আজ মহালয়া, ঊষার আলোয় দূর্গাদেবীর আগমন ঘোষণার দিন। দুর্গাপূজায় দেবীপক্ষের শুরু, পিতৃপক্ষের শেষ। এই মহালয়া হচ্ছে- হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজার আনন্দে মেতে উঠার যাত্রা। মহালয়া মানেই পুজোর শুরু। এ উপলক্ষে পূজার কেনাকাটা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।
এ উপলক্ষে ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদ ও বিভিন্ন নদী ও পুকুর ঘাটে এসেছেলিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ। জীব জড় দেবতা, সকলকে তৃপ্ত করতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র প্রভৃতি দেবতাদের তৃপ্ত করতে চলে তর্পণ। তর্পণ পাঁচটা আচার সর্বস্ব বার্ষিক একটা পার্বণ। মহালয়ায় লোকান্তরিত পিতৃপুরুষকেই নয়, পরিচিত বন্ধু-স্বজন থেকে শুরু করে অপরিচিত এমনকী শত্রুকেও জলদানে তৃপ্ত করাই তর্পণ। দেবতা, ঋষি, নর, তাবৎ জীবকুলসহ লতা, গুল্ম, বনস্পতি, ওষধি কিছুই বাদ থাকবে না। গোটা বিশ্বকে তৃপ্ত করার মধ্যে সকল কে নিয়ে অনেক বড় করে বাঁচার একটা ভাবনা রয়ে গিয়েছে। সেটাই তর্পণের মূল সুর।
শরৎকালে যখন বর্ষার পরে নদীগুলো ভরা, আকাশ নির্মল ও কাঁশফুলগুলো মধুভরা, সে সময়েই সারা প্রকৃতি যখন তৃপ্ত, তখনই তৃপ্ত করতে হয় পূর্বপুরুষদের। এই রীতি বাঙালি হিন্দুদের খুবই প্রাচীন।
এ রীতির মধ্যে রয়েছে কল্পনা মায়ার মতো সাহিত্যবীজ। সংস্কৃত প-িতেরা জানান, কল্পনা করে নেয়া হয় বৃষ্টির পথ বেয়ে পূর্বপুরুষেরা ফিরে আসেন পুরানো মাটির মায়ায়। লোকান্তরিত পিতৃপুরুষরা অতৃপ্তি নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন বলে মনে করা হয়। তারা উৎসুক হয়ে থাকেন নিজেদের সংসারে আবার ফিরে আসতে।
তাই প্রকৃতিতে যখন ভরা বর্ষা, অবিরাম বৃষ্টির জলধারা যখন পৃথিবীর বুকে বয়ে আনছে তাবৎ জীবকুলের খাদ্য। নতুন প্রাণের ঈঙ্গিত। তখন, সংস্কৃত কবিতাগুলো মতে, বৃষ্টি ধারার মধ্যদিয়ে নতুনভাবে দেহ ফিরে পেতে পৃথিবীর পরিমলে ফিরে আসেন তারা। আদিত্যং জায়তে বৃষ্টিঃ, বৃষ্টে অন্নং ততোপ্রজা। সূর্য থেকে বৃষ্টি, তা থেকে খাদ্য আর খাদ্য থেকে প্রাণের উদ্ভব। বিজ্ঞানের এই সাধারণ নিয়ম আর তর্পণ যেন একই মুদ্রার দুটি পিঠ। প্রতিটি মানুষ নিজেকে ছাড়া কিচ্ছু ভাবছে না, সেই সময়ে শত্রু-মিত্র, আপন-পর, আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে তৃপ্ত করার এই অনুষ্ঠান অতীতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শিকড়ে ফেরাই নয়, তর্পণ আসলে আত্মনিয়ন্ত্রণে অনুশীলন।
শিকড়ের সন্ধানে জলে দাঁড়িয়ে দুহাতে জল নিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে যখন বলা হয় ওঁ আগচ্ছন্ত মে পিতর ইমং গৃহ্নন্তপোহাজ্ঞলিম, তখন শুধু যে পিতৃ পিতামহকে আমন্ত্রণ জানানো হয় তা নয়, অতীত, আমার পূর্বে যাবতীয় প্রাণকে সশ্রদ্ধ আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বাঙালি হিন্দুরা যে যেখানে আছেন সেখানেই বর্ষা শেষে ভাদ্র, আশ্বিন মাসে, আকাশে ভাসমান সাদা মেঘের তরী দেখলেই কমিয়ে আনছেন কাজের চাপ। মহালয়ার পুজো, চন্ডীপাঠ, শিউলি, কাশ, পদ্ম, ধুনোর গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ, মহিষাসুরমর্দিনী প্রাণবন্ত করে তুলেছে উপলক্ষ মহালয়া।