শহীদ কাদরী। বাংলা কবিতার ইতিহাসে এই নামটি যেন কোন গ্রহ থেকে খসে পড়া এক উজ্জল নক্ষত্রের মতো। নিজ গ্রহ থেকে ছিটকে পড়েছেন ঠিকই, কিন্তু উজ্জ্বল আলোয় তিনি ঠিক মিটিমিটি জ্বলছেন আরেক ভুবনে। তাই শহীদ কাদরীর জীবন ও তাঁর কাব্য আমাদের নিত্য ভাবায় এবং বিস্ময় সৃষ্টি করে ।
শহীদ কাদরীকে যাঁরা জানেন তাঁরা সবাই স্বীকার করবেন যে তিনি আড্ডা দিতে যত ভালোবাসেন তার চেয়ে কম ভালোবাসেন তার লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করতে। এরকম প্রচারবিমুখ কবি আমাদের আশে-পাশে খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন। লেখালেখির প্রসঙ্গ এলেই তাঁর নির্লিপ্ত উত্তর, “আরে দুর, ওসব বাদ দাও।” তবে অবাক বিষয় তিনি নিজের লেখালেখি নিয়ে উৎসাহ না দেখালেও বাংলাদেশের বর্তমান লেখকদের সম্পর্কে অনেক বেশি আগ্রহ দেখাতেন। কিন্তু পর্দার আড়ালে তিনি নিজেকে যতই গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন, এ কথা তো সত্য যে পঞ্চাশ উত্তর বাংলা কবিতায় আধুনিক মননের ছাপ এবং জীবনবোধ সংযোগ ঘটিয়ে কবিতার উৎকর্ষে যাঁরা নিমগ্ন ছিলেন কবি শহীদ কাদরী ছিলেন সে দলের অন্যতম একজন কারিগর।
একথা তো সবারই জানা যে তিনি লিখেছেন খুব কম কিন্তু মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ (উত্তরাধিকার, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা এবং কোথাও কোন ক্রন্দন নেই) দিয়ে কবি শহীদ কাদরী বাংলা কাব্য আসনে একটি স্থায়ী আসন তৈরী করে নিয়েছেন। কবি যখন বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, ঠিক তখনিই যেন তাঁর বিদ্রোহী মন বেঁকে বসল। সবকিছু ছেড়েছুড়ে তিনি পাড়ি জমালেন ইউরোপে। জার্মান, ইংল্যান্ড হয়ে তিনি এখন উত্তর আমেরিকায় স্বেচ্ছা প্রবাসবন্দী। কিন্তু কেন এই বন্দিত্ব? না, আমরা সে খবর কেউ জানি না, আর তা জানা হয়ত সম্ভবও নয়। তবে একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে নিশ্চয় এর পেছনে কোন কারণ ছিল। হয়ত বুকচাপা কোন অভিমান অথবা বড্ড এলোমেলো পরিতোষন সমাজের গুমোট আলো-হাওয়ায় কবির মনকে বিক্ষিপ্ত করেছিল। অথবা হয়তো কিছুই নয়। শহীদ কাদরীর বাউল মনই তাঁকে দেশ থেকে দেশান্তরিত করেছিল। শহীদ কাদরী নিজেই তার উত্তরাধিকার কাব্যগ্রন্থে এর জবাব দিয়েছেন এইভাবে,
“ না শহীদ সেতো নেই; গোধুলিতে তাকে
কখনও বাসায় কেউ কোনদিন পায় নি, পাবে না।” (অগ্রজের উত্তর)
তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে কাদরীকে? কি সেই অনির্দেশ্য যন্ত্রণা যা কবিকে সবসময় তাড়িত করে বেড়ায়? কেন এই পলায়ন বা আত্মনিমজ্জন? একজন মানুষের ভেতরে আরেকটি অচেনা মানুষকে নিরন্তর খোঁজার এক অতৃপ্তি থেকেই কি কবির এই সহজ-সরল স্বীকোরক্তি? কি সেই অদেখা সত্তা যাকে আমরা নিত্য খুজে বেড়াই? অথবা সত্যিই কি তাকে কি খুজে পাওয়া সম্ভব? তারপরও আমাদের নিরন্তর চেষ্টা চলে মনের সেই গহীন কূপে বাস করা সেই অদৃশ্য, মৃয়মান, অদেখা, প্রজ্জলিত, নিবীর সত্বাটাকে নিত্য আবিস্কার করা। আর এই আবিস্কার করতে যেয়েই শুরু হয় মনোজগতের এক নিদারুন তোলপার, না পাওয়ার এক অসমান্য হৃদয় ব্যাদনা, জন্ম নেয় ক্ষোভ আর ব্যার্থ আস্ফালোনের। তখন শহীদ কাদরী ব্যাক্তি মানুষটির ভেতর শুধুই কি একজন কাদরী বাস করে?
“না,না, তার কথা আর নয়,সেই
বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো – শহীদ কাদরী বাড়ি নেই”
মিষ্টিক কবি লালনের গানেও আছে সেই একই আর্তি।” আমি একদিনও না দেখিলাম তারে, বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা পড়শী বসত করে”। কবির বহেমিয়ান মন যা তাঁর কবি চিত্তকে সবসময় অস্থির এবং অতৃপ্তির চাদরে ঢেকে রেখেছিল। কিন্তু কি সেই অতৃপ্তী? কি সেই জীবনের লেনদেনের গোপন হিসেব-নিকেশ যা একজন কবিকে নিত্য অস্থিরতায় তাড়িত করে বেড়ায়? পরিশ্রান্ত জীবনের এই শ্রান্তি অন্বেষণ কি শুধুই কল্পনার ডুবসাতার খেলা?
বন্য শূকর খুজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ(সঙ্গতি)
সন্দেহ নেই কবির এই সহজ সরল উক্তি আমাদের কে আলোর পথ দেখায়, আশান্বিত করে এবং তমস জীবনের অজানা-অচেনা অলি-গলিতে আশার আলোর দ্যুতি ছড়ায়। তখন মনে হয় সত্যিই প্রাণ আছে, আশা আছে, সুখ আছে, ভালোবাসা আছে। কিন্তু সবকিছুর পরও শান্তি আছে কি? কাদরী কবিতায় তারই আভাস দিচ্ছে।
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকের সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...(সঙ্গতি)
তাহলে কি এবসোলুট শান্তি বলতে কিছুই নেই! এই ‘না’ এর মাঝেও ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘হ্যাঁ’ এর মাঝে ‘না’ এর অস্তিত্ব যেন উতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে। আমরা যাকে সুখ বলে আপাত ভাবছি সেখানেও রয়েছে হাজার মাইল ব্যাবধানের শুণ্যতার এক বিষন্ন দেয়াল। সেখানে শান্তি কখনও ধরা দেয় না বা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে এই না পাওয়ার আর্তির আরেক বিরহ নামই কি জীবনের কঠোর বাস্তবতা, জীবন প্রবঞ্চনা? যেখানে স্বপ্ন শুধু হাতছানি দিয়ে ডাকে আর নিত্য প্রলুব্ধ করে বেড়ায় নতুন সকালের।
“কেবল লতায় আর গুল্মে -ঠাসা এ এ্যাকুরিয়ামে মাছ নেই-এ-ও সত্য নয় পুরোপুরি-
আমাদের ভালোবাসার প্রাক্তন প্রহরগুলো আমার কামরার জলে
লাল, নীল, সোনালি মাছের মতো লেজ তুলে ঘুরছে, প্রিয়তমা। (এ-ও সঙ্গীত)”
এই তমস অন্ধকার ভরা জীবনের পরের বাকেই দেখি জীবনের আরেক গল্পমালা, সুদীপ্ত আকাশে সোনালি সূর্যের নির্মল আলোক ছটা। জীবনের স্বাদ তখন প্রতিফলিত হয় জীবনের জয়গানে, অনুরনিত হয় আকুল জীবন বন্দনায়। তারপরও কোথায় যেন শূন্যতার আভাস, অপূর্নতার ছবি। সে শূন্যতায় ভেসে বেড়ায় জীবনের আর্তি।কে যেন চীৎকার করছে প্রাণপণে’ গোলাপ! গোলাপ!’( বাংলা কবিতার ধারা) । অডেনের কবিতাতেও সেই একি সুর বাজে,
Say This City has ten million souls,
some are living in mansions,some are
living in holes;
Yet there’s no place for us,my dear, yet
there’s no place for us(ten songs)
কিন্তু এই নিঃসার উক্তিইতো জীবন বন্দনার শেষ কথা হতে পারে না। ভালোবাসা আর শান্তির কি কোথাও কোন জায়গা নেই? জীবনের আপাত সৌন্দর্য্যের আড়ালে শুধুই কি এই ভয়াবহতার কঠোর পদচিহ্ন ? কিন্তু কবি আহ্বান করলেন সেই সুন্দরকেই আবিস্কার করার। কঠোরতার আচল সরিয়ে কবি চোখ রাখতে চান সেই অনাগত সুন্দরের প্রতি।
“ঊরু আর নাভি অনেক খুঁড়লে
প্রেমের সঙ্গে একটা দিন
না হয় কিছু জমলো ঋণ” (একটা দিন)
শহীদ কাদরী আধুনিক নগর ভাবনার কবি। তার কবিতার শরীর জুড়ে শহরের ব্যাস্ত জীবনের ছাপ সুস্পষ্ট। কবির জন্ম, সোনালি কৈশর, যৌবনের সমস্ত আয়োজনই ছিল শহর কেন্দ্রিক। আর সে কারনেই হয়তো তার কবিতায় শহর এসেছে স্বতস্ফুর্তভাবে, স্বাভাবিক নিয়মে।
“আমি করাত-কলের শব্দ শুনে মানুষ।
আমি জুতোর ভেতর, মোজার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া মানুষ (এবার আমি)
শহুরে জীবনের সুখ, দুঃখ, চিত্র, বৈচিত্র, ইট-কাঠ দালান কোঠার শক্ত বুননে ঠাসা মানুষের জীবন কবি কাছ থেকে দেখেছেন বলেই তার কবিতায় শহরের শব্দাবলি উঠে এসেছে অত্যান্ত কাব্যিক এবং সংগতভাবেই। আর সেকারনেই নাগরিক পরিভাষা শহীদ কাদরীর কবিতার এক অনন্য অলংকার। মটরের বনেট, পার্ক, সিনেমার কিউ, করাতকল, ল্যাম্পপোষ্ট, কারফিউ, রেঁস্তোরা, ট্রাফিক সিগন্যাল, ট্যাক্সি, ফুটপাত ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে কবি একাত্বতা বোধ করেছেন তার নাগরিক বোধ থেকেই। তবে এই নাগরিক বোধের একদিকে যেমন রয়েছে দীপ্র আধুনিকতা আবার এর উল্টোপিঠে তিনি অনেক নিঃসঙ্গ এবং অসহায়। সেখানে শুধু নগর জীবনের রুগ্নতা, হীনতা, নিঃসঙ্গতা, ক্লেদ আর শুন্যতার চিত্র।
কিন্তু এই অন্ধকার থেকে পরিত্রান চান কবি। কবি স্বপ্ন দেখেন সুন্দর সকালের, আলোকিত জোৎস্নাখচিত রাতের আকাশের। যেখানে সমাজ সৃষ্ট পাপ আর পাপ থাকেনা তা অবলিলায় মানবিকতায় উত্তির্ন হয়ে পূণ্যেতায় রুপ নেয়।
দেশপ্রেম, স্বাদেশিকতা, আন্তর্জাতিকতাবাদ ঠাসা কবি শহীদ কাদরীর কবিতায়। রাষ্ট্র জন্মের রক্তাক্ত ইতিহাস,সামরিকবাহিনীর অস্ত্রসজ্জা, যুদ্ধমহড়া এ সবকিছুর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কবির কবিতায় দেদিপ্যমান। তাই হয়তো কবি তাঁর প্রিয়তমা দেশ কে অভিবাদন জানাচ্ছেন হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ,চকোলেট,টফি আর অ্যাকর্ডিয়ানের সুরের ভালোবাসা দিয়ে। তীব্র রাজনৈতিক চেতনাবোধ এই স্বাপ্নিক কবি এমন একটি প্রিয়তম স্বদেশ কে দেখতে চান যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের কূটকৌশলের সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে সেনাবাহিনি গোলাপের গুচ্ছ কাধে নিয়ে মার্চপাষ্ট করে চলে যাবে এবং স্যলুট করবে, হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, আর্কেডিয়ান বাজাতে বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে।
যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। এই মতবাদকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন বলেই একজন কবিই হয়তো এমনভাবে বলতে পারেন,
“ক্যাপটেন, এবার তুমি চিৎকার করে বলে ওঠো ‘হ্যান্ডস আপ’
টলে-পড়া গোলাপ দাঁড়িয়ে পড়–ক তার ঝাড়ে,
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাক ছুরি।” (কেন যেন বলছে)
কিন্তু কবির এই মর্মবাণী কতটুকুই বা পৌছতে পারে শোষকের কানে? শোষকের কাজইতো শোষন করা। অন্যায়ভাবে মানুষের ভালোবাসা আর বিবেকের টুটি চেপে ধরা। এই নিদারুন ব্যার্থতা কবির মন কে আশাহুত করে, উদ্বেলিত করে।
“তুমি গান গাইলে,
জাতিসংঘের প্রস্তাব লঙ্ঘন করে সারি সারি ট্যাঙ্ক
জলপাই পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে
খুব ভয়াবহভাবে যুদ্ধবিরতির সীমারেখা পার হলো” (তুমি গান গাইলে)
শত ব্যর্থতার পরও কবি ভালোবাসায় ভরা স্পপ্নের জাল বুনেন। এই আশাবাদ আছে বলেই জীবনের সুন্দর মসৃন পথের বাঁকে বাঁকে হাজারো খানাখন্দ পেরিয়ে কবি জীবনের নতুন উজ্জল আলোটাকে ছুঁতে চান। এই হতাশা আর প্রাণের ব্যার্থতার মাঝেও এক ঝলক রুপালী জ্যেৎস্নায় নির্বিঘ্নে বিচরণ করেন।
রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো
পররাষ্ট্রনীতির বদলে প্রেম, মন্ত্রীর বদলে কবি
মাইক্রোফোনের বদলে বিহ্বল বকুলের ঘ্রাণ? (রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন?)
কখনো কখনো মনে হয় শহীদ কাদরী আমাদের কাছে উপন্যাসের অনেক না বলা কথা নায়কের মতোই রয়ে গেলেন। তাঁর নিত্য পাইপ নিঃসৃত সাদা ধোঁয়া যেন ব্যাকুল আগ্রহে কবি শহীদ কাদরীকেও এক ঐন্দ্রজালিক আবরণে নিত্য আচ্ছন্ন করে রাখতে চায়। কবি শহীদ কাদরী কি সেই মিষ্টিক ধোঁয়া থেকে বের হয়ে কখনই আমাদের সামনে ধরা দিবেন না? কবি তো নিজেই বলেছেন,
বাংলার কাব্যমোদীরা তাঁর কবিতার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে ছিল এতদিন। কবির কবিতা আর জাগবে না। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে। তার আত্মার চির শান্তি কামনা করি।