মুসলমানদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। পশু জবাইয়ের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করা হয় এই দিনে। হজরত ইবরাহিম (আ.) তাঁর প্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি দিয়ে স্রষ্টার সামনে আনুগত্যের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরে আখেরি নবীর উম্মতের ওপর এই বিধানটি জারি করা হয়েছে। এই কোরবানি ওয়াজিব বা অবশ্যই করণীয় আমল। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ জন্তু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। অতএব তোমাদের আল্লাহ তো একমাত্র আল্লাহ, সুতরাং তাঁরই আজ্ঞাবাহী থাক এবং বিনয়ীদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা হজ-৩৪) অগণিত হাদিসে রাসুল (সা.) কোরবানির ফজিলত ও এর বিধিবিধান আলোচনা করেছেন। মুসনাদে আহমদ ও ইবনে মাজাহর একটি হাদিসে হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম সূত্রে বর্ণিত, একবার সাহাবায়ে কেরাম রাসুল সা.কে প্রশ্ন করলেন, কোরবানি কী? উত্তরে আল্লাহর রাসুল সা. বলেছিলেন, এটি তোমাদের ধর্মীয় পিতা হজরত ইবরাহীম আ. প্রবর্তিত একটি সুন্নাত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের কী লাভ হবে? নবীজী সা. বললেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে তোমাদের জন্য রয়েছে নেকি। সাহাবায়ে কেরাম পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ভেড়া এবং দুম্বার ক্ষেত্রেও কি এই সওয়াব পাওয়া যাবে? রাসূল সা. উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, সওয়াব পাবে। এমনকি প্রতিটি পশমের বিনিময়ে সওয়াব দেয়া হবে।
কোরবানির আসল বিষয় হচ্ছে ত্যাগ ও আত্মবিসর্জন। নিজেকে স্রষ্টার সামনে নিঃশর্তভাবে সমর্পণ। আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তার সন্তুষ্টির জন্য পশু জবাই করতে, কোনো লাভ-ক্ষতির হিসাব না করে তা বাস্তবায়ন করাই হলো আনুগত্য। নিজের ছেলেকে জবাই করার মতো কঠিন নির্দেশ দেয়া হয়েছিল হজরত ইবরাহিম আ.কে। সেই মহা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহিম আ. খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। কোরবানি হলো সুন্নতে ইবরাহিমি; প্রিয় সন্তানকে জবাই করার মতো কঠোর নির্দেশনা নয়, পশু জবাইয়ের মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। তবে সেটা নির্ভর করে নিয়ত ও ইখলাসের ওপর। স্বচ্ছ হৃদয়ে, খাঁটি নিয়তে কোরবানি করলেই আল্লাহর দরবারে তা কবুল হবে। অন্যথায় এই ‘রক্তপাতে’ কোনো লাভ নেই। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, কোরবানির পশুর মাংস, রক্ত কিছুই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে না; পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া। আর এই তাকওয়ার উপস্থিতি না থাকলে পশু কোরবানির কোনো সার্থকতা নেই। এজন্য নিষ্পাপ পশুর গলায় ছুরি চালানোর আগে নিজের মনের পশুটাকে কোরবানি দিতে হবে। বছরের পর বছর ধরে মনের কোণে ঘাপটি মেরে থাকা অসভ্য পশুটি জবাই না দিতে পারলে গতানুগতিক পশু কোরবানিতে কোনোই ফায়দা নেই।
আজকাল আমাদের সমাজে কোরবানি অনেকটা ফ্যাসানে পরিণত হয়েছে। বিত্তশালীদের অর্থের দাপট দেখানোর বিশেষ সুযোগ এটা। তাকওয়ার পরিবর্তে মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পশুটা এই কোরবানি উপলক্ষে আরও হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে। যারা অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ে তোলেছেন কোরবানি ঈদে তারা নিজেদেরকে প্রকাশের একটা সুযোগ পেয়ে যান। কে কত বেশি দামের কোরবানি দিচ্ছেন এর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তে কেউ এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করলে সেটা নিশ্চয় ভালো জিনিস। তবে লৌকিকতায় কলুষিত প্রতিযোগিতার কোনো মূল্যায়ন আল্লাহর কাছে নেই। প্রত্যেকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কোরবানি বা বিসর্জন দেবে এটাই আল্লাহ চান। কে কত দামি পশু কোরবানি করেছে সেটার দিকে আল্লাহর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি শুধু দেখেন মানুষের অন্তর। দুনিয়ার সব মানুষকে ধোঁকা দিলেও কোনো অন্তর আল্লাহকে ধোঁকা দেয়ার সুযোগ পাবে না।
বছর ঘুরে ঈদুল আজহা আমাদের দুয়ারে হাজির। প্রতি বছরের মতো এবারও আমরা এই উৎসবে মেতে উঠবো সেটাই স্বাভাবিক। ধর্ম স্বীকৃত এই উৎসব উদযাপনে নেই কোনো বাধা নিষেধ। তবে ধর্মীয় এই উৎসবের আমেজটা যেন নষ্ট না হয়; এর প্রকৃত দাবি যেন প্রতিফলিত হয় সে দিকেও আমাদের সবার নজর রাখতে হবে। ঈদুল আজহার ত্যাগের যে মহান শিক্ষা সেটা ব্যক্তিজীবনে ধারণ করতে হবে; সেই শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজ থেকে রাষ্ট্রে। ত্যাগের মানসিকতা গড়ে তুলতে পারলে আমাদের পরিবার থেকে রাষ্ট্র সবই আরও সুন্দর হবে নিঃসন্দেহে। সামর্থ্যবানদের জন্য এই কোরবানি। কোরবানির পশুর মাংস নিজেরা খেতে কোনো আপত্তি নেই। তবে বড় বড় পশু কোরবানি করে ডিপ ফ্রিজ ভরে রাখা আর গরিব-দুঃস্থদের বঞ্চিত করা নিশ্চয় ত্যাগের শিক্ষা নয়। লাখো টাকা খরচ করে কোরবানির মূল প্রাপ্তিটা আত্মত্যাগ। সেটা অর্জন করতে না পারলে সবই বৃথা। তাই আসুন, এই কোরবানি যেন বৃথা না হয় সে দিকে সবাই মনোযোগী হই।