সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার কাছে প্রচণ্ড রকমের অসহায় আমি। পড়তেই হয় তাঁর কবিতা বারবার। তিনি এক দুরন্ত শব্দজাদুকর। তার বিস্তর সাহিত্যকর্ম আমার ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছে। এখনো দেয়। এবারের বৈশাখে পাবনার চরগড়গড়িতে এক অন্ধকার রাতে কবি প্রতীক মাহমুদ যখন তার ভরাটকণ্ঠে নূরলদীনের সারাজীবন আবৃত্তি করছিলেন, মনে পড়ে, আমি ভেসে গিয়েছিলাম দুরন্ত এক আবেগের স্রোতে। ‘আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে/যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে/তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?/কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?/সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রক্ষ্মপুত্রে মেশে’―এই পংক্তি ক’টি আবৃত্তি করার সময় আমি কেন যেন ফুঁপিয়ে উঠেছিলাম। আমার দুই চোয়াল, বুক আর গলার সমস্ত ঘাম ধুয়ে দিয়েছিল নোনা অশ্রুজল। অন্ধকার ছিল, তাই কেউ দেখেনি। শুধু দেখেছিল গ্রীস্মের নীল আকাশ আর নক্ষত্ররাজি।
নূরলদীনের সারাজীবন, বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভেতর’র মতো অসংখ্য কবিতা আছে তার, যা বুকের ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়, শিল্পের শক্তিশালী মহিমা অন্তরটাকে ধুয়ে-মুছে দেয়। আমার লেখালেখির শুরুর দিকে কত পড়েছি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা, গল্প আর উপন্যাস! মফস্বল শহরের লাইব্রেরীতে বসে; পল্টন, নীলক্ষেত থেকে বই কিনে নিয়ে। এখনো মাঝেমধ্যে বাসার কম্পিউটারে ইউটিইউবে ঢুকে তার কবিতার আবৃত্তি শুনি। শুনতে শুনতে বুকটা কেমন ভারি হয়ে ওঠে। এক নান্দনিক বোধ জারিত হয় আমার ভেতর। কী এক ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। বোধের এমন স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ বাংলা কবিতায় খুব বেশি কি আছে? নাই। জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতাকে যে কজন কবি নান্দনিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, সৈয়দ শামসুল হক তাদের একজন। কবিতা বলতে যতটুকু বুঝি, সেই বোঝার জায়গা থেকে এই ব্যাপারে আমার ভেতর বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
স্মৃ তি
বরেণ্য কবি সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে প্রথম কথা হয় সম্ভবত ২০০৯ সালের শেষের দিকে। আমি তখন একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে কাজ করি। ম্যাগাজিনটির পক্ষ থেকে একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তাঁকে ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। এসএমস পাঠালাম। নিরুত্তর। ঘণ্টা দুই পর তিনি ফোন দিলেন আমার নম্বরে। আমার আকাক্সক্ষার কথা জানালাম তাঁকে। স্বভাবসুলভ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘সাক্ষাৎকারের জন্য আমাকে দশ হাজার টাকা দিতে হবে? তোমার পত্রিকা কি দেবে এই টাকা?’ আমি বললাম, ‘এত টাকা তো দেবে মনে হয় না ভাইয়া।’ তিনি বললেন, ‘দিতে না পারলে আমিও সাক্ষাৎকার দেব না।’
আশাহত হলাম খুব। কিছুটা খারাপও লেগেছিল প্রথমে। পরে মনে হলো, তাঁর চাওয়া তো ঠিকই আছে। কারণ, প্রথমত তিনি আমার মতো অজানা-অচেনা তরুণ সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেবেন কেন? দ্বিতীয়ত তিনি একজন লেখক। বড় মাপের লেখক। আমার সময়ের মূল্য না থাকতে পারে, তাঁর আছে। আমি তো একটা পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে যাব। তাঁর সাক্ষাৎকারের কারণে পত্রিকাটির মান বাড়বে, পাঠক কিনবে, পড়ে পত্রিকাটির সুনাম করবে। অর্থাৎ পত্রিকার ব্যবসা হবে। যাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে এই ব্যবসা, তাঁকে কেন ঠকানো? বিনামূল্যে তিনি কেন সময় নষ্ট করবেন? সাক্ষাৎকার দেওয়ার অত আকাক্সক্ষা তো তাঁর নেই। জীবনে কত সাক্ষাৎকার তিনি দিয়েছেন, আমাকে না দিলে তাঁর কী আসে-যায়? তিনি তো প্রচারের কাঙাল নন। ভাবলাম, একেই বলে লেখকের মেরুদ-ের জোর। হক ভাইর এই জোরটা আছে। তার প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল।
২০১০-এর শেষের দিকে একদিন তাঁকে ফোন দিলাম। যথারীতি রিসিভ করলেন না। এসএমএস দিলাম এই লিখে, ‘ভাইয়া, শ্রদ্ধা জানবেন। আপনার ফেরী জাহাজের অপেক্ষায় গল্পটি আমার সম্পাদনায় একটি সংকলনে অন্তর্ভূক্ত করতে চাই। আপনার অনুমতির অপেক্ষায়।’ঘণ্টাখানেক পর তিনি রিপ্লাই দিলেন, ‘করতে পার। তবে অবশ্যই যেন নির্ভুলভাবে ছাপা হয়। সংকলনটি বেরুলে আমার ঠিকানায় এক কপি পাঠিয়ে দেবে।’ সংকলনটি প্রকাশের পর কুরিয়ারে আমি পাঠিয়েছিলাম এক কপি। তিনি পেয়েছিলেন কিনা সেই খবর পরে আর নেওয়া হয়নি।
দুই বছর কেটে গেল তারপর। ২০১২ সালে হঠাৎ একদিন আমার মোবাইলে তার এসএমএস। আমি অনেকদিন রেখে দিয়েছিলাম এসএমএসটি। নতুন মোবাইল কেনার পর হারিয়ে গেছে। স্মৃতি যেটুকু সাক্ষী দিচ্ছে, ইংরেজিতে তিনি লিখেছিলেন, যার বাংলা অনুবাদ করলে এই দাঁড়ায়, ‘নোমান, আমি সৈয়দ শামসুল হক। তোমার রাজনটী উপন্যাসটি আমি পড়তে চাই। তুমি কি একটা বই আমাকে পাঠাতে পারবে?’
এসএমএসটি পড়ে আমি এতটাই উৎফুল্ল হলাম, চোখে প্রায় পানি এসে পড়ার জোগাড়। সৈয়দ শামসুল হক আমার বই পাঠের আগ্রহ ব্যক্ত করে এসএমএস পাঠিয়েছেন, একজন তরুণ লেখক হিসেবে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে আমার জন্য! নম্বরটি ঠিক ঠিক তার তো? ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না! আমি পাল্টা এসএমএস পাঠলাম, ‘অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আমি আজই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ সেদিনই, নাকি পরদিন মনে নেই, তাঁর ঠিকানায় এক কপি রাজনটী কুরিয়ার করে দিলাম। তিনদিন পর তিনি আবার এসএমএস পাঠালেন। ইংরেজিতে। যার বাংলা অর্থ এই, ‘তোমার রাজনটী পেয়েছি নোমান। অনেক ধন্যবাদ। পড়ে অবশ্যই আমার অনুভূতির কথা তোমাকে জানাব।’
একজন তরুণ লেখকের জন্য এর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর তো কিছু নেই। ভাবলাম, সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে বাইরে যেসব কথা চালু আছে, যেমন তিনি তরুণদের লেখা পড়েন না, তরুণদের সঙ্গে মেশেন না―এসব কথা মোটেই সত্য নয়। আমার বই যেহেতু পড়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন, নিশ্চয়ই অন্যদের লেখাও তিনি পড়েন। তরুণদের সম্পর্কে তিনি খোঁজ-খবর রাখেন।
প্রথম তার সঙ্গে আমার মুখোমুখি কথা হয় সম্ভবত ২০১২ সালের ডিসেম্বরে। বাংলা একাডেমির বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠানে আমরা কজন তরুণ আড্ডা দিচ্ছি। হক ভাই ও আনোয়ারা সৈয়দ হক এলেন। হক ভাইর পরনে যথারীতি জিন্সের প্যান্ট-শার্ট। তিনি তো আমাকে চেনেন না। দেখা হয়নি, মুখোমুখি কোনোদিন কথা হয়নি―চিনবেন কী করে। সামনে গিয়ে সবিনয়ে আমার নামটি বললাম। হাত বাড়িয়ে তিনি হ্যান্ডশ্যাক করলেন। কেমন আছি এবং কী লিখছি ইত্যাদি জানতে চাইলেন। ধীরে ধীরে আড্ডা জমে উঠল। একাডেমির মাঠে শীতের মিষ্টি রোদে দাঁড়িয়ে আড্ডা চলছে। ধীরে ধীরে চেনা-অচেনা অনেকে ভিড় করছেন। সৈয়দ শামসুল হক বলে কথা! তিনি যেখানে দাঁড়াবেন, দশ-বারোজন এসে ভিড় করবেই। কথার এক ফাঁকে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তিনি বললেন, ‘এই ঠা-ার মধ্যে স্যান্ডেল পরে আছ কেন? স্যু অথবা কাপড়ের জুতা পরবে। ঠা-া কম লাগবে।’ আমি হেসে বললাম, ‘স্যু পরার অভ্যাস যে নাই ভাইয়া। কেমন হাঁসফাঁস লাগে।’ তিনি বললেন, ‘পরা শুরু করো। পরতে পরতে অভ্যাস হয়ে যাবে।’ এমন কণ্ঠে কথাগুলো বললেন, যেন পিতা তার সন্তানকে আদেশ দিচ্ছেন।
২০১৩ সালে আমার হীরকডানা উপন্যাসটি বেরুবার পর আমি হক ভাইর ঠিকানায় কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিলাম এক কপি। পাঠানোটা আমার কর্তব্য বলে মনে হয়েছে। প্রাপ্তি স্বীকার করে তিনি এসএমএসএ লিখলেন। যথারীতি ইংরেজিতে। বাংলা অর্থ এই, ‘তোমার হীরকডানা পেয়েছি। আমি অবশ্যই পড়ব। তুমি শমসের গাজীকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছ জেনে খুব ভালো লাগল। তোমাকে ধন্যবাদ।’
একই বছরের অক্টোবরে, আমি তখন ধাবমান নামে একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের নির্বাহী সম্পাদক। ম্যাগাজিনটির উদ্বোধনী সংখ্যা বেরুবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কাকে করা যায়? হক ভাইর কথা মনে পড়ল। কিন্তু তিনি কি আমার কথায় আসবেন? ভয়ে ভয়ে তাঁর নম্বরে ফোন দিলাম। রিসিভ করলেন। সাপ্তাহিক ধাবমানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কথা জানিয়ে সবিনয়ে বললাম, ‘আপনাকে আসতেই হবে ভাইয়া। আমাকে আশীর্বাদ করে যাবেন।’ হক ভাই খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর পত্রিকার সম্পাদকের নাম জানতে চাইলেন। রাজু আহমেদ মামুন, জানালাম আমি। চিনলেন না। বললেন, ‘শোনো, কী পত্রিকা, কী অনুষ্ঠান আমি কিছুই জানি না। তুমি আসতে বলেছ। আমি গেলে তোমার যদি ভালো হয়, অবশ্যই যাব।’
অনুষ্ঠানের দিন নির্ধরিত সময়ের দশ মিনিট আগে তিনি সেগুন বাগিচায় ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটি মিলনায়তনে চলে এলেন। অনুষ্ঠানের সভাপতি অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত, বিশেষ অতিথি নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ এবং মামুনুর রশীদও এলেন। কিন্তু পত্রিকার সম্পাদকের পাত্তা নেই। ফোনের পর ফোন দিচ্ছি, রিসিভ করছেন না। সম্পাদকে বাদ দিয়ে তো আর অনুষ্ঠান শুরু করা যায় না। কী করি? আমি তো দারুণ বিব্রত। কিন্তু হক ভাই মোটেই বিরক্ত হলেন না। অন্য অতিথিদের সঙ্গে তিনি আড্ডায় মেতে উঠলেন।
সেদিনের দেওয়া তাঁর বক্তৃতাটি আমি আমার ব্যক্তিগত টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে রেখেছিলাম। এই লেখাটি লিখতে বসে ক্যাসেটটির কথা মনে পড়ে গেল। বইয়ের আলমিরা থেকে বের করে রেকর্ডারে ঢুকিয়ে দেখি এখনো ঠিক ঠিক বাজছে। হক ভাইর স্পষ্ট কণ্ঠ। রেকর্ড থেকে বক্তৃতাটির কিছু অংশ তুলে দেয়া যাক―
“...পত্রিকাগুলোকে যেন আমরা কম উত্তেজক করতে পারি, বিপরীতে অনেক বেশি সৃজনশীল করতে পারি, এই চেষ্টা থাকতে হবে। আমি আশা করি সাপ্তাহিক ধাবমান আদ্যোপ্রান্ত সৃজনশীল পত্রিকা হিসেবে মানুষের দিকে ধাবিত হবে। ধাবমান শব্দটি আমাকে সেলিম আল দীনের অনবদ্য নাটকের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই সাথে চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিনের কথাও। শাহাবুদ্দিনের চিত্রকর্মের প্রবল শক্তিমত্তা ও ধাবমানতা আমাকে চিরকাল মুগ্ধ করে এসেছে। সাপ্তাহিক ধাবমান চিত্রের বিমূর্ত কুশীলবদের মতো পাঠকদের গতিময়তার দিকে নিয়ে যাবে, আলোকোজ্জ্বল্যের দিকে নিয়ে যাবে বলে আমি আশাবাদী।
অনেক পত্রিকার ভিড়ে একটি পত্রিকার পৃথক হয়ে ওঠার জন্য কিছু বিশেষত্ব প্রয়োজন। ধাবমানের বর্তমান সংখ্যার ঢালিউড, রূপচর্চার মতো পাতাগুলো সহজেই বাদ দেওয়া যেত। শুধুমাত্র এসবকে ধারণ করে এমন ছবিভরপুর লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনে বাজার ভরে আছে। এক জীবনে সবকিছু করা যায় না, একটা ক্ষেত্রকে বেছে নিতে হয়। বর্তমান পরিবেশ-প্রতিবেশের সাপেক্ষে এটা এমন এক সময়, যখন উঠৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর আশা সবকিছুই তুঙ্গে রয়েছে। বাঙালি পড়ে থাকার জাতি নয়, সংকটের মুহূর্তে বাঙালি বারবার উঠে এসেছে। এবারও উঠে আসবে এবং একটা কিছু ঘটবে। আমি নতুন সাপ্তাহিক পত্রিকাটির কাছে মানুষের এমন মানসের প্রতিফলন দেখতে চাই।
অন্তত কুড়িটি সাপ্তাহিক পত্রিকা তাদের সৌজন্য সংখ্যা পাঠিয়ে আমাকে সম্মানিত করে। কিন্তু তাদের মধ্যে বড়জোর দুটি আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারে। পাঠক হিসেবে যেটির জন্য আমার উদগ্র ক্ষুধা রয়েছে তার কতটা পাচ্ছি, আমি যে পথে ভাবছি তার প্রতিফলন কোথায় দেখতে পাচ্ছি, তা যদি না হয় তবে আমার ভাবনার বিপরীতে শক্ত যুক্তি পাচ্ছি কিনা তার ওপর বিচার করি কোন পত্রিকা কতটুকু স্বার্থক। সমাজমনের যে বিপুল ক্ষুধা তা মেটানোর দায়িত্ব স্বকৃত নোমানকেই নিতে হবে। সাধারণত দৈনিকের সাথে একটা সাপ্তাহিকের পার্থক্য সূচিত হবে সংবাদ পরিবেশনের ভিন্নতায়। ভাবনাকে একটি পটভূমিতে দাঁড় করানো, ঘটনার আড়ালের ঘটনাকে তুলে আনা, তার যুক্তিপূর্ণ, তথ্যভারি বিশ্লেণ―এ সমস্ত কিছু যে পত্রিকায় যত বেশি পাওয়া যাবে সেটি তার কাছে তত বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্যের স্বপ্ন ছিল। প্রাজ্ঞ মানুষ এই পথে ভাবতে চান। তাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে, তাদের ভাবাবে, তর্ক করার সুযোগ দেবে, আশার কথা শোনাবে, আর সম্মুখের দিকে বেগবান হবে―সাপ্তাহিক ধাবমানের কাছে আমি এমনটাই আশা করি। পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে যে কোনো প্রকার সহযোগিতা ও পরামর্শের জন্য আমার দরজা সর্বদা খোলা থাকবে।”
অনুষ্ঠান শেষে তাকে আমি তাঁকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেই। গাড়িতে উঠে বসলেন তিনি। বাইরে আমি দাঁড়িয়ে। হঠাৎ জানালার কাচটি নামিয়ে বলেন, ‘শোনো, বেঁচে থাকার জন্য চাকরি একটা করতে হয়, করো। কিন্তু তোমার মূল কাজ লেখালেখি, এটা কখনো ভুলো না।’ বলেই গ্লাসটি আবার উঠিয়ে দিলেন। গাড়ি ছেড়ে দিল। গ্লাসের ভেতর থেকে তিনি হাত নাড়ালেন। আমি তার উপদেশটি হৃদয়ের গভীরে স্থান দেই।
২০১৪-এর শেষের দিকের কথা। দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন বাংলাদেশের খ্যাতিমান গল্পকারদের প্রেমের গল্প নিয়ে আলাদা আলাদা বই করছেন। সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প নিয়ে একটা পাণ্ডুলিপি এনে দিতে বললেন আমাকে। আমি হক ভাইকে ফোন দিয়ে প্রেমের গল্পের পাণ্ডুলিপি চাইলাম। তিনি বললেন, প্রেমের গল্প বাছাই করার এত সময় কোথায় পাবি আমি? তুমি এক কাজ কর, আমার গল্প সমগ্র পড়ে বরং তুমিই বাছাই কর।
দীন ভাই আমাকে সৈয়দ হকের গল্পসমগ্র কিনে দিলেন। টানা প্রায় পঁচিশ দিন লেগে গেল পড়ে শেষ করতে। প্রেমের গল্পগুলো আলাদা করে একটা তালিকা তৈরি করে হক ভাইকে ফোন দিয়ে গল্পগুলোর শিরোনাম শোনাম। দু-একটা ছাড়া বেশিরভাগই রাখতে বললেন তিনি। ২০১৫ সালের বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়।
এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হলো আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ বালিহাঁসের ডাক। বইমেলা শেষে মার্চের ১ তারিখে যথারীতি হক ভাইকে কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিলাম এক কপি। মার্চের ৩ তারিখ ২.৩৫ মিনিটে আমার মোবাইলে হক ভাইর এসএমএস : ÒYes, Noman, I got it. Thanks. Soon i will have time to read it. Meanwhile accept my congratulations on its publication. Syed Haq.”
হক ভাইর সঙ্গে এসব টুকরো টুকরো স্মৃতি আমার কাছে অমূল্য সম্পদ। স্মৃতি তো প্রতারণা করে। একদিন হয়ত এসব স্মৃতি ভুলে যাব। উপলক্ষ পেলাম, তাই টুকে রাখলাম। এসব স্মৃতি অজীবন আমার কাছে সম্পদ হয়ে থাকবে। আমাকে অনুপ্রাণিত করবে।
উ প সং হা র
কতজন কত সমালোচনাই না করে সৈয়দ শামসুল হকের। করুক। তিনি মানুষ, ফেরেশতা নন। যারা তাঁর সমালোচনা করে তারা তাকে ভুল করে ফেরেশতা ভাবে। চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে। তাই বলে কি চাঁদ ছাড়া পূর্ণিমা কল্পনা করা যায়? বটবৃক্ষের কত দোষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষ বটবৃক্ষের ছায়াই কামনা করে। তিনিও কি বটবৃক্ষ নন? নিশ্চয়ই। কি কবিতায়, কি গল্পে, কি উপন্যাসে, কি নাটকে, কি গানে―শিল্পের কোন জেনরকে তিনি স্পর্শ করেননি? সব্যসাচী বটে তিনি। এ কালের অর্জুন। এ কালের ঋষি। সারা জীবন শিল্পের প্রতি নিজেকে মগ্ন রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যকে যা দিয়েছেন তিনি, কজন পেরেছে তার মতো করে? তার প্রতি চিরকাল আমার মুগ্ধতা থাকবে। আমি তার শিল্পের কাছে অবনত হয়ে ছিলাম, আছি এবং থাকব। নিন্দুকেরা নিন্দা করতে থাকুক। যারা তাঁর নিন্দা করছে, না বুঝে করছে। নিশ্চয়ই একদিন তাদের ভুল ভাঙবে।
তিনি দূরারোগ্য কর্কটরোগে আক্রান্ত। এখন তিনি হাসপাতালের বেডে শয্যাশায়ী। কী কঠিন এ শয্যা! কী বেদনাদায়ক! তবু তার মনোবল আমাকে বিস্মিত করে। ১২ সেপ্টেম্বর শ্রদ্ধাভাজন হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে কথা হয়েছিল ফোনে। তিনি জানালেন, আগের দিন, অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর তিনি আনোয়ারা সৈয়দ হকের ফোনে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে কথা বলেছেন। সৈয়দ হক তার সঙ্গে যে কথাগুলো বলেছেন তার কিছু অংশ তিনি শোনালেন আমাকে। তার মধ্যে একটি কথা ছিল এমন, “হাসান, আমি জানি ফুসফুসের ক্যান্সার ভালো হয় না, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি, ভেঙে পড়ব না। যে জোয়াল আমি কাঁধে নিয়েছি, মৃত্যুর আগে তা আমি কাঁধ থেকে নামাব না।”ভাবি, কতটা দার্শনিক উচ্চতায় পৌঁছলে একটা মানুষ এ কঠিন শয্যায় শুয়ে এমন কথা বলতে পারেন!
সময় বড় নিষ্ঠুর। সময় তার এই গুণধর সন্তানকে নিয়ে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে। প্রকৃতি যদি তাকে আরো কিছুদিন এই জলেশ্বরীর বুকে রাখতে চায় রাখবে। নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যাবে। কারো কিচ্ছু করার নাই। প্রকৃতির কাছে আমরা অসহায়। বড় বেশি অসহায়। একদিন সবাই প্রকৃতির শান্ত বুকে ঘুমিয়ে পড়ে; দিন শেষে শিশু যেমন মায়ের কোলে। তবু ‘পরাণের গহীন ভিতর’ থেকে কামনা, আরো কিছু দিন তিনি জেগে থাকুন সৈয়দ শামসুল হক। নীলক্ষা আকাশ নীল, তার নিচে অগণিত গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আর ঊনসত্তর হাজার গ্রাম দেখুন। ধবল দুধের মতো জোছনা ঝরে পড়ুক তাঁর গায়ে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক। সহযোগী সম্পাদক, সাপ্তাহিক এই সময়।