দেশের বিখ্যাত একটি জায়গার নাম নীলক্ষেত। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজের কোল ঘেঁষেই যার অবস্থান। রাজধানীর নিউমার্কেট বা শাহবাগ থেকে খুব বেশি দূরে নয় জায়গাটি। শাহবাগ থেকে কিছুদূর গেলেই মিলবে নীলক্ষেত স্কয়ার। সব মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গার নাম নীলক্ষেত। নীলক্ষেত নামটি বই আর শিক্ষাসামগ্রীর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। নীলক্ষেত বললে খুব সহজেই চলে আসে বই আর শিক্ষা সামগ্রীর কথা। রাজধানী ও এর আশপাশের প্রায় সবাই বই কিনতে ছুটে যায় এখানে।
জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে ইউরোপিয়ানরা বাংলার বিভিন্ন এলাকায় নীল চাষ করত। ১৮৪৭ সালে ঢাকায় ৩৭টি নীলকুঠি ছিল। ঢাকার এই এলাকাটিও ছিল নীল চাষের অন্যতম কুঠি। এখানে ছিল না কোনো বসতি। প্রচুর নীল উৎপন্ন হওয়া এই এলাকাটি ইতিহাসকে জড়িয়ে রেখেছে নামের সঙ্গেই।
ব্রিটিশদের প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৬১ সালে নীলক্ষেত এলাকায় গড়ে উঠে বস্তি। এই বস্তিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ছোটখাটো দোকান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বুয়েট, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজকে ঘিরে এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবই বিক্রি শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। ধীরে ধীরে জমে উঠতে শুরু করে বইয়ের মার্কেট। ১৯৭৪ সালে এখানের সব বস্তি ভেঙে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর পর্যায়ক্রমে গড়ে ওঠে বাক্কুশাহ মার্কেট ও গাউছুল আযম মার্কেট। যার প্রায় পুরোটাই লেখাপড়ার সামগ্রী নিয়ে। কম্পিউটার কম্পোজ, ফটোকপি, বই, খাতা-কলম ইত্যাদি মূল হলেও সঙ্গে যুক্ত হয় কিছু খাবারের দোকানও। বর্তমানে প্রিন্টিং প্রেস হিসেবেও নীলক্ষেতে রয়েছে বেশ খ্যাতি।
নীলক্ষেতের প্রকৃত মালিকানা নিয়ে ছিল দ্ব›দ্ব। ১৯৮২ সালে নীলক্ষেত মার্কেটের জমির মালিকানা নিয়ে মামলা হয়। ১৯৯৪ সালে এটি খাসজমি হিসেবে কোর্টের রায় হয়। ১৯৯৬ সালে নিলামে জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত হলেও তা সম্ভব হয়নি। এরপর দখল বিবেচনায় সরকারি রেটে বিক্রি করার কথা হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
প্রতিটি ব্যবসায়িক মার্কেটেই থাকে একটি সমিতি। কিন্তু নীলক্ষেত মার্কেটে পরিলক্ষিত হয় ভিন্ন চিত্র। জমির মালিকানাকে কেন্দ্র করেই ১৯৮২ সালে ইসলামিয়া মার্কেট বণিক বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড ও ১৯৮৪ সালে বাবুপুরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের জন্ম হয়। এখনো দুটি সমিতি বিদ্যমান থাকলেও তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই বলেই দাবি করছেন সমিতির সদস্যরা। বরং একই কাগজে সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি উপস্থাপন করা হয় বলে জানিয়েছেন তারা।
নীলক্ষেত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বই বাজারের একটি। এখানে পাওয়া যায় সব ধরনের পাঠ্যবই। নীলক্ষেত শুধুমাত্র পাঠ্যবইতেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বসাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, গল্প, উপন্যাস, কবিতাসহ বিভিন্ন ভাষার সব ধরনের বইয়ের কেন্দ্রস্থল এই মার্কেট। দেশের বড় বড় কবি-সাহিত্যিকের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে বিদেশি লেখকদের বইও। জওহরলাল নেহেরু, বারাক ওবামা, বিল ক্লিনটন, টনি বেøয়ার, নেলসন ম্যান্ডেলা, এপিজি আবদুল কালামসহ বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের বইয়ের সন্ধান মিলে এখানে। এছাড়াও কম্পিউটার, প্রযুক্তি, ভাষা শিক্ষা, রান্নাবান্না, রূপচর্চাসহ হরেক রকমের বইয়েরও কমতি নেই।
নীলক্ষেত যেমন বিখ্যাত নতুন বইয়ের জন্য, তেমন পুরনো বইয়ের জন্যও। বই কেনার পাশাপাশি পুরনো বই বিক্রি করতেও আসেন অনেকে। নীলক্ষেতের ফুটপাতের পুরোটাই ঘিরে আছে পুরনো বইয়ের দোকানে। বিক্রেতার ভিড়েও হিমশিম খেতে হয় সবাইকে। নতুন বইয়ের অর্ধেক মূল্যে কিনতে পাওয়া যায় প্রায় সব বই। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, ইতিহাস আর একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি পাওয়া যায় অনেক আন্তর্জাতিক মানের বই। স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, ভার্সিটির বইসহ প্রায় সব বইয়ের সমাহার এখানে।
‘যে সব সিলেবাস পরিবর্তন হয়নি সে সব বই নতুন-পুরনো একই। তাই নতুন কিনে টাকা নষ্ট না করে পুরনো কেনাই ভালো। তাছাড়া কিছু টাকা বেচে গেলে তা দিয়ে কয়েকটা গল্প-উপন্যাসের বই কেনা যাবে।’ এমনটি বললেন সিটি কলেজের ছাত্রী শাহানা সুলতানা।
‘আমরা বই বেইচ্চা ভাত খাই, তবে বইরে অনেক ভালোবাসি। বই আমগো মনের লগে মিইশ্যা গেছে। ফাইভ পাস কইর্যা আর পড়বার পারি নাই। এই বই বেইচ্যা আর বই নাড়ায়া অনেক কিছু শিখছি। অনেক ইংরেজি বইয়ের নাম, লেখকের নাম হুনলেই বুঝবার পারি।’ বলছিলেন নীলক্ষেতের পুরনো বই বিক্রেতা জসিম। কোনো রকমে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া জসিম কাজের খোঁজে ২০০৯ সালে পাড়ি জমায় ঢাকায়। প্রথমে নীলক্ষেতের একটি হোটেলে চাকরি নিয়ে ৬ মাস কাজ করে। পরবর্তী সময়ে চাকরি নেয় একটি বইয়ের দোকানে। কিছু দিন পর জমানো অল্প কিছু টাকা দিয়ে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে অনেক দিন জমে থাকা পুরনো বই কম দামে কিনে তা নিয়ে বসে পড়ে ফুটপাতে। খুব বেশি বেচাকেনা না হলেও এতেই লেগে থাকে জসিম। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রদের থেকে পুরনো বই অল্প দামে কিনে তা ফুটপাতে বসে বিক্রি করে। এছাড়াও লাইব্রেরিতে জমে থাকা পুরনো বই, কাগজ ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কিনে নেওয়া বিভিন্ন গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাসের বই কিনে বাড়াতে থাকে তার ব্যবসার পরিধি। এভাবেই চলতে থাকে তার ব্যবসা। প্রথম দিকে তার দৈনিক বেচাকেনা এক-দুই হাজার টাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা পৌঁছেছে আট-দশ হাজারে। জসিমের মতো রয়েছে আরো অনেকেই। যারা শূন্য থেকে গড়ে তুলেছে ব্যবসা। বর্তমানে ভালোই চলছে তাদের পথচলা।
নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেটে গড়ে উঠেছে বেশকিছু খাবারের দোকানও। ডাকাডাকিতে বেশ জমজমাট থাকে ফুটপাত ঘেঁষে গড়ে ওঠা দোকানগুলো। সব খাবার পাওয়া গেলেও তেহারি আর কাচ্চির জন্য বিখ্যাত এই দোকানগুলো। ওই এলাকা দিয়ে হাঁটতে গেলে কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না খাবারের ঘ্রাণকে। ছোট গলির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহন করে নীলক্ষেত মার্কেট। প্রথমবার কেউ ঢুকলে তাকে ভয় পেতেই হবে। অন্ধকার ঘেরা গলির শুরু কিংবা শেষ সহজে বোধগম্য নয়। তার চেয়ে বড় আশঙ্কা হলো দুর্ঘটনার। কোনোভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে হয়ত রক্ষা পাবে না একটি দোকানও। পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে উঠা পাকা, অর্ধপাকা কিংবা কাঁচা দোকানগুলো চলছে ঝুঁকির মধ্যেই। কোথাও দেখা যায় না অগ্নিনির্বাপক কোনো যন্ত্র। নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো সতর্কতা।