বিদ্রোহী কবিতার ছন্দালংকার: একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট, ২০১৬ ১৩:০১:১৯
বিদ্রোহী কবিতার ছন্দালংকার: একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ
মো. হাফিজুর রহমান
Abstract
Kazi Nazrul Islam is the examplery poet in the kingdom of Bengali poetry. At the age of 22 in 1922, he agitated the sky of Bengali poem by Bidhroee adorned with unique rhythm, Hindu-Muslim and Greek mythology. The kingdom of Bengali literature was agitated with the spontaneous rhythm and rhetoric as a wallow wave of the ocean. The number of bar/measure is not always equally distributed in this poem of moric metre. But the poem is oriented with 2+6+4 complete moric metre without extra bar, incomplete bar and some exceptions. The poet has established unparallel talents applying alliterations, metaphors and similes in the poem 'Bidhroee'.
সারসংক্ষেপ
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্যজগতের এক প্রবাদপুরুষ। ১৯২১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় হিন্দু-মুসলিম আর গ্রিক পুরাণের মালা গেঁথে অপরূপ ছন্দ ও অলংকারে ঝংকৃত করে তোলেন বাংলার কাব্য-আকাশ। সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মতো উন্মাতাল ছন্দ অলংকারে আলোড়িত করলেন বাংলা কাব্যজগৎ। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতাটিতে সর্বত্র পর্বসংখ্যা সমভাবে সুরক্ষিত হয়নি। কিন্তু অতিপর্ব, অপূর্ণ পর্ব এবং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কবিতাটি ২+৬+৪ পূর্ণমাত্রাকারে সুবিন্যস্ত। বিদ্রোহী কবিতায় কবি অনুপ্রাস, রূপক, উপমা প্রয়োগে অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ সম্পর্কে ছান্দসিক কবি আব্দুল কাদির তাঁর ‘ছন্দ সমীক্ষণ’ গ্রন্থে লিখেছেন, আধুনিককালে রবীন্দ্রনাথের নিরলস সাধনাতেই এই ছন্দটি লাভ করেছে তার সুঠাম ও সুমার্জিত রূপ। রবীন্দ্রনাথই বাংলা মাত্রাবৃত্তের উদ্ভাবয়িতা। এ ছন্দে যুগ্ম ধ্বনি সর্বত্র দুই মাত্রার মর্যাদা পেয়ে থাকে। এই বিধানের কোনো প্রকার ব্যতিক্রমের অবকাশ নেই। এই নীতি নিষ্ঠাসহকারে অনুসরণেই হয়েছে এ ছন্দের প্রতিষ্ঠা।
বাংলা মাত্রাবৃত্তকে তার প্রতি পর্বে ও পদে মাত্রাসংখ্যার সমাবেশ বিচার করে চতুর্মাত্রক, পঞ্চমাত্রক, ষাণ¥াত্রক, সপ্তমাত্রক, অষ্টমাত্রক ও মিশ্রপর্বিক এই ছয় শ্রেণিতে ভাগ করা চলে।১
‘মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পর আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুন বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাণশক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্যের অন্যতম ধারক তাঁর ছন্দ-পরীক্ষার নানা মাত্রিক উৎকর্ষ। বাংলা তিন রীতির ছন্দেই তাঁর পরীক্ষা-উত্তীর্ণ সফলতা বর্তমান। তবু তাঁর উৎকর্ষের ও নবতর অবদানের প্রধান দুটি ক্ষেত্র স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ।’২
বিদ্রোহী কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত হলেও সর্বত্র পর্ব ও মাত্রাসংখ্যা সমভাবে সুরক্ষিত হয়নি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এক শ ছেচল্লিশ বার ব্যবহৃত ‘আমি’র অধিকাংশ ‘আমি’ই অতিপর্ব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা সর্বত্রই দুই মাত্রা কিন্তু প্রতি পঙ্ক্তির শেষ অপূর্ণ পর্বটি সর্বত্র সমমাত্রাসম্পন্ন নয়। বিদ্রোহী কবিতার প্রথম ও দ্বিতীয় পঙক্তি
“বল বীর
বল উন্নত মম শির”
এখানে প্রথম পঙ্ক্তি চারমাত্রা বিশিষ্ট অর্থাৎ বল + বীর=২+২=৪
কিন্তু দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে ‘বল’কে অতিপর্ব হিসেবে বিবেচনা না করলে মাত্রা বিন্যাস লিখতে হবে ৬+৪; যে মাত্রা বিন্যাস বিদ্রোহী কবিতার ‘ফিং দিয়া দিই তিন দোল’ (৬+৪), স্বর্গ মর্ত্য করতলে (৬+৪), হিম্মত হ্রেষা হেঁকে চলে (৬+৪), বিদ্রোহী রণক্লান্ত (৬+৪) পঙ্ক্তিতে পরিলক্ষিত হয়। তারপরও এ কথা মানতেই হবে যে, দ্বিতীয় পঙ্ক্তির মাত্রা বিন্যাস হবে ২+৬+২। তবে বিদ্রোহী কবিতার পূর্ণ পর্ব সর্বত্রই ছয় মাত্রা। সুতরাং বিশ্ববিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতার শুরুর পঙ্ক্তিই অপূর্ণ পর্ব দিয়ে শুরু হয়েছে। প্রথম পঙ্ক্তির ‘বল’কে অতিপর্ব বিবেচনারও ন্যূনতম সুযোগ নেই। কারণ শুধু অতিপর্ব ও অপূর্ণ পর্ব দিয়ে পঙ্ক্তি বিনির্মাণ হয়েছে এটি চিন্তা করা কাব্য ছন্দ বিচারে অত্যন্ত হাস্যকর বিষয়। এ বিষয়ে স্মরতব্য যে, নজরুলের মতো এত বড় মাপের কবির পক্ষে ছন্দ নিয়ে খেলা করার যথেষ্ট যোগ্যতা ছিল বলেই এমন কবিতা রচনা সম্ভব হয়েছে। নজরুলের প্রিয় একটি ছন্দ মাত্রাবৃত্ত। তাই তিনি বিদ্রোহী কবিতায় এ ছন্দের এক অপূর্ব খেলা দেখিয়েছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছন্দ বিন্যাস করতে গিয়ে আধুনিক গানের জনক ছান্দসিক গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান লিখেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলামও ছন্দ নিয়ে নানা ধরনের নিরীক্ষা করেছেন। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এক অদ্ভুত প্রবহমানতা এনেছেন তিনি বিদ্রোহী কবিতাতে। এই প্রবহমানতা আনতে গিয়ে যে কীর্তিটি তিনি করেছেন তা অসাধারণ। গোটা কবিতাটিতে অসংখ্য মধ্যখ-নের নৈপুণ্য তো আছেই- তার সঙ্গে অপূর্ণ ও অতি পর্বের এক অভূতপূর্ব বিন্যাস। যেখানে পূর্বপঙক্তির অপূর্ণপর্বের সঙ্গে পরবর্তী পঙ্ক্তির অতিপর্ব যোগ করলে একটি পূর্ণ পর্বের সমান হয়। যেমন,
‘আমি/ সন্ন্যাসী সুর/ সৈনিক (২+৬+৪)
আমি/ যুবরাজ, মম/রাজবেশ ম্লান/গৈরিক! (২+৬+৬+৪)
আমি/ বেদুইন, আমি/ চেঙ্গিস (২+৬+৪)
আমি/ আপনারে ছাড়া /করি না কাহারে/ কুর্নিশ। (২+৬+৬+৪)
আমি/........
এখানে প্রথম পঙ্ক্তি শেষে অপূর্ণপর্ব আছে ‘সৈনিক’। ভেঙে লিখলে হয় ‘সইনিক’। মাত্রাবৃত্ত ছন্দানুযায়ী যা চারমাত্রা বিশিষ্ট। পূর্বপঙ্ক্তির অপূর্ণপর্বেও চারমাত্রা এবং পরের পঙ্ক্তির অতিপর্বেও দুইমাত্রা যোগ করলে ছয় মাত্রার একটি পূর্ণ পর্বের সমান হয়। ফলে এক প্রবাহে পাঠ করা যায়। একইভাবে গৈরিক (গইরিক) এর সঙ্গে ‘আমি’ ‘চেঙ্গিস’ (চেংগিস) এর সঙ্গে ‘আমি’ ‘কুর্নিশ’ (কুরনিশ) এর সঙ্গে ‘আমি’ যোগ করলে ছয়মাত্রা হয়, যা পূর্ণপর্বের মাত্রা সংখ্যার সমান।
কিন্তু যেখানে তিনি প্রবহমানতা ভাঙতে চেয়েছেন এবং শ্বাসযতি দিতে চেয়েছেন সেখানেই অপূর্ণ পর্বের মাত্রা সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। যেমন,
এখানে দেখা যাচ্ছে অপূর্ণ পর্বের মাত্রা সংখ্যা তিন। এই একই কবিতায় দুই মাত্রার অপূর্ণ পর্বও আছে। যেমনÑ
আমি/ চিরবিদ্রোহী/ বীর (২+৬+২)
আমি/বিশ্ব ছাড়ায়ে/উঠিয়াছি একা/ চির উন্নত /শির (২+৬+৬+৬+২) ৩
বিদ্রোহী কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বিলম্বিত লয়ের কবিতা। ছন্দের সঙ্গে লয়ের সম্পর্ক প্রণিধানযোগ্য। ‘ছন্দ চিনি যেমন করে’ গ্রন্থে মো. হারুন-অর-রশীদ লিখেছেন, ‘কবিতা পাঠের সময় উচ্চারণের গতিবেগ যখন দ্রুত ও ধীর লয়ের মাঝামাঝি বা মধ্যম ভঙ্গিতে হয় এবং যাতে প্রতি অক্ষর বা ধ্বনি স্পষ্টভাবে উচ্চাারত হয় তখন তাকে মধ্য লয় বা বিলম্বিত লয় বলে।৪
এ প্রসঙ্গে তিনি বিদ্রোহী কবিতার চারটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করেছেন।
চার পঙ্ক্তির উদাহরণ এটি। প্রতি পঙ্ক্তির পর্ব সংখ্যা পাঁচ। পর্বে মাত্রা সংখ্যা ছয়। প্রথম দুই পঙ্ক্তির শেষ পর্ব অপূর্ণ; চার মাত্রার; শেষ দুই পঙ্ক্তির শেষ পর্বও অপূর্ণ; তিন মাত্রার। পর্বারম্ভেও ‘আমি’ দু’মাত্রার অতিপর্ব। পঙ্ক্তির মাত্রা বিন্যাস, ৬+৬+৬+৪ =২২; ৬+৬+৬+৩=২১। লয়: বিলম্বিত। ছন্দ: মাত্রাবৃত্ত।৫
বিদ্রোহী কবিতাটি মুক্তক ছন্দে রচিত। মুক্তক ছন্দ সম্পর্কে ছন্দ পরিচিতি বইয়ে এস এম আব্দুল লতিফ লিখেছেন, ‘অসমদীর্ঘ চরণের ছন্দকে বলা হয় মুক্তক। এ ছন্দের ব্যাপক এবং সুষ্ঠু প্রয়োগ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অমিত্রাক্ষর এবং গৈরিশ ছন্দের মতো মুক্তক ছন্দও প্রবহমানতা রয়েছে। এই ছন্দে প্রতি পঙ্ক্তির অক্ষর সংখ্যা অসমান অর্থাৎ পয়ার এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের মতো পঙ্ক্তির মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়।...যে মুক্তক ছন্দে অন্ত্যানুপ্রাস থাকে তাকে সমিল মুক্তক ছন্দ বলে’৬
সুতরাং বিদ্রোহী কবিতা মুক্তক ছন্দে রচিত এতে কোনো বিতর্ক নেই।
‘সাধু বাংলার মুক্তক ছন্দকে সাধারণত অক্ষরবৃত্তের পর্যায়ে এবং চলিত বাংলার মুক্তককে স্বরবৃত্ত ছন্দের পর্যায়ে ধরা হয়। তবে মাত্রাবৃত্তের মুক্তক ছন্দে রচিত অনেক কবিতা পাওয়া যায় :
এই পঙ্ক্তিতে যে মাত্রাবিন্যাস করেছেন সেটি বিতর্কিত। কারণ, ‘সৃষ্টি আমি’ ৫ মাত্রা নয়। এটি ছয় মাত্রা। ‘সৃষ্টি’ শব্দটি ভেঙে লিখলে দাঁড়ায় ‘সিরিষটি’ সুতরাং এখানে চার মাত্রা এবং আমি-তে দুই মাত্রা মিলে হয় ছয় মাত্রা। আবার ‘ধ্বংস’ শব্দটিতেও চার মাত্রা রয়েছে তাই ‘ধ্বংস আমি’-তে ছয় মাত্রা রয়েছে।
‘রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রানুসারীদের মাত্রাবৃত্ত রচনায় প্রতি চরণের শেষেই শ্বাসযতি নির্ধারিত। কাজী নজরুল ইসলাম এই নির্ধারিত রীতি অনুসরণ করে প্রচুর কবিতা লিখলেও তাঁর প্রধান কৃতিত্ব মাত্রাবৃত্তে প্রবহমানতা সঞ্চার। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এর উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। ৬ মাত্রার চালে রচিত কবিতাটিতে অসম চরণ ব্যবহারে প্রচুর স্বাধীনতা গ্রহণের ফলে এবং প্রায় প্রতি চরণেই অতিপর্ব প্রয়োগের জন্য অভিনব গতি এসেছে। বিশেষত পূর্ব চরণের অপূর্ণ পর্বের পর পরবর্তী চরণের অতিপর্ব দুটি চরণের মধ্যবর্তীকালীন ফাঁক ভরাট করেছে এবং চরণ থেকে চরণে কবিতার গতিকে প্রবাহিত করে দিয়েছে।
আমি/ অনিয়ম উচ্/ ছৃংখল (২)+৬+৪
আমি/ দলে যাই যত/ বন্ধন যত/ নিয়ম কানুন/ শৃংখল (২)+৬+৬+৬+৪
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, উদ্ধৃতাংশে প্রথম চরণের অপূর্ণ পর্বের ৪ মাত্রা ও দ্বিতীয় চরণের অতিপর্বের দুই মাত্রা একত্রে একটি পূর্ণ পর্বের সমান ওজনের, দ্বিতীয়, তৃতীয় চরণেও একইভাবে প্রবাহ অক্ষুণœ, তৃতীয় চরণের অপূর্ণ পর্বে এক মাত্রা বিরতি শ্বাসযতির সুযোগ দিচ্ছে, চতৃর্থ চরণেও তাই।৮’
৬ মাত্রার পূর্ণ পর্বের মাত্রাবৃত্তে রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কিছু কিছু পঙ্ক্তির পূর্ণ পর্বে ছয় মাত্রা রক্ষিত হয়নি। যেমন,
‘বিদ্রোহী’ কবিতার ছন্দ নির্ণয় করতে গিয়ে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত মুক্তক সমিল ছন্দে রচিত।
বিদ্রোহী কবিতার অলংকার
অলংকার শব্দটি সংস্কৃত অলম অর্থাৎ ভূষণ থেকে উদ্ভূত। ভূষণ শব্দের অর্থ হলো সজ্জিত করা। কাব্যকে ব্যঞ্জনাধর্মী, সমধুর ও সুললিতকরণে অলংকারের গুরুত্ব সীমাহীন। অলংকারশাস্ত্রকে উপেক্ষা করে তাই কাব্যসৃষ্টি পাথরে ফুল ফোটানোর মতোই কল্পনাশ্রিত বিষয়মাত্র।
শব্দের সৌকর্যে সাহিত্য হয় হৃদয় ছোঁয়া। নূপুরের নিক্কন কিংবা জল তরঙ্গ হিল্লোল যেমন শ্রুতিমাধুর্য সৃষ্টি করে তেমনি শব্দের সুনিপুন ব্যবহার ও একই শব্দে ধ্বনির পুনঃ পুনঃ ব্যবহারে বাক্য হয়ে ওঠে কাব্যময়।
‘শব্দের ধ্বনির সাহায্যে সৌন্দর্য বা সৌকর্য সৃষ্টি করে অলংকার তাকে শব্দালংকার বলে।১০
শব্দালংকার কেবল শব্দেরই অলংকার শব্দের ধ্বনি রূপের আশ্রয়ে তা গড়ে ওঠে। তাই তার ধ্বনি রূপের বদল ঘটলে অলংকারেরও পরিবর্তন ঘটে।১১
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বিভিন্ন প্রকার শব্দালংকার পরিলক্ষিত হয়। শব্দালংকারে সুসজ্জিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নানা দিক নি¤œরূপÑ
১. অনুপ্রাস
একই ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছ বারবার ব্যবহৃত হয়ে ছন্দে ঝংকার তুললে, তাকে অনুপ্রাস বলে। যেমন :
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য।
এখানে ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী’তে প্রতিটি শব্দ ‘ব’ ধ্বনি দিয়ে শুরু হয়েছে। সুতরাং এখানে অনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বিভিন্ন প্রকার অনুপ্রাস ব্যবহৃত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তরূপে।
ক. অন্ত্যানুপ্রাস
অন্তমিলসম্পন্ন সব কবিতায় এ অনুপ্রাস সহজেই দৃশ্যমান হয়। যেমন :
‘আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, একি উন্মাদ, আমি উন্মাদ,
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।
অথবা
আমি শ্রাবণ প্লাবন বন্যা,
কভু ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস ধন্যা।
ওপরের দুই পঙ্ক্তিতে দ,ধ এবং শেষ দুই চরণে ‘ন্যা’ মেলবন্ধন মূলত অন্ত্যানুপ্রাসের উদাহরণ।
খ. বৃত্ত্যনুপ্রাস/গুচ্ছ অনুপ্রাস
একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে অথবা ব্যঞ্জনধ্বনি গুচ্ছাকারে ক্রমানুসারে সংযুক্ত অথবা অযুক্ত বা বিযুক্তভাবে বারবার ধ্বনিত হলে গুচ্ছ অনুপ্রাস/বৃত্ত্যনুপ্রাসের সৃষ্টি হয়।
‘ভূলোক দুলোক গোলক ভেদিয়া’
‘নজরুলের এ চরণটিতে অযুক্ত ব্যঞ্জনগুচ্ছ ‘লোক’ ধ্বনির ক্রম রক্ষা করেই বারবার উচ্চারিত হয়ে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয়েছে।’১২
১. শির/ নেহারি আমারি/ নত শির ওই/ শিখর হিমাদ্রির! এ পঙ্ক্তিতে ‘শ’ এর বৃত্ত্যনুপ্রাস এবং নেহারি আমারি ছেকানুপ্রাস হয়েছে।
২. উঠিয়াছি চির-/বিস্ময় আমি/ বিশ্ব-বিধাতৃর! এখানে ‘বিস্ম’ এবং ‘বিশ্ব’ ব্যবহারের মাধ্যমে ছেকানুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।
৩. মম/ ললাটে রুদ্র/ ভগবান জ্বলে/ রাজ- রাজটীকা/ দীপ্ত জয়শ্রীর! এ পঙ্ক্তিতে ‘র’ এর বৃত্ত্যনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।
৪. আমি/ বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা পথিকের,
আমি/অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতিফের! এই পঙ্ক্তি দুটিতে ‘কের’ এবং ‘ফের’ ব্যবহারে শ্রত্যুঅনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।
আমি/ ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প। এই পঙ্ক্তি দুটিতে ‘লম্ফ’ এবং ‘কম্প’ ব্যবহারে শ্রত্যুঅনুপ্রাস সৃষ্টি হয়েছে।
অর্থালংকার
‘যে অলংকার একান্তভাবে শব্দের অর্থের ওপর নির্ভর করে; অর্থ প্রকাশক শব্দ বা শব্দাবলিকে পরিবর্তিত করে সেখানে সমার্থক অন্য কোনো শব্দ বসিয়ে দিলেও যে অলংকার অক্ষুণœ থাকে তাকে অর্থালংকার বলে। অর্থালংকার শব্দের অর্থের ওপর নির্ভরশীল।’১৩
বহুপ্রকার অর্থালংকার রয়েছে। সাদৃশ্যমূলক অর্থালংকারের ব্যবহার বেশি দৃশ্যমান হয়। এই অলংকারের মধ্যে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, অপহ্নূতি, প্রতিবস্তুপমা, ব্যতিরেক, নিদর্শনা, ভ্রান্তিমান, সমাসোক্তি, প্রতীপ, সন্দেহ, দৃষ্টান্ত, নিশ্চয়, তুল্যযোগিতা, দীপক, উল্লেখ, সহোক্তি, অর্থাপত্তি, অনন্বয়, সূক্ষ্মœ অলংকার এবং অর্থ- শ্লেষ ইত্যাদি প্রধান।
উপমা : বিদ্রোহী কবিতায় প্রচুর উপমা ব্যবহার করা হয়েছে।
‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য করতলে’
উপমা/ উপমান : ঝড়
উপমেয় : করতালি
সাধারণ ধর্ম : ছুটি (ছোটা/দৌড়ানো)
সাদৃশ্যবাচক শব্দ : মতন
বিদ্রোহী কবিতায় লুপ্তোমা বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।
‘শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির
উপমেয় : শির, উপমান : শিখর হিমাদ্রি,
সাধারণ/ সাধর্ম- নেহারি নত
সাদৃশ্যবাচক শব্দ লুপ্ত
রূপক :
যে অলংকারে রূপ, স্বরূপ প্রভৃতি রূপজ্ঞাপক শব্দ প্রায় উহ্য থাকে এবং উপমান ও উপমেয়র অভেদ কল্পনা করা হয় সে অলংকার রূপক অলংকার হিসেবে পরিচিত। রূপক প্রসঙ্গে ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, ‘উপমান ও উপমেয়ের তুলনা করতে গিয়ে যখন তাদের অভেদ কল্পনা করা হয় তাকে রূপক বলে।১৪
বিভিন্ন প্রকার রূপকের মধ্যে বিদ্রোহী কবিতায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে মালা নিরঙ্গ রূপক। একটি উপমেয়কে অবলম্বন করে বিভিন্ন উপমানের দ্বারা বিভিন্ন রূপ বা বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটলে মালা নিরঙ্গ রূপক হয়। সম্ভবত হিন্দু পুরাণ, গ্রিক পুরাণ ও মুসলিম ঐতিহ্যগত শব্দ; প্রচুর ব্যবহারের কারণে এটি ঘটেছে।
যেমন,
আমি উত্তর বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক কবির গভীর রাগিণী, বেনু- বীণে গান গাওয়া।
এখানে উপমেয় ‘আমি’; উপমান উত্তর বায়ু, মলয়-অনিল, পূরবী হাওয়া, গভীর রাগিণী, গান। মোট ছয়টি রূপকের মালা।
আমি পিনাক পানির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দ-,
আমি চক্র, মহাশঙ্খ, আমি প্রণব নাদ প্রচ-।
এখানে উপমেয়-আমি; উপমান- ডমরু, ত্রিশূল, দ-, চক্র, মহাশঙ্খ এবং প্রণদ-নাদ।
মোট ছয়টি রূপকের মালা।
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু- জ্বালা, বিষধর কাল- ফণী!
এখানে উপমেয়- আমি, উপমান- অন্যায়, উল্কা, শনি, ধূমকেতু, কাল- ফণী!
মোট পাঁচটি রূপকের মালা।
বীর রস এ রচিত বিদ্রোহী কবিতা
বাংলা ব্যাকরণে রসতত্ত্ব নিয়ে বিশেষ ও বিশদ আলোচনা আছে। রস এর প্রকার নিয়েও রয়েছে নানা প-িতের নানা মত। তবে বীর রস নিয়ে লিখতে গিয়ে আবুল ফজল ও রেজাউল ইসলাম নি¤œরূপ মতামত প্রদান করেছেন,
‘বীররস নানা বিস্ময়কর বৈচিত্র্যে ভরা। সে কারণে আলংকারিকরা একে নানা ভাগে বিভক্ত করেছেন। ভরতমুনি বীররসকে দানবীর, ধনবীর এবং যুদ্ধবীর এ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। বিশ্বনাথ কবিরাজ এর সাথে ‘দয়াবীর’ যোগ করে বীররসকে চারভাগে ভাগ করেছেন। সপ্তদশ শতকের প-িতরাজ জগন্নাথ এ চার প্রকারের সাথে আরো চার প্রকার যোগ করে মোট আট ভাগে বিভক্ত করেছেন। তাঁর সৃষ্ট অতিরিক্ত চারটি বীররস হচ্ছে- সত্যবীর, পা-িত্য বীর, ক্ষমাবীর ও বলবীর। তবে বহুল প্রচলিত অলংকারশাস্ত্র ও অভিধানে ‘বীর’ বলতে সাধারণভাবে যুদ্ধবীরকেই বোঝানো হয়েছে।
বলবীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাতৃর!
...বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
এখানে কবি দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙায় আত্মশক্তির উদ্বোধন প্রতিষ্ঠা কামনা করেছেন আন্তরিকভাবে। এ কবিতা পাঠে পাঠক মনে উৎসাহ জেগে ওঠে, যা বীর রসে রূপান্তরিত হয় সহজেই।১৫
অমর কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ও মানব মনের অব্যক্ত অভিপ্রায় প্রকাশে বাংলা সাহিত্য শুধু নয়; বিশ্বসাহিত্যে অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যথোপযুক্ত শব্দ ব্যবহার ছন্দমাত্রার অতি উৎকর্ষ মুন্সিয়ানায় কবিতাটি বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যের দাবি রাখে। ছন্দালংকারের ঝনঝনানি যে সাগরের চিরায়ত জলকল্লোলকেও অতিসহজে হার মানাতে পারে, তা বিদ্রোহী কবিতার প্রতি পঙ্ক্তি প্রমাণ বহন করে চলেছে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের বিলম্বিত লয়ে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হলেও শব্দ, অনুপ্রাস এবং রূপক এত স্বতঃস্ফূর্ত রূপে ব্যবহৃত হয়েছে যে কবিতাটি পাঠের সময় মনে হবে যেন স্বরবৃত্ত মাত্রার দ্রুত লয়ে লেখা। বিদ্রোহী কবিতায় কবি কাউকে দাসত্ব করতে চাননি কিন্তু বিদ্রোহী কবিতার প্রতিটি ধ্বনি, শব্দ, পঙ্ক্তি, চরণ- উপমা, রূপক এবং অনুপ্রাসকে অনুসরণ করে বিদ্রোহী কবিকে দাসত্ব করেছে। বিশ্ববিখ্যাত কবির বিশেষ বিশেষত্ব হয়ত এটাই।
তথ্যনির্দেশ
১। আব্দুল কাদির, ছন্দ সমীক্ষণ (ঢাকা : মুক্তধারা, প্রথম প্রকাশ, জুলাই ১৯৭৯) পৃষ্ঠা নং ২৫।
২। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, বাংলা কবিতার ছন্দ (ঢাকা : প্রথম প্রকাশ, ১৫ আগস্ট ১৯৭০, ৫ম
হাওলাদার সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৩) পৃষ্ঠা ১০২।
৩। মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, বাংলা গান রচনা কৌশল ও শুদ্ধতা (ঢাকা : প্রথম প্রকাশ, একুশে
বইমেলা, ২০১২) পৃষ্ঠা ৮৩-৮৪।
৪। মো. হারুন-অর-রশীদ, ছন্দ চিনি যেমন করে (ঢাকা : প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১২, কালি