ইংরেজি সাহিত্যে উইলিয়াম শেকসপিয়রের সাহিত্যকর্ম নিয়ে যতটা আলোচনা-সমালোচনা বা বিতর্ক হয়েছে, তা বোধ হয় অন্য কারও সাহিত্য নিয়ে হয়নি। তাঁর কড়া সমালোচকরা বলে থাকেন তিনি মৌলিক নাট্যকার নন। তাঁর সব নাটকের ঘটনা তিনি ধার করেছেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, প্রচলিত লোকো-উপাদান কিংবা পুরাণ থেকে। কেউ বলেন কেউ শেকসপিয়র কিছুই লেখেননি, সমসাময়িক নাট্যকারদের লেখা চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। এ রকম তথ্যের অবশ্য শক্ত ভিত্তি খুব একটা পাওয়া যায় না। সে যেভাবেই হোক না কেন শেকসপিয়র নামের ব্যক্তিটির কাব্যপ্রতিভা নিয়ে এখনো কোনো বিতর্ক হয়নি। প্রায় প্রতিটি নাটকের সংলাপ নির্মাণে তাঁর কবি-প্রতিভার যে স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন, তা সব ধরনের সমালোচনার বাইরে। কেউ কেউ আবার মনে করেন নাটক না লিখে শুধু ১৫৪টি সনেট লিখে গেলেও এই মহান শিল্পী বিশ্বসাহিত্যাকাশে চিরদিনের মতো বিশ্বসেরা কবি হিসেবেই সমোজ্জ্বল থাকতেন।
নাট্যকার হিসেবে সমসাময়িকরা তাঁকে সেভাবে মূল্যায়ন করেননি সত্য; কিন্তু তারপরও কবি পরিচিতির আগে তিনি নাট্যকার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেন। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করতে হয়, এস টি কোলরিজের আগে কেউ তাকে কবি হিসেবে মূল্যায়ন করেননি। শেকসপিয়র অ্যান্ড হিজ ক্রিটিকস গ্রন্থে এফ ই হ্যালিডে বলেন :
It is remarkable that, apart from contemporaries and near-contemporaries-like Ben Johnson and Milton, no critic before Coleridge seems to have been aware that Shakespeare was before all else a poet...Shakespeare was a poet before he was a dramatist...
শেকসপিয়রের সনেটের মূল থিমগুলোর মধ্যে ইম্মর্টালিটি একটি। নাটকের মূল বিষয়বস্তু নির্ধারণে আলোচকদের যতটা গলদঘর্ম হতে হয় তাঁর সনেটের বেলায় সে রকম না হলেও তা যে বিতর্কের বাইরে নয়, তা অবশ্য নির্দ্বিধায় বলা যায়। বিতর্ক মূলত সনেটের থিম নিয়ে। বহুদিন সাহিত্য সমালোচকদের মধ্যে সেই বিতর্ক চলমান ছিল এবং কমবেশি এখনো আছে। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে, বিশেষ করে নাটকে, যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা সব সময়ের সব মানুষের ভাবনা এবং গবেষণার বিষয়। অন্যভাবে বলা যায়, শেকসপিয়র তাঁর সাহিত্যকর্ম দিয়ে বৈশ্বিক হয়েছেন বিশ্ব মানুষের সাধারণ বিষয়গুলোকে যতেœ তুলে আনার জন্য। সমসাময়িকতা, রাজনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির উৎকট উপস্থাপন সযতেœ এড়িয়ে গিয়ে মানবিক সম্পর্কের টানাপড়েন, জাগতিক অথবা মানসিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি অতি স্বচ্ছন্দে তুলে এনেছেন তাঁর নাটকে। সনেটগুলোও প্রতীকীভাবে তৎকালীন সমাজ বা রাষ্ট্রকে নানা মাত্রায় ও আঙ্গিকে স্পর্শ করে যায়।
কারও কারও মতে তাঁর সনেটে যে বিষয়টি প্রধান বিষয় বলে বিবেচ্য, তা হলো অমরতা। অমরত্বের প্রতি তাঁর প্রবল আকাক্সক্ষা বা দুর্বলতা সর্ব যুগে প্রতিটি মানুষেরই একান্ত আরাধ্য বিষয়। প্রথম ১২৬টি সনেটে অমরতার থিমটি প্রতিফলিত। মনুষ্যজীবনের অনিবার্য পরিণতি মৃত্যু। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার কোনো পথ কি মানুষ খুঁজে পেয়েছে? আবার অমরতার বহুমাত্রিকতাও আছে। দেহত্যাগ কি আসলে মৃত্যু? হয়ত এ কারণে পথ খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য কাজ নয়। তবে মানুষ প্রতিনিয়ত সেই উত্তরের প্রতিক্ষায় এবং উত্তর আদৌ পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সবটুকু সন্দেহ বিরাজমান। তবু শেকসপিয়র খুঁজে ফিরেছেন সেই পথ। তার খুঁজে ফেরার ধরনটাই যা একটু ভিন্ন। নশ্বর দেহ টিকিয়ে রেখে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অসম চিন্তা তিনি করেননি। মানুষ বেঁচে থাকতে পারে তার সৃষ্টিতেÑহোক সে শিল্পের সৃষ্টি কিংবা সন্তান উৎপাদন। অতএব সুন্দর, সুশ্রী ও সুদর্শন যুবককে তিনি হাজির করেন নিজস্ব আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের হাতিয়ারস্বরূপ। সৌন্দর্য পরিমাপযোগ্য না হলেও তার বিনাশ ধর্মের বাইরে নয়। সুতরাং সুদর্শন যুবার অপার সৌন্দর্য পরবর্তী প্রজন্মে প্রবহমান রেখে বেঁচে থাকতে হবে তাকে, বেঁচে থাকতে হবে সন্তানের হাড় ও পাঁজরে। অমরত্বের এ রকম সহজ হিসাবনিকাশে বিতর্কের কোনো অবকাশ থাকার কথা নয়। বিতর্ক অন্য খানে। নিজের কথা বলতে গিয়ে কবি যে যুবককে সামনে নিয়ে এসেছেন, যার নারীসুলভ রূপ লাবণ্যের বর্ণনায় কবির কলম প্রগলভ, বিতর্কটি সেই জায়গায়। সন্তান জন্মদানের মধ্য দিয়ে টিকে থাকার সরল যুক্তি নিয়ে পাঠক মোটেও চিন্তিত নন। বিতর্কের নানা রকম কূটচালের আগে বোধ হয় দেখা যেতে পারে এ রকম সহজ একটি ফর্মুলা আসলে কতটা সহজ। এর পথে কী সব অন্তরায় মানবজীবনের অমরত্ব লাভের পথে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম ১২৬টি সনেটে সময়কেই সে পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা হয়েছে। সময় যৌবন আর সৌন্দর্যের প্রধান শত্রু। এলিজাবেথান এজের সাহিত্যভাবনার অন্যতম বিষয় ছিল এটি। কবি-সাহিত্যিকরা অত্যন্ত মর্মবেদনার সঙ্গে অবলোকন করেছেন যে সময় তার ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব দ্বারা সৌন্দর্য আর যৌবনকে বিস্মৃতির অতলে নিয়ে যাচ্ছে। কিভাবে বাঁচা যায় কিংবা কিভাবে পরাজিত করা যায় এই ‘ব্ল¬াডি টাইরান্ট’কে? তিনটি উত্তর শেকসপিয়র তাঁর সনেটে দিয়েছেন। আর এজন্য অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী একজন যুবককে আনা হয়েছে। তাকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে সময়কে পরাজিত করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে বিয়ে করে সন্তান জন্মদান করতে হবে।
প্রথম সনেটেই এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে তুলে এনেছেন কবি। যুবকের তুলনাহীন সৌন্দর্যের প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, তার এই সৌন্দর্য রক্ষা করার দায়িত্ব তারই। কিন্তু যুবক তা না করে অযথা কালক্ষেপণ করছে। তিনি তাকে সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে পৃথিবীকে এর প্রাপ্তিটুকু মিটিয়ে দিতে বলেছেন :
Pity the world, or else this glutton be,
To eat the world’s due, by the grave and thee.
দ্বিতীয় সনেটেও এ রকম মনোভাবই ব্যক্ত হয়েছে। সময় কাউকে রেহাই দেয় না, এই অনিবার্যতার কথা তিনি চমৎকার তুলনার মাধ্যমে জানিয়ে দেন :
When forty winters shall besiege thy brow,
And dig deep trenches in thy beauty’s field,
Thy youth’s proud livery, so gazed on now,
Will be a tattered weed (garment) of small worth.
কবি মনে করেন, যুবক তার জন্মধাত্রীর ছায়া বহন করে তার নিজের মধ্যে এবং তার কর্তব্য হলো পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তা সম্প্রসারিত করা। অন্যথায় তাকে সেই পরিণতি ভোগ করতে হবে, "Die single and thine image dies with thee". নিজ অস্তিত্বের প্রতি এই আকুলতা পরবর্র্তী সনেটগুলোতেও বহমান। সুদর্শন যুবক যা পেয়েছে প্রকৃতির কাছ থেকে তা রক্ষা করার দায়ও তার। সময় এখানে প্রধান প্রতিকূলতা। প্রবহমান সময় যা সৃষ্টি করে তা সে ধ্বংসও করে। সুতরাং ফুলের সৌন্দর্য ধরে রাখার উপায় হলো তার থেকে নির্যাস আহরণ করে তা সংরক্ষণ করা :
But flowers distill’d, though they with winter meet,
Leese but their show: their substance still lives sweet.
ফুল ঝরে যাবে একদিন, তার সুবাসও থাকবে না। ফুলের সঙ্গে মানুষের জীবনের সাধারণ এ তুলনা আমাদের জীবনের স্বল্পত্ব যেমন মনে করিয়ে দেয় তেমনি প্রজন্মান্তরে বেঁচে থাকার স্বাভাবিক আর্তিও প্রকাশ করে। অমরত্বের প্রতি স্বাভাবিক এই অনুভূতির প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন আরও একটি মাধ্যমে। তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছেন কবিতার মধ্যেও। ১৮ নম্বর সনেটে অমরত্বের নতুন বিষয়ের অবতারণা করেন কবি। বেঁচে থাকার আগের প্রয়াসকে স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে কবিতার মাধ্যমে অমরত্ব সন্ধানের এলিজাবেথান সময়ে প্রচলিত এই উপায় অবলম্বন করেছেন কবি। ১৮ থেকে ৩২ নম্বর সনেট তাঁর এই নতুন অবলম্বনের কথা বলে। এই সনেটগুচ্ছে কবি আর যুবকের কাছে তার যোগ্য উত্তরসূরির প্রত্যাশা করেন না। সনেটগুলোয় সুদর্শন যুবককে উপস্থাপনের ঢংটা একটু ভিন্ন রকম। প্রকারান্তরে এই সনেটগুলোয় যুবককে কবিতায় তুলে আনা হয়েছে এমন আঙ্গিকে, যা উপলব্ধি করতে আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না; যে তিনি আসলে কবিতার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য যুবকের কাছে একপ্রকার ঋণ স্বীকার করছেন। অথবা কবিতায় তাকে বাঁচিয়ে রাখার আকুতির মাধ্যমে নিজের ইচ্ছেটাকেই রূপায়িত করছেন। এই সনেটের কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে :
But thy eternal summer shall not fade
Nor lose possession of that fair thou ow’st;
Nor shall Death brag thou wand’rest in his shade,
When in eternal lines to time thou grow’st.
এ থেকে একটি বিষয় কবিতার পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয় যে, কবিতায় যুবককে ঠাঁই দেওয়ার ফলে মৃত্যু তাঁকে আর কাছে টেনে নিতে পারবে না। অমরতার এই আর্তি মূলত কবিরই। কবিই এখানে তার বন্ধুর ভেতরে লীন হয়ে যান। তাঁর এই উদ্দেশ্য বোধ হয় এক ধরনের সফলতা লাভ করে এই সিরিজের শেষ সনেটে অর্থাৎ ৩২ নম্বর সনেটে। এরপরের সনেটগুচ্ছে কবি ও তাঁর যুবক বন্ধুর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গ এসেছে। ৩৪ নম্বর সনেটে যুবক বন্ধুর প্রতি কবির অভিমান আমাদের ভাবিত করে এজন্য যে কবিকে ছেড়ে যাওয়ার স্বাভাবিক বিষয়টি এখানে আর স্বাভাবিক থাকে না। তার পরাজয় অথবা ক্ষতি বন্ধুর প্রাপ্তির মাধ্যমে পূর্ণ হয়; এ কথাও কবি বলেন পরবর্তী সনেটগুলোয় :
As a decrepit father takes delight
To see his active child do deeds of youth,
So I, made lame by Fortune’s dearest spite,
Take all my comfort of thy worth and truth;
কবি ও যুবকের মাঝখানের জটিল সম্পর্ক অনুসন্ধানের আগে অথবা এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে তাঁর এ বন্ধুটির পরিচয় অনুসন্ধান জরুরি। এ নিয়েও বহু গবেষণা হয়েছে এবং গবেষকরা একটি সিদ্ধান্তে আসতেও পেরেছেন। ১২৬টি সনেটে উল্লি¬খিত এই সুদর্শন যুবক যুগপৎ সাউদাম্পটন ও পেমব্রুকের আর্ল। এলিজাবেথান এজের প্রথা অনুযায়ী কবিতা বা অন্যান্য শিল্পকর্মে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন অনেকেই। আভিজাত্য প্রকাশের এ-ও ছিল এক রীতি। যার পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো তাকে সাহিত্য বা শিল্পকর্মে উপস্থাপনের মাধ্যমে অমর করে রাখার দাবিও থাকতে পারে। শেকসপিয়র তার সনেটে সে রকম একটি দাবি মেনেছেন অথবা রেওয়াজ পালন করেছেন বলা যায়। তবে পৃষ্ঠপোষককে কবিতায় উপস্থাপনের ধরন থেকে ব্যক্তিগত জীবনে না হোক তৎকালীন পাশ্চাত্য সভ্যতায় লুকিয়ে থাকা হাজার বছরের পুরনো সমকাম ভাবনার বিষয়টিকে যে তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন, তা বোধহয় জোর দিয়ে বলা যায়। সমকামীতার বিষয়ে তাঁর সমকালীন কবি-সাহিত্যিক বা সমালোচকরা কোনো আলোচনা করেননি। এর দুটো প্রধান কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সমকালে তাঁর কোনো সাহিত্যকর্ম সেভাবে আলোচনায় আসেনি। অন্য কারণটি হতে পারে সে সময় এ রকম একটি বিষয় সাহিত্যে আদৌ আসতে পারে, এ রকমটি হয়ত ধারণাতীত ছিল!
সে যাই হোক, শেকসপিয়রের সাহিত্যে সেক্সোয়ালিটি নানাভাবে বর্তমান। মানবজীবনে স্বাভাবিক যৌনতার ভূমিকা নির্ধারণ করতে শেকসপিয়র তাঁর ভেনাস অ্যান্ড এডোনিস গ্রন্থে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন ভিন্ন একটি বিষয়ের সঙ্গে, যা তখনকার সমাজে কিছুটা হলেও নতুন এবং ভিন্ন ধারার। আমরা এখানে আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করি যে, নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সহমিলনে ভেনাসের অংশগ্রহণ, যা আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় তৎকালীন সমাজের হাজার বছর পুরনো ধারণার সামনে। নারী ও পুরুষের যৌন মিলনে নারীর অগ্রগামী ভূমিকার পুনর্মূল্যায়নে নাট্যকার বাধ্য করেন আমাদের। এলিজাবেথান সময়ের মঞ্চের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেও নাট্যকারকে নাটক লিখতে হতো। তখন সরাসরি নারী চরিত্রে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অকল্পনীয়। নারী চরিত্রে পুরুষদের দিয়ে অভিনয় করানোর প্রথাটি কাজে লাগিয়ে শেকসপিয়র তাঁর পরীক্ষণ চালিয়ে গেছেন। পুরুষদের নারী চরিত্রে অভিনয় করতে হতো বিধায় বিশেষ করে তাঁর কমেডিগুলোয় নারীদের পুরুষ করে দিয়ে তার সুযোগ কাজে লাগানো হতো। পুরুষ হয়ে যাওয়া ভাইওলার প্রতি অলিভিয়ার প্রেম নিবেদন এবং ভাইওলা কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যান, ওরসিনোর বালক-ভাইওলার প্রতি আকর্ষণ সব কিছুই প্রথাগত প্রেমের সম্পর্কের বাইরে আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। শুধু টুুয়েল্ফথ নাইট-এ নয়, মার্চেন্ট অব ভেনিস-এ এন্টোনিও ও বেসানিওর সম্পর্কও আমাদের ভাবিত করে। এন্টোনিও ও বেসানিওর সম্পর্ক পোরশিয়ার সঙ্গে বেসানিওর সম্পর্ককেও হার মানিয়ে দেয়। এভাবে শেকসপিয়র তৎকালের প্রথাগত প্রেমের সম্পর্ক থেকে সরে এসেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে নারী-পুরুষের ভালোবাসার ব্যাপারটি যেমন আছে তেমনি আছে নারীতে-নারীতে বা পুরুষে-পুরুষে সম্পর্কও। কদাচিৎ নার্সিসাস জটিলতা বা স্বপ্রেম। আর এসব কিছুর মধ্যেই নারী পুরুষের জটিল সম্পর্কের মধ্যে কোনটি নিখাদ মানবিক সম্পর্ক আর কোনটি সমাজ আর ধর্র্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পাপাচার বা নিষিদ্ধ সে নিয়ে এখনো বিতর্ক বহাল। আর এসব কিছুই সনেটের মধ্যেও ঠিক এ রকম কিছু বিতর্কের জন্য পাঠকদের তৈরি করে।
সনেটের দ্বিতীয় বিভাগে ভালোবাসা নির্দ্বিধায় যৌনলিপ্সায় রূপান্তরিত হয়। কবি নিজেই স্বীকার করেন তিনি ‘ডার্ক লেডি’র ভালোবাসার ক্রীড়নক। ‘ভালোবাসা যৌনলিপ্সায় পরিণত’ এ বিষয়টি পাঠকদের সামনে নিয়ে আসা হয় প্রথমবারের মতো ১২৯ নম্বর সনেটে :
Th’ expense of spirit in a waste of shame
Is lust in action; and till action lust
Is perjur’d,
মিথ্যাবাদী এই কৃষ্ণ রমণীর সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতার বিষয়ে শব্দ নিয়ে রসালো মজাও তিনি করেন :
Therefore I lie with her, and she with me
And in our faults by lies we flattered be.
তবে কবি স্বীকার করেন, ডার্ক লেডির সঙ্গে তার এই সম্পর্ক পাপাচারতুল্য। কৃষ্ণ রমণী যে তাঁর জীবনের নষ্ট অনুপ্রেরণা তা-ও স্বীকৃত হয় তাঁর মুখে। এ রকম যৌনাকাক্সক্ষাকে তিনি তুলনা করেন মৃত্যুর সঙ্গে। শেকসপিয়রের অধিকাংশ লেখায় যৌনতা, যৌন সম্পর্ক, প্রেম কিংবা শারীরিক অনুভূতির ব্যাপারগুলো সহনীয়ভাবেই পাঠকের কাছে পরিষ্কার। ব্যাপারটি শুধু ঘোলাটে থেকে যায় সনেটের কথক আর সুদর্শন যুবকের মাঝে। তার সৌন্দর্য ও শারীরিক বর্ণনায় কবি এমন সব শব্দ ব্যবহার করেন, যা অনায়াসে কেউ তাঁর প্রেয়সীর শরীর ও সৌন্দর্য বয়ানে ব্যবহার করতে পারেন। যুবকের শারীরিক সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে কথক বলেন তার ÔLov’s fair browÕ অথবা তাকে ডাকেন ÔLord of loveÕ বলে। সে গ্রীষ্মের দিনের চেয়েও সুন্দর। তবে সবচেয়ে কার্যকর উপমাটি বোধ হয় কবি ব্যবহার করেছেন ২০ নম্বর সনেটে :
A woman’s face with Nature’s own hand painted,
Hast thou, the Master Mistress of my passion;
A woman’s gentle heart,
প্রেমিক তার প্রেমিকার রূপ বর্ণনায় এ রকম আবেগাপ্লুত উপমা ব্যবহার করলে পাঠক নিঃসংকোচে মেনে নিতে পারেন। কিন্তু একজন পুরুষ যদি সুদর্শন এক যুবার রূপ এভাবে বর্ণনা করেন তাতে বিতর্ক হওয়া স্বাভাবিক। নিঃসন্দেহে অপার সৌন্দর্যের অধিকারী যুবক উঁচুু বংশীয় এবং শুধু শারীরিকভাবেই সুন্দর নয়, মনের দিক থেকেও সে সুন্দর। একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক সতেরো/আঠারো বছর বয়সের একজন যুবার? যুবক কবির ‘বিশ্বসেরা গহনা’ বা ‘গোলাপ ফুল’ এবং তাকে তিনি ডাকেন ‘সুইট বয়’ বলে। যুবকের প্রশংসা করতে গিয়ে একসময় সচেতনভাবে তাকে মনের মাধুরীতে সাজিয়ে তোলেন কবি। উত্তর আধুনিক(?) যুগে দাঁড়িয়ে সনেটে বর্ণিত অপূর্ব সুদর্শন এক যুবকের মাধ্যমে অমর হয়ে থাকার চিরকালীন মানব-বাসনায় যুবক পুরুষের প্রতি অপেক্ষাকৃত বয়স্ক পুরুষের আকর্ষণবোধ আবিষ্কার করে তাতে রং লাগানোটা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। তবে সময় পরিক্রমণের সাথে সাথে মানুষের চিন্তাজগতের বিস্তার এবং শরীর ও মন বিষয়ে গবেষণায় অভূতপূর্ব অগ্রগমনের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকে বিনা বিতর্কে ছুড়ে ফেলাও বোধ হয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সমকাম কোনোভাবেই কোনো আধুনিক বা উত্তর আধুনিক বিষয় নয়, এটি অন্য সব মানবিক সম্পর্ক ও শারীরবৃত্তীয় সম্পর্কেরই একটি অংশ। সুতরাং চার-পাঁচশ বছর আগের শিল্প বা সাহিত্যকর্মে তা আসতে পারবে না, এমন তো নয়। তবে ধর্র্মীয় ও সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে এর উপস্থাপনাগত রীতিতে পার্থক্য থাকতে পারে। পিতৃহত্যা এবং মাতৃবিবাহ রাজা ঔদিপাসের নিয়তি হলেও তা কি কোনো না কোনোভাবে মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বা দমিয়ে রাখা আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ নয়? সুতরাং সনেটের কথকের সঙ্গে যুবকের সম্পর্ক অনাকাক্সিক্ষত হলেও তা মোটেও অস্বাভাবাবিক নয়। ২০ নম্বর সনেটটি আবার উল্লে¬খ করা যেতে পারে :
And for a woman wert thou first created;
Till Nature, as she wrought thee, fell a doting,
And by addition me of the defeated
By adding one thing to my purpose nothing.
But since she prick’d thee out for woman’s pleasure,
Mine be thy love, and thy love’s use their treasure.
কেউ যদি মনে করেন এ থেকে কিছুই প্রমাণিত হয় না অর্থাৎ কেউ যদি সমকামিতার বিষয়টি শেকসপিয়রের সনেটে অস্বীকার করেন, তা যতটা না অযৌক্তিক তার চেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য হবে যদি এ বিষয়টিকে স্বীকার করা হয়। অমরত্ব লাভের তীব্র আকাক্সক্ষা মানুষের ভেতরে সদা লালিত। সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া তারই একটি অংশ। সুদর্শন যুবকের তার সন্তানের মধ্যে বেঁচে থাকার তাগিত মূলত কবির নিজস্ব ভাবনারই অংশ। যে যুবককে এ ক্ষেত্রে কবি ব্যবহার করেছেন তার প্রতি অতিমাত্রিক মনোযোগ পাঠককে অমরত্ববিষয়ক জটিলতা থেকে ঠেলে দেয় সমকাম ভাবনার প্রকোষ্ঠে। আর এভাবে, যে যুবককে তিনি অমরতার আস্বাদন করতে বলেন, তার সাথে কবির সমকাম সম্পর্কের আভাস সামনে চলে আসে।