ায় বন্দি করল নিরাপত্তা কর্মীরা। যাক সেখান পার হয়ে বিসিবির মিডিয়া সেন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। সময় তখন ১০ বেজে ১৫ মিনিট। একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলাম, অনুষ্ঠান শুরু হতে তো খানিকটা দেরি আছে। একটু ঘোরাঘুরি করি। সাংবাদিক বলে কথা।
কিন্তু ঘোরাঘুরিটা যে জীবনের খাতায় দু:স্মৃতির দাগ কাটবে। বিসিবির মাঠের দিকে ঢুকতে একটা গেইট। গেইটের পাশে ১২-১৫ জন পুলিশ বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আমিও তাদেরকে টপকে পাশে গিয়ে একটু উঁকি মেরে দেখলাম টাইগার ক্রিকেটারদের অনুশীলন। আর তাতেই আমাকে থাকতে হল পুলিশের থানায়। গুনে গুনে তিন ঘণ্টা।
এই তিনটি ঘণ্টাই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা অর্জন হলো আমার। নিজেকে মেনে নিতে পারছি না। কি করলাম আমি। কেন-ই বা এমন ঘটনার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হল আমাকে। সে আর না-ই বলি। তবে মহারথীরা বলে না। শেখার কোনো বয়স নেই। সত্যিই তাই।
কারা ফটকে বসে শিখলাম, দেখলাম, জানলাম। তাই জানালাম। পুলিশের প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ বা আক্রোশ নেই। সাধারণ বলেন আর অসাধারণ বলেন, সবার জান আর মালের রক্ষার দায়িত্ব নাকি পুলিশ বাহিনীর। বেশ ভালো আমিও একমত। কিন্তু পুলিশের কাজ চিত্রনাট্য লেখা নয়। পুলিশের কাজ মানুষের নিরাপত্তা দেয়া। যাদের কাছে গেলে মানুষ এক টুকরো শান্তির পরশ পাবে। যাদের নাম ধরলে বিপথগামীরা সুপথে আসবে। তাদের আঙ্গিনায় যদি কাউকে ‘বোতল বন্দি’ হতে হয়। এ থেকে দুর্ভাগ্যের আর কি হতে পারে।
এতসব নীতিকথা বলার মানেও আছে। কারণ একজন সংবাদকর্মী হিসেবে নয় একজন সাধারণ মানুষ হিসেব ছোট্র দুটি উদাহরণ তুলে ধরি। ‘ছিনতাইকারী তো ধরলাম। কেচি ছাড়া আর কিছুই পাই নি। এক কাজ করেন বাজার থেকে কয়েকটা ছুরি-চাকু কিনে আনেন। মামলাটা শক্ত করতে হবে।’ আর আমাকে রীতিমত শাসানোর জন্য এক পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, ‘এক কাজ করেন ওর বিরুদ্ধে ৪৮ ধারায় একটা মামলা ঠুকে দেন।’ তাহলে পুলিশ কি এভাবে মামলা সাজায়?
একজন পুলিশ কর্মকর্তার মুখে এমন কথা শুনে খুবই খারাপ লাগলো। নিশ্চুপ হয়ে মাতাটা নুইয়ে বসে রইলাম। ঘড়ির কাঁটা তার আপন গতিতে চলছে। কিন্তু আমার যাবার আর সময় হয় না। কিছুক্ষণ পর এক পুলিশ এসে বলল ‘ওকে হাজতে রাখি। কে বসে বসে পাহারা দিবে।’
মাথা উঠিয়ে বললাম, ‘আমি এখানেই থাকবো। কোথাও যাবো না। আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন। আর আমার ব্যপারটা একটু দ্রুত সমাধান করুণ। যেতে হবে আমাকে। অফিসে অনেক কাজ।’
একটু পর একটা ফোন এলো। মনের মণিকোঠায় একটু আশার স্বপ্ন জাগল। এই বুঝি আমাকে বলবে তুমি চলে যেতে পারো। কিন্তু না। অপেক্ষা যেন আরও কষ্টদায়ক হয়ে উঠছে। পানির পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পানি তো দুরের কথা যেন জ্বলন্ত উনুনের উপর বসে কাতরাচ্ছি। কারণ কি জানেন আমাকে যেখানে বসালো সেটি ছিল একটা মরিচা ধরা বক্স।
দেখতে দেখতে জোহরের আযান। কয়টা বাজছে বলতে পারছি না কারণ ব্যক্তিগত ফোনটাও নিয়ে গেছে পুলিশ। তাই অনুমান করলাম মধ্যাহ্ন ঘনিয়ে আসল। তখনও বসেই আছি। পাশ থেকে আওয়াজ এলো আপনার নাম কি। বললাম, এক পুলিশ কর্মকর্তা ডেকে নিয়ে গেলেন তার ডেস্কে।
দেখি ওখানে বসে আছে বিসিবির এক কর্মকর্তা। ওনি নাকি আমার খবরে খবরদারি করতে এসেছেন। দেখে কিছুটা ভালোই লাগলো। শেষমেশ বিসিবির ওই কর্মকর্তা আমাকে নিয়ে বিসিবির কার্যালয়ে আসলেন। অনেক কথা, অনেক বচন শোনালেন।
কিন্তু আমাকে যখন পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে গেল। তখন ওনারা কই ছিলেন। ওনাদের কানে কি যায়নি বিসিবি থেকে সাংবাদিক আটকের খবর। নাকি শুনেও তাঁরা শুনেননি। আমাকে এমন হয়রানি কেন হতে হল। আমি তো ডজন-খানিক পুলিশের সামনে দিয়েই মাঠের দিকে চোখ দিয়েছি।
হয়তো তাদের ওভারটেক করে দুই পা সামনে গেছি। এতেই কি আমাকে তিন ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস কামরায় কাটাতে হবে? বিসিবির নিরাপত্তা নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কারণ দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে, সুনাম বৃদ্ধিতে বিসিবি প্রাণপণ লড়ছেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমি কোনো অপরাধ করিনি। হয়তো ভুল করেছি। সে জন্য আমি অনুতপ্ত। তারপরও কেন আমাকে এমন হয়রানির দহন সইতে হল?