খেলারাম খেলে যা- শব্দত্রয় লহমায় নিয়ে যায় Playboy শব্দবন্ধের দুয়ারে। কিন্তু বাক্যখানি যখন সৈয়দ হকের ধ্রুপদি এক কথাশিল্প তখন অন্য এক জগতের অন্দরে পৌঁছে যাই আমরা। সাদা চোখে আমাদের মনে পড়ে যায়, ভ্লাদিমির নাবোকভের ললিতার কথা; ডি এইচ লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিজ লাভারের কথা। কিন্তু অন্তরে দেখার আলো যখন পেয়ে যাই, খেলারাম খেলে যা তখন আসলে আমাদের কোথায় নিয়ে যায়? বাবর আলীর সঙ্গে আমরা হয়ত আলপথ ধরে হেঁটে আসি বর্ধমান থেকে সাভার অবধি। মাঝে আমরা তারই সঙ্গে জিরিয়ে নেই ময়মনসিংহ, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়ায়, নগরে-গ্রামে-বন্দরে।
বাবরের কথার পিঠে কথার জাদুতে যেমন, লতিফা, বাবলী, জাহেদার মতো সদ্যোজাত-যুবতীরা মোমের মতোই গলে গয়ে যায়; তেমনি হক সাহেবের বয়ানে, বাণীতে, উপমা-উৎপ্রেক্ষার মুগ্ধতায় চেনা এই হিসেবি জগতের বাইরে অন্য কোথাও চলে যাই আমরা, ভোগ আর উপভোগের নতুন থেকে নতুনতর মাত্রায় আমাদের নিয়ে যান সব্যসাচী সৈয়দ হক। ‘চুল উঠতেও শুরু করেছে কিছু কিছু। পরাজিত সৈন্যদলের মতো কপাল থেকে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে তারা।’ শুরুর দিকেই বাবর আলীকে নিয়ে কথাশিল্পীর চমকিত আর চুলচেরা এই বিবরণ আমাদের আরও এগিয়ে নিয়ে যায় বইখানির ভেতরে।
বাবর আলীকে দিয়ে আমাদের সামনে চিন্তার নতুন এক আগল খুলে ধরেন সব্যসাচী সৈয়দ হকÑ ‘পুরুষ মিলিত হয় স্ত্রীর সঙ্গে, প্রকৃতির বিধানেই তাকে হতে হয়, কারণ স্ত্রীকে গর্ভবতী হতে হবে, সে আরেকটা মানুষের জন্ম দেবে। মানুষ নামে প্রাণী এইভাবে বেঁচে থাকবে। প্রকৃতির মূল তাগিদ হচ্ছে এইই। মিলন, নিজের আকৃতিতে সৃজন, সঙ্গমের মাধ্যমে জীবনের বিস্তার। এটা আমাদের রক্তে মাংসে আছে। কিন্তু আমরা সভ্য হয়েছি, চিন্তা করতে পারি, তাই একটা সুন্দর নাম দিয়েছি সেই জান্তব আকর্ষণের, নামটা প্রেম, ভালবাসা। ভালবাসা না হয়ে এর নাম কাঁঠাল বললে, লোকে ভালবাসাকে কাঁঠালই বলত। তাই নিয়ে গান হতো, কবিতা হতো, ছবি আঁকা হতো।’
বাবরের বয়ানে এভাবেই একের পর এক শব্দের তন্তু দিয়ে বাংলায় নতুন এক ভাষা আর কাহিনি বয়ন করে যান সৈয়দ হক। আমরা মোহিত হই, উষ্ণ হই, প্রেমিক ও পর্যটক হই। খেলারাম খেলে যা আমাদের সরু গোঁফ কিশোরদের তরুণ করে দেয়, অস্ফুট কিশোরীদের বানিয়ে দেয় তন্বী তরুণী। তাই বহুল চর্চিত এই কাহিনির জন্য হক একদিকে পেয়েছেন অজস্র লাল গোলাপ। আবার কন্টক শয্যায়ও নিয়ে গেছেন অনেকে। সাদা চোখ বুড়ো বামদেরই এর জন্য কাঠগড়ায় বেশি নিতে পারি আমরা। কারণ তাদের কারণেই আরেক বইয়ের আড়ালে নিয়ে পঠিত হয় অনেক অনেক খেলারাম খেলে যা। দেশভাগের উত্তাল আন্দোলনের সময়ে বিরচিত মফিজন (মাহবুব-উল আলমের উপন্যাস) এর চেয়ে বেশি কিছু মানতে রাজি নন তারা। হকের এই সৃজনীতে পাতায় পাতায় কামজ বাসনার বাইরে আর কিছুই যেন খুঁজে পান না নিন্দুক পড়–য়ারা। সত্যের অসংকোচ প্রকাশে দুরন্ত সাহসে ভরপুর সব্যসাচীকে তাই দোহাই দিতে হয়- ‘আমি খুব কম পাঠককে জানি, যিনি উপন্যাসের একেবারে শেষ বাক্যটি লক্ষ্য করেছেন। আমার বিশ্বাস, এই শেষ বাক্যটিতে দাঁড়িয়ে কেউ এ উপন্যাসের জন্য আমাকে তিরস্কার করতে পারবেন না।’
চলুন আমরা বরং একবার শেষ বাক্যেই আলো ফেলি। ‘আরো একজন ছিল, সে হাসনু।’ শুধু শেষ বাক্যেই নয়, হাসনুকে আমরা আসলে আরও অনেক জায়গায়ই পাব। বাবরের ঢাকার জীবনে বরাবরই বিরাজমান হাসনু। খেলারাম খেলে যার গল্পের কেন্দ্রে বাবর থাকলেও গল্পটা আসলে হাসনুর মানে দেশভাগের, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের।
তাই কাহিনির শেষভাগের সাভারের আগেই আমাদের আবার ঘুরে আসতে হবে দেশবিভাগের আগের বর্ধমানে। দাঙ্গা-বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে বাবর ছোট বোন হাসনুকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সাম্প্রদায়িক পাণ্ডাদের হাতে পড়ে যায় হাসনু। তাকে ফেলেই মাঠের ভেতর দিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে পালায় বাবর। হাসনুকে আর পাওয়া যায়নি। নতুন দেশের প্রদেশ রাজধানী ঢাকায় জীবিকা আর জনপ্রিয়তা- দুই সিঁড়িতেই সফল পায়ে চলতে পারে বাবর।
কিন্তু তার করোটিতে নিয়তই গ্লানি নামের পোকার কিলবিলানি থেকে যায়। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ফিরে আসে হাসনু। একের পর এক কোমল তরুণীর সঙ্গ আর সঙ্গমেও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে না বাবর। ‘দা-দা’ আর্তচিৎকার থেকে মুক্তি নেই তার। তাই পুলের ধাক্কায় গতি হারা গাড়ি যখন নদীর অতলে যেতে থাকে, তখনো বাবর-জাহেদা জুটির সঙ্গে গাড়িতে প্রবলভাবেই আরো একজন হয়ে ছিল হাসু, হাসনু।
কাহিনিটা কেবলই মনোদৈহিক টানাপড়েন নয়, কাহিনিটা আসলে মানচিত্রের কৃত্রিম বিভাজনের, কাহিনিটা আসলে দেশবদলি মানুষের যন্ত্রণা-বিক্ষুব্ধ সময়ের। দ্বিজাতিতত্ত্বের হুজুগ যে একটা বিকার ছিল, তারই প্রতিফলন বলুন, আর প্রতিসরণ বলুন, বর্ধমানের বাবর আলীর ঢাকার জীবন। তো, খেলারাম খেলে যা!