অজস্র মানুষের শেষ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হলেন খ্যাতিমান কবি শহীদ কাদরী। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। বুধবার বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয় তার মরদেহ। প্রায় দুই ঘণ্টা সেখানে তার মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রিয় কবিকে শেষবারের মতো দেখতে এবং তার কফিনে ফুল দিতে ভক্ত-অনুরাগীদের ঢল নামে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এই শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কবির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান তার সামরিক সচিব জয়নাল আবেদিন ভূঁইয়া ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব মাহবুবুল হক শাকিল।
জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কবির নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে। আরও পড়ুন: শহীদ মিনারে কবিকে শেষ শ্রদ্ধা
লেখক আনিসুল হক বলেন, ‘সাধারণ একজন কবির তুলনায় শহীদ কাদরী কম লিখেছেন। তবে এই কবিতা দিয়েই তিনি মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছিলেন। দূর দেশে থেকেও প্যারিস নয়, স্প্যানিশ নয় তিনি কেবল বাংলাদেশের আধুনিকতা নিয়ে ভাবতেন। শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী তাদের কাছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ ঋণী।’
প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ব্যক্তি ও কবি দুই স্থানেই কবি শহীদ কাদরী ছিলেন আমার প্রিয়। হাসপাতালে যখন দেখা করতে গেলাম শহীদ কাদরী ডাক্তারদের নিষেধ উপেক্ষা করে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ফ্লোরিডায় কত মানুষ মারা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের একটি মানুষ মারা গেলে আমার হৃদয় পুড়ে।’
কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসা বিশিষ্ট সুলতানা কামাল বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতা, মানুষে মানুষে প্রেম এসবই ছিল তার কবিতার মূল উপাদান। তার অভাব পূরণ হওয়ার মতো নয়।’
কবির শেষ শ্রদ্ধার অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালিয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য মীজানুর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, কবি আব্দুস সামাদ, সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের মহাসচিব একেএম শফিউল্লাহ, কবি সুফিয়া কামাল প্রমুখ।
এছাড়াও ছায়ানট, উদীচী, পথ নাটক পরিষদ, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, আওয়ামী সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ শিশু সংগঠন ঐক্যজোটসহ বিভিন্ন সংগঠন।
এর আগে সকালে এমিরেটস এয়ারলাইনের একটি ফ্লাইটে কবির মরদেহ নিউ ইয়র্কের থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে।
নিউ ইয়র্কের নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রবিবার সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবি। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি স্ত্রী নীরা কাদরী, এক ছেলেসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব রেখে যান।
শহীদ কাদরী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছিলেন। গত শনিবার স্থানীয় সময় রাত তিনটার দিকে কবিকে নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কবি শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতায় জন্ম নেন। বাংলা কবিতায় এক অসাধারণ প্রতিভাশীল কবি ও লেখক তিনি। তিনি ১৯৪৭ সাল পরবর্তীকালের বাংলা সংস্কৃতির বিখ্যাত কবিদের একজন, যিনি নাগরিক-জীবন-সম্পর্কিত শব্দ চয়ন করে নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করে বাংলা কবিতায় সজীব বাতাস বইয়ে দিয়েছেন। তিনি আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক যন্ত্রণা ও ক্লান্তির অভিজ্ঞতাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন। ভাষা, ভঙ্গি ও বক্তব্যের তীক্ষ্ণ শাণিত রূপ তাঁর কবিতাকে বৈশিষ্ট্য দান করেছে। শহর এবং তার সভ্যতার বিকারকে শহীদ কাদরী ব্যবহার করেছেন তাঁর কাব্যে। তাঁর কবিতায় অনুভূতির গভীরতা, চিন্তার সূক্ষ্মতা ও রূপগত পরিচর্যার পরিচয় সুস্পষ্ট।
শহীদ কাদরী কলকাতায় জন্ম নিলেও ১০ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫৩ সালে এগার বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার বের হয় ১৯৬৭ সালে, তখন তাঁর বয়স ২৫ বছর। স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সালে তিনি প্রবাসী জীবন বেছে নেন। প্রথমে জার্মানির বার্লিন, পরে লন্ডন হয়ে নিউইয়র্কে বসবাস করছিলেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে- উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই, আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯)।
কবিতায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক (২০১১) পেয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে একুশের পদক তিনি নিজে গ্রহণ করতে পারেননি। তার পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন তার বন্ধু মফিদুল হক। তবে ওই বছরের ৬ মার্চ নিউইয়র্কে কবির হাতে সরকারের পক্ষ থেকে একুশে পদক তুলে দেয়া হয়।