কবি শহীদ কাদরীর মৃতদেহ আজ (৩১ আগস্ট) ঢাকায় শহীদ মিনারে আনা হলো। আমার দুই ছেলে পলাশ ও মেহেদি আমার হয়ে পুষ্পার্ঘ্য রেখে দিলেন। কী বলব তাঁদের। কাকে কী বলব। পলাশ আমায় ফোন করলেন ঢাকা থেকে। জানালেন যে তাঁরা আমার হয়েও ফুল দিচ্ছেন। এই পুষ্পার্ঘ্য তাঁরা কলকাতার হয়েও দিলেন।
শহীদরা কলকাতারই মানুষ। তাঁদের বাড়িতে কিন্তু উর্দুর চলই বেশি ছিল। বলেছিলেন আমায় শহীদ। দাঙ্গার সময়ে স্থানীয় হিন্দুরা তাঁদের বাড়িতে গিয়ে জানান যে তাঁরা কাদরী পরিবারকে রক্ষা করবেন, কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার দরকার নেই। যতদূর মনে আছে শহীদ আমায় বলেছিলেন তাঁর আব্বা তখন প্রয়াত। আম্মা ছিলেন আর ছিলেন এক বড় ভাই। কিছুদিন তাঁরা তাঁদের পার্ক সার্কাসের বাসাতেই ছিলেন। কিন্তু দাঙ্গা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ-অসাধ্য আকার নেওয়ায় স্থানীয় হিন্দুদেরই কেউ কেউ কাদরী
পরিবারকে এসে জানান যে প্রতিপক্ষ এমনই হয়ে উঠেছে যে এবারে তাঁদের চলে যাওয়াই ভাল। শহীদরা কলকাতা ও ভারত ত্যাগ করেন। কিন্তু কলকাতার জন্য শহীদ কেঁদেই গেলেন। মনে আছে, ১৯৭৭ সালে তিনি জার্মানির কোলন শহরে গেলেন ছেলে লোবিদ (আদনান)-কে নিয়ে। একদিন লোবিদকে নিয়ে শহীদ আর আমি বেড়াতে বেরিয়েছি। চলেছি এক আইসক্রিমের দোকানের সামনে দিয়ে। লোবিদ বায়না ধরল আইসক্রিম খাবে। আমি ওকে নিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছি লোবিদের পছন্দসই আইসক্রিম কিনব বলে, শহীদ বেশ জোর গলায় বলে উঠলেন, ‘‘বেটা, আরে আইসক্রিম তুই এখানে কি খাবি? আইসক্রিম খাওয়াব আমি তোকে কলকাতায় গিয়ে। দুনিয়ার সেরা আইসক্রিম কলকাতাতেই পাওয়া যায়।’’
আমার দুই ছেলে পলাশ আর মেহেদি আজ (৩১ আগস্ট)সেই ‘‘সেরা আইসক্রিমের শহর’’ কলকাতার এক মানুষের হয়ে ফুলের অর্ঘ্য দিয়ে এলেন শহীদ কাদরীকে অভিবাদন জানিয়ে।
সারা বাংলাদেশ যখন পৃথিবীর এক সেরা আধুনিক কবিকে শেষ বিদায় জানাচ্ছে বাংলাদেশের এক টেলিভিশন চ্যানেল তখন আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে ফোনে। ঢাকার স্টুডিয়োয় আমার প্রাক্তন সহকর্মী, কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন। কতদিন পর আসাদের সঙ্গে দুটি কথা হলো। কিন্তু উপলক্ষ্য? আমাদের এক বন্ধু চলে গেলেন। আসাদকে বলছিলাম - আমাকেও নিয়ে গেল না কেন? আসাদ প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন বোধহয়। আসাদ সকলকে জানালেন- জীবনের শেষের বছরগুলো শহীদ রোগগ্রস্ত ছিলেন, শারীরিক কষ্ট ছিল। কিন্তু তাঁর স্ত্রী নীরা কাদরী তাঁর সেবা শুশ্রুষা করে গিয়েছেন প্রাণপণে, তাঁকে সঙ্গ দিয়ে গিয়েছেন।
কবি আসাদ চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘শহীদ, আমাদের সকলের শহীদ শরীরে কঠোর ব্যাধি নিয়েও মনের দিক দিয়ে তৃপ্ত, সুখী ছিলেন।’’
মনে আছে, ১৯৭৭ সালে কোলনে (আমার বয়স তখন ২৮, শহীদের ৩৫) আমার বাসার শোবার ঘরে বিছানায় তাঁর বিখ্যাত আলসেমি করতে করতে আর সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে শহীদ কাদরী বলছিলেন একদিন- ‘‘সুমন, সুমন (প্রায়ই আমায় কিছু বলার আগে বার দুই-তিন আমার নামটা বলতেন তিনি), আদর্শ বিবাহ কেমন হওয়া উচিত বলুন তো? (সিগারেটে বিপুল টান ও ধোঁয়া বের করা) - এই যে, আমি। আমি বড়জোর বাজার করে আনব। আর কিছু পারব না। আমি বিছানায় গড়াব এইভাবে আর বড় বড় কথা বলব। বড়জোর। আমার স্ত্রী আমায় বকুনি দেবেন। বলবেন - এই অলস লোকটাকে নিয়ে কী করা যায়। আমাদের ঘরে রান্নার গন্ধ বেরোবে, সুমন, সুমন। আমার বউ রাঁধছেন। ভাবুন। আপনাকেই কত কথা শুনিয়ে দেবেন তিনি আমার সম্পর্কে। বলবেন- বন্ধু বানানোর আর লোক পেলেন না ভাই। বকুনি বকুনি বকুনি...কিন্তু তারই ফাঁকে তিনি মুচোকি মুচোকি হাসবেন। বকুনির ফাঁকে ফাঁকে মুচোকি মুচোকি হাসি..."
মুচকি হাসিকে মুচোকি বানিয়ে ছেড়েছিলেন শহীদ।
আজ ফোনে কবি আসাদ চৌধুরীর (তিনি ঢাকার এক টেলিভিশন স্টুডিয়োতে ছিলেন) কথা শুনে মনে হলো শেষ ক'বছরে অন্তত শহীদ কাদরী তাঁর ইপ্সিত ‘‘মুচোকি মুচোকি হাসি’’ দেখতেন মাঝেমাঝেই, হয়তো রোজই, থেকে থেকেই।
খালি গলায় ফোনে গাইছিলাম আমি- ‘‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’’। বাংলাদেশের একটি চ্যানেল তা প্রচার করছিলো। ‘হায় হায়’ করে সে গান শুনছিলেন আমার আর এক বন্ধু, কবি আসাদ চৌধুরী।
আর বেশি দিন বাকি নেই, বন্ধু। দেখা হবেই আবার। হতেই হবে।
আপনাকে অভিবাদন, শহীদ কাদরী।
পলাশ, মেহেদি - তোমাদের দুজনকেও অভিবাদন।
অভিবাদন, বাংলাদেশ।
- শান্তি –
বিকাল তিনটা ৪৯ মিনিট, ৩১ আগস্ট, ২০১৬।
কবীর সুমন: সুরকার, গায়ক, লেখক ও সমাজকর্মী। প্রয়াত কবি শহীদ কাদরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শহীদ কাদরীর কবিতা অবলম্বনে তার গান ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।