বৃষ্টিভেজা বিকালে কাকভেজা হয়ে নুর মিয়ার আগমন। নুর মিয়া হাসান সাহেবের অন্যতম সাগরেদ। ছোটবেলার বন্ধু, মাঝখানে ব্যাবসার কাজে জড়িয়ে জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করার সময় নুর মিয়াদের খোঁজ মেলেনি। শেষ বেলায় আবার ছোটবেলার টোকাই হাসান হাসান সাহেবে পরিণত হওয়ায় তাদের ঘনঘটা বেড়েছে। নুর মিয়া অবশ্য ভালো মানুষ, সব সময় ভালো কথাই বলে। নেতা হবার আগে নুর মিয়াই তাকে নেতা হবার কথা বলেছিল। ‘ টাকায় কি সন্মান হয় দোস্ত?’ ‘ তাহলে!’ নুর মিয়ার কথায় কিছুটা অবাক হয় হাসান সাহেব।‘ নেতা হতে হবে। নেতা হতে পারলে সবাই খালি সালাম দেবে। তোমার উত্তর ও দেওন লাগবো না, শুধু হাত উঁচু করবা তাই দেখবা তোমার হাত ব্যাথা হয়ে গেছে।’
নুর মিয়ার কথাটা মনে ধরে হাসানের। সন্মান কে না চায়! মিনমিন করে বলে, ‘আমি যে লেখাপড়া জানি না!’
‘ধুর ব্যাটা, নেতা হতে লেখাপড়া লাগে না। টাকা থাকলেই হয়।’
সেই থেকে হাসান সাহেব নতুন প্রচেষ্টায় নেতা হাসান হয়েছেন। ‘কিরে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে…..’ কথা শেষ হয় না তার আগেই নুর মিয়া বলতে শুরু করে, ‘ নেতা হইছো এখনো যদি সব আমার বুঝায়া দিতে হয় তয় কি চলে!’
‘কী হইছে সেইটা বলো?’
‘দেশ ডুবে গেল, বড় বড় সব নেতারা বর্ন্যাতদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছে আর তুমি বাড়ি বসে ঘুমাও।’
‘ঠিক আছে আমিও বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াবো।’
‘শোনো দোস্ত সবার মতো তোমারও একখান বড় ব্যানার বানাতে হবে, তারপর ব্যানারসহ বন্যার্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে সবাইকে জানতে হবে, নেতাও পাশে ছিল।’
যেই কথা সেই কাজ। নেতা হতে গেলে কিছু কষ্ট তো করতেই হবে। কষ্ট ছাড়া দুনিয়াতে কি বা হয়!
দু’দিন পর বন্যা কবলিত এলাকায় হাজির হয় নেতা হাসান ও তার সহযোগী নুর মিয়া। চারিদিক শুধু পানি আর পানি। একটা নৌকা ভাড়া করে শুরু হয় তাদের পথচলা। নুর মিয়া শুধু নেতার ছবি তোলে। পানি আর নেতা মিলেমিশে একাকার ছবিতে ছবিতে। বেশ সময় চলার পর একটা টিনের চাল দেখা যায়। নেতার মুখ দুটো উজ্জ্বল হয়। বন্যার্ত পাওয়া গেছে। পাশে দাঁড়াতে হবে। নৌকা টিনের চালে ভেড়ায়। পাঁচ সদস্যের একটা অসহায় পরিবার টিনের চালে। ক’দিন ধরে আছে কে জানে!
সবাই হাসান সাহেবকে দেখে। সাদা ধবধবে জামা, প্যান্ট পরিহিত নেতা। হাসান সাহেব হাঁক দেন, ‘আসেন সবাই পানির ভেতর নেমে দাঁড়াই।’
চালের উপর বসা সবচেয়ে তরুণ যুবকটা কথা বলে, ‘ কী আনছেন ভাই?’
নব্য নেতা হাসান সাহেব অবাক হন, বলে কী! এতদূর থেকে কষ্ট করে ছুটে এসেছে। হাবুডুবু খেয়ে বন্যার্তদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বন্যার্ত বলে কী!
নেতাদের রাগতে হয় না। জুতা দিয়ে বাড়ি মারলেও ফিক করে হেসে দিতে পারলেই না হয় নেতা। এসব কথা জানা থাকলেও নিজেকে সামলাতে পারেন না। মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, ‘এ জন্যই তো বন্যায় ডুবে মরো।’
‘ডুবে যখন মরি শালা তোরে আগে মাইরা লই।’
কথা শেষ করেই যুবকটা হাসান সাহেবকে জাপটে ধরে পানির ভেতর আছড়ে পড়ে। একের পর এক চুবানি দেয়। ঢক ঢক করে পানি গেলে হাসান সাহেব। এক একবার মাথা উঁচু হয় আর সেই সাথে হাসফাঁস করে দম নিয়ে চিৎকার করেন।
‘মারিস না, মারিস না।’
নুর মিয়া নির্বিকার, স্তব্ধ। নেতার দুরাবস্থা তাকে ছুঁয়ে যায় তবু নির্বিকার। শেষমেষ বাবার কথায় নেতাকে ছাড়ে যুবক। লাল চোখে বলে, ‘ শালা মশকারা করতে আইছো।’
অনেক কষ্টে আধমরা নেতা নৌকায় ওঠে। যাবার আগে বিড়বিড় করে বলে, যে যাই বলুক যদি আর কোনোদিন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে আসি তো আমি বাপের জন্ম না।’