দু’দিন আগে এক বন্ধু অনেকগুলো কবিতা নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। প্রেম-বিরহের সুতায় গাঁথা একগুচ্ছ কবিতা। বিরহব্যথা আসলে কী! বাতাস যেমন শুধু অনুভব করা যায় বিরহব্যথাও ঠিক সে রকম। সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা অনুভব করার জিনিস। ট্যাবলেট খেয়ে এগুলো তাড়ানো বা হাসিল করা সম্ভব নয়। যায় না। সুখ এমন কিছু নয় যে কাঁঠাল খাওয়ার মতো দু’পিছ সুখ খেয়ে ফেললাম আর সুখী হয়ে গেলাম। দুঃখও তেমন। তবে দুঃখ-সুখ আমাদের জীবনেই আসে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, আগ্রহ-আনাগ্রহে। আসে বাতাসের মতো, ঝড়ের মতো, বৃষ্টির মতো।
বন্ধুর কবিতাগুলো আমাকে বেশ মর্মাহত করেছিল। ব্যথার কথামালা কাগজ-কলমের বন্ধনে আবদ্ধ। চোখের পানির ঘ্রাণ প্রতিটি ছন্দে। তার ছোট জীবনে অনেক ট্রাজেডি আছে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য পায়ের জুতা ক্ষয় করা তারপরও চাকরি না পাওয়ার গ্লানি। প্রেম করে প্রেমিকাকে না পাওয়ার ব্যর্থতা সব কি বড় বড় এক কষ্টের পাহাড়।
বন্ধুটি আসলে ঠিক প্রেম করেনি। বেকার জীবনে বিয়ে করার এক মহৎ উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিল। পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি না হতে পারে কিন্তু বয়স তো আর থেমে থাকে না। ওর কথাগুলো ঠিক কবিদের মতো, কবিতার মতো। আমার কাছে মনে হয় সব সময়। প্রায়ই বলতো কতো বছর বাঁচবো। পড়াশোনা শেষ করতে করতে ত্রিশ বছর, চাকরি খুঁজতে খুঁজতে আর পাঁচ, বাকি কি থাকে! জীবনের, যৌবনের।
আমরা আসলে বিয়েটাকে খুব কঠিন করে ফেলেছি। বিয়ে কঠিন করে সহজ করেছি ব্যভিচার। আগাছার মতো নোংরামি, নষ্টামির সয়লাব। গলা টিপে হত্যা করেও যেন তা মিটিয়ে দেয়া যাবে না। ওর কতগুলো মেয়ে বন্ধুর কথা বলে। একসাথে অনার্সে পড়েছে। বেশ মজায় কাটিয়েছে ছাত্রজীবন। স্বপ্ন আর প্রত্যাশার পাহাড় ছিল প্রত্যেকের বুকে। ইদানীং তাদের কারও বিয়ে হচ্ছে না। ছেলে দেখতে আসে তো ছেলের মেয়ে পছন্দ হয় না, আবার অনেক ছেলে যারা আসে তারা মেয়ের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয় না। হ্যান্ডসাম যুগ। ক্লোজআপের যুগ। মেয়েরা সারাদেশ ভরে প্রতিভা খোঁজার মতো স্বামী খুঁজে বেড়ায়। ছেলেরা সুন্দরী লালনা, নচনে-বাচনে, নিজেকে প্রদর্শনে বিজ্ঞ সব মেয়ে খোঁজে।
তারপর টাকাওয়ালা হতে হবে। পাজেরো গাড়ি থাকতে হবে। বাড়িতে লিফট থাকতে হবে। চেয়ারে স্প্রিং থাকতে হবে। খোলা জানালা দিয়ে সাগর কিংবা নদী একটা কিছু দেখার মতো সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। থাকা আর চাই চাই করে শেষ পর্যন্ত বলে বিয়ে করবো না। বিয়ে কি মানুষ করে?
আমার কবি বন্ধু অমানুষ হয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিল! পারিবারিক অবস্থা ভালো হওয়ার কারণে মেয়েপক্ষ বেকার ছেলেকেও মেয়ে দেখাতে রাজি হয়। ওর নাম সাথী। দেখতে গিয়ে নাকি শুধু মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুখ নিয়ে একটা কবিতাও লিখেছে- কী মায়াবী মুখ, দেখে ভরে বুক কি যে তুমি আমার, বোঝার সাধ্য কার? বাড়ি এসে বাবার কাছে বলতেই শুরু হয় অগ্নিবৃষ্টি। বউকে খাওয়াবি কী? সারা জীবন কি বুড়ো বাপের ঘাড়ে বসে খাবি! মানুষ কারও ঘাড়ে বসে খায় না। চেয়ার-টেবিলে বসে খায়। ইসলামি ভাবধারার মানুষেরা নিচে ফ্লোরে দস্তারখানা বিছিয়ে খায়। কবি ইসলামি হোক বা আধুনিক কালচারের হোক সে বাবার ঘাড়ের উপর থালা-বাটি, তরকারির গামলা রেখে একলাফ দিয়ে ঘড়ে উঠে যে খেতে বসবে না এ বিশ্বাস আমার আছে! তারপরও কতো কথা।
বিয়ের সাধ মিটলেও মেয়েটাকে মন থেকে মুছতে পারে না। আমি জানি সে যে চাকরি পাচ্ছে না, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারছে না এ অপরাধ মোটেও তার নয়। কবি সর্বশেষ সেখানে ইন্টারভিউ দিয়েছিল সেই প্রতিষ্ঠানে দু’জনকে নিয়োগ দেয়া হবে। খালি দুটো পদের জন্য ছয়জন মন্ত্রী পাঁচজনের পক্ষে সুপারিশ করেছেন। আমার লোক চাকরির ব্যবস্থা করুন। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের থরে কম্প অবস্থা। দুটো পোস্ট, ত্রিশজনের জন্য সুপারিশ! তাও আবার মন্ত্রীদের সুপারিশ বলে কথা। তাদের যদি বলা হয়, স্যার পোস্ট তো দুটো। আপনি একাই ছয়জনের জন্য সুপারিশ করেছেন? তারা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। মন্ত্রীদের আবার রাগ একটু বেশিই থাকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলবেন, পোস্ট খালি করুন। অনেক প্রতিষ্ঠানে পোস্ট খালি করা হয়েছে।
কিছু কথা হচ্ছিল। হরেক রকম কথা। কথার ফাঁকে ফাঁকে কবিতার দিকে নজর বুলাই। কবিতা আমার খুব বেশি পছন্দ নয়। অনেকে বলবেন যার মন বলতে কিছু নেই শুধু তারই কবিতা ভালো লাগে না। মন থাকার কারণেই বা কে কি করতে পারছে! বড় বড় মনওয়ালারা মনের ধকল সহ্য করতে না পেরে অসহায় ভাবে চিৎকার দিচ্ছে। কবিতা লিখছে। পাঁচ কেজি মন থাকলেই মানুষ মানুষের উপকার করছে, না ভালোবাসছে?
বর্তমান সময়ে মোড়ল মনের অধিকারী জাতি আমেরিকা। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বড়ত্ব-মহত্ব সবকিছুতে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ওই আমেরিকা। সেই জাতি বড়ত্ব–মহত্ব আর উদারতার এমন এক সীমায় পৌঁছে গেছে যে, সেখানে পুরুষের বিয়ে করার জন্য নারীর প্রয়োজন হয় না। নারীর প্রয়োজন হয় না পুরুষ। দিন বদল, যুগ বদলের কল্যাণে নারী-নারী, পুরুষ-পুরুষ বিয়ে তারা আইন করে ‘জায়েজ’ করে ছেড়েছে। আমাদের এসব শুনলে গাল ভরে বমি এলেও ওনারা এসবেই পরিতৃপ্ত, আনন্দিত।
তাদের উত্তরসূরি যে এদেশে নেই এমন নয়। আছে, তারা কেবল জেন্ডার বৈষম্য তুলে দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে সামান্য সামান্য কথা বলেন। জেন্ডার বৈষম্য সামাজিক উন্নতি ও প্রগতির পথে অন্তরায়। এ বৈষম্য থাকা চলবে না। নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ চলবে না। সৃষ্টিগতভাবে যেখানে ভেদাভেদ আছে, প্রকৃতিগতভাবে যেখানে ভেদাভেদ আছে সেখানে আমি এক সৃষ্টি যদি বলি ভেদাভেদ থাকবে না তাহলে আমাকেই আগে ভেদাভেদ, পার্থক্য দূর করতে হবে! কিভাবে দূর করবেন? আপনাকে সৃষ্টি করা শিখতে হবে। তা কখনোই মানুষের পক্ষে, কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনিই একমাত্র সৃষ্টি করেন। তার প্রতিটি সৃষ্টি নির্ভুল,নিখুঁত, সুন্দর। আপনারা বড়জোর আল্লাহ পাকের সৃষ্টির ওপর যন্ত্রপাতি চালিয়ে বদলে বিকৃত হতে পারেন। যারা বলেন, জেন্ডার বৈষম্য থাকবে না, তারা আসলে কী বলেন তারাই তা জানেন না।
জেন্ডার তো আছেই। মেল, ফিমেল। আরও এক জেন্ডার আছে। দুনিয়ার সবাইকে তারা সেই জেন্ডার বানাতে চায়। উন্নতি ও প্রগতির শীর্ষে অবস্থানকারীদের অবস্থা অনেকটা তৃতীয় জেন্ডারের মতো। আচরণ, চরিত্র| যারা জেন্ডার বৈষম্য দূর করতে চান তারা বদলে যান। তাদের আপন, পক্ষে স্লোগানকারীদের বদলে দিন। বদলে যাও, বদলে দাও। অনেক সময় আমার বন্ধু মহোদয় চুপ করে বসেছিল। মানুষের আসলে কত চিন্তা। মানুষ চিন্তার ঝুড়ি মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। খাওয়ার চিন্তা, পরার চিন্তা, বাঁচার চিন্তা। বিয়ের চিন্তা। কেউ কেউ গোপনে বিয়ে করে। মোবাইল করলে বলে আমার বউ আমাকে বিস্কিট খাইয়ে দিচ্ছে। তাদের কী সুখ! বন্ধুকে বলি, কিরে চুপ করে বসে আছিস কেন? গোমড়া মুখে বসে থাকবি না। বিয়ে না হলে কি মানুষ বাঁচে না? নারী ছাড়া কি মানুষ বাঁচে না?
বাঁচে।
তাহলে এতো চিন্তা কিসের?
ভাবছি কতোদিন বেকার থাকবো?
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলে, আচ্ছা আমি যদি কবি হয়ে যাই তাহলে কি বেকারত্ব থাকবে? তুই কবিতাগুলো পড়।
আমার খুব হাসি পায়। কবি! কবি হয়ে তিনি বেকারত্ব ঘোচাবেন? যে দেশে প্রতিদিন মানুষ খুন হয়। সন্তান বাবা-মা হারা হয়। স্ত্রী তার স্বামী হারায় সে দেশে আর কিছু না থাক কবির অভাব থাকে না। আমাদের ছোট দেশটা কবি লেখকে ভরা। কতো কবি! আমার বন্ধু বলে, আমি একটা বই বের করবো। টাকা আছে’ না তাহলে প্রকাশক বই বের করবে টাকা লাগবে কেন! আমাকে আরও টাকা দেবে। দেবে না? সেটা অনেক দূর। সেই দূরে পৌঁছাতে হলে অনেক টাকা খরচ করতে হয়।
তাহলে তুই একটা কাজ করতে পারিস?
কী?
একটা কবিতার খাতা বের করতে পারিস। খাতা ভরে কলম দিয়ে লিখে লিখে দোকানে দোকানে দিবি। আমার সহাস্য কৌতুকে বন্ধুর চোখে জল আসে। বলে, আমি বাঁচবো না রে। আমার কোথাও ব্যথা করে না।