প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল, ২০১৬ ১১:৪৫:২১আপডেট : ১৮ এপ্রিল, ২০১৬ ১৪:৫০:২৮
টুকরো, টুকরো স্মৃতি
আরিফুর রহমান
২০০৫ সালের শেষের দিকের কথা। তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের পা ছুঁয়ে সালাম করছেন এম ইলিয়াস আলী-এমন একটি ছবি ছাপা হলো প্রথম আলোর প্রথম পাতায়। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে ছবিটির গুরুত্ব ছিল অনেকখানি। কারণ বর্ষীয়ান নেতা সাইফুর রহমানকে রীতিমতো টেক্কাই দিচ্ছিলেন এম ইলিয়াস আলী। কিন্তু যার সাথে টেক্কা, অবনত মস্তকে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করলে অনুগামীদের কাছে তো অন্য বার্তাই যায়। তাই খানিকটা ক্ষেপেছিলেন ইলিয়াস আলী, প্রথম আলোর ওপর। তাঁর চেয়ে বেশি আমার ওপর। আমি তখন প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার। ছবিটি তোলা হয়েছিল আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে এম সাইফুর রহমানের কক্ষে। জিয়া ইসলাম ছবিটি তোলেন। তবে আয়োজন করে দিয়েছিলাম আমি।
টানা কয়েকদিন প্রবীণ ও নবীন নেতার প্রকাশ্য দ্বৈরথের পর অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়ালো যে অর্থ মন্ত্রী সাইফুর রহমান পদত্যাগই করে বসেন! খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপের পর মান্নান ভুঁইয়াসহ কয়েকজন শীর্ষ বিএনপি নেতার মধ্যস্থতায় ইলিয়াস আলী দুঃখ প্রকাশে মনস্থির করলেন। অনুগামী কয়েকজন সাংসদসহ সাইফুর রহমানের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে হাজির হলেন এক সকালে। আগে থেকেই জানতাম। ফটোসাংবাদিক জিয়া ইসলামসহ আগে থেকেই উপস্থিত হলাম ঘটনাস্থলে। মুন্নী সাহাসহ ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের আরও কয়েকজন সাংবাদিকও যথারীতি ছিলেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশের ঘটনা যখন ঘটবে সেই মুহুর্ত ধারণের সুযোগ গণমাধ্যম পাবে কি? অর্থ মন্ত্রীর এপিএস আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী সাফ জানালেন,কোনো সুযোগ নেই গণমাধ্যমের জন্য। এটি একান্ত বৈঠক। ফটো সাংবাদিক জিয়াকে বললাম, ইলিয়াস আলীরা যখন অর্থ মন্ত্রীর কক্ষে ঢুকবেন তখন ভেতরে অন্য কারো ঢোকার সুযোগ না হলেও আমাকে না করার সুযোগ নেই। তুমি এই সুযোগ নিও। জিয়া এক্সক্লুসিভ ছবি তোলার ওস্তাদ। মিস করলো না সুযোগ। ঠিকই ইলিয়াস আলী সিলেটের আরও তিন সাংসদসহ যখন এম সাইফুর রহমানের সাথে দেখা করতে এলেন তখন আমিও ভেতরে ঢুকে পড়লাম তাদের সাথে। ক্ষিপ্র গতিতে জিয়া ইসলাম। ঢুকে ইলিয়াস আলী এম সাইফুর রহমানের পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। ক্ষমা চাইলেন। জিয়া ক্যামেরাবন্দি করলেন সেই মুহূর্তের। পরদিন সেটি প্রথম আলোর লিড ছবি।
সচিবালয়ে দেখা এম ইলিয়াস আলীর সাথে। চোখ বড় বড় করে তাকালেন আমার দিকে। আমিও কম যাইনা। একই রকম চাহনিতে উত্তর দিলাম। বললেন, কাজটি ভালো করো নাই। কোনটা? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম তাঁর দিকে। উত্তরে ছবির কথা বললেন। বললাম, ভাই আপনি পিতৃতুল্য একজন মানুষকে সালাম করছেন পা ছুঁয়ে এতে খারাপের কি দেখছেন। বরং এর মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে আপনি বড়দের সম্মান করেন। কথাটা মনে ধরলো হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ সাংসদের। বললেন, এভাবে তো ভাবি নাই। কথা তো ঠিক। ইলিয়াস আলী শান্ত হলেন।
সাইফুর রহমান পদত্যাগ করবেন। রাজনীতি ছেড়ে দেবেন। ইলিয়াস আলীর কাছ থেকে অপমান পেয়ে সব কিছু অসহ্য লাগছে তাঁর। অফিস করছেন না। তাঁর কোনো বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছেনা। অফিসের মিটিংয়ে সম্পাদক মতিউর রহমান বললেন, সাইফুর রহমানের ইন্টারভিউ যদি পাওয়া যেতো। আমি বললাম, পাওয়া যাবে মতি ভাই। সম্পাদক বিশ্বাস করতে চান না। বলেন, আরে মিয়া আমারেই এক বছর ধরে টাইম দেয় না। আর তুমি! বললাম, মতি ভাই আপনার বিষয় জানি না। আমি পারবো। আজই পারবো।
মতি ভাই বলেন, দ্যাখো। মনে হয় না। অফিসের মিটিং শেষ করে পরের দিনের সম্ভাব্য লিড নিউজ লেখা শেষ করলাম। সাইফুর রহমান পদত্যাগ করলে ওসমান ফারুকই পরবর্তী অর্থমন্ত্রী। অপরাহ্নে হাজির হলাম অর্থ মন্ত্রীর গুলশানের বাসায়।
সোজা দোতলায়। সাইফুর রহমানের শয়ন কক্ষে। দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে উঠে বসেছেন বারান্দায়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময়ের অর্থ মন্ত্রী রীতিমতো মন খারাপ, যখন সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ তুললাম। তবু নাকোচ করলেন না। বললেন না, কোনো কথা বলবেন না। শুধু বললেন, ইলিয়াস আমায় অপমান করে! ওকে আমি জেল থেকে বের করেছি। রাজনৈতিক জীবন ফিরিয়ে দিয়েছি। এরপর নানা প্রসঙ্গ আসতেই থাকে। এক পর্যায়ে সাক্ষাৎকার শেষ হয়। অর্থ মন্ত্রীকে বলি, আপনি আমাদের সম্পাদক মতিউর রহমানকে সময় দিচ্ছেন না, কথা বলছেন না। সাইফুর রহমান বলেন, ঠিক আছে একদিন কথা বলবো। বললাম, একদিন নয় এখনই কথা বলেন। আমার মুঠোফোন থেকে মতি ভাইকে ফোন করলাম। বললাম ধরেন, কথা বলেন অর্থ মন্ত্রীর সঙ্গে। দু’জনে খানিকক্ষণ কথা বললেন। পুরনো সম্পর্ক। মাঝখানে কিছু একটা হয়েছিল। আবার শুরু হলো। সাইফুর রহমানের বাসা যখন ছাড়লাম তখন মাইগ্রেনের যন্ত্রণায় কাতর আমি। তবু অফিসে গেলাম। রাত পৌনে ১০ টা। পত্রিকা পেস্টিংয়ের কাজ চলছে। পত্রিকার প্রধান শিরোনাম, সাইফুরের বিকল্প ওসমান ফারুক-মোটামুটি এটাই ঠিক হয়েছে। কিন্তু সম্পাদক মতিউর রহমান বললেন, আরিফ সাইফুর রহমানের ইন্টারভিউ লিড স্টোরি হবে।
সম্পাদক বসলেন আমার পাশের চেয়ারে। মাথা ছিড়ে যাচ্ছে মাইগ্রেনের যন্ত্রণায়। তবু হেসে বললাম,আমি লিখে দিচ্ছি মতি ভাই। রেকর্ডার না ছেড়ে টানা মুখস্থ লিখলাম। লিখছি, আর এক প্যারা দু’প্যারা করে কম্পিউটার থেকে টেনে নিচ্ছেন বার্তা সম্পাদক সানাউল্লাহ লাভলু ভাই।
পৌনে ১১ টার দিকে লেখা শেষ করলাম। যুতসই হেডিং ঠিক হলো। লিড স্টোরি হলো, সাইফুর রহমানের সাক্ষাৎকার। এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নেওয়ায় সম্পাদক মতিউর রহমান অনেক খুশি হলেন। নিজের কক্ষে ডাকলেন। একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। হাসতে হাসতে বললাম, মতি ভাই ঘুষ দিচ্ছেন? ২০ হাজার টাকা। টাকাটা বড় কথা নয়। আসলে ওটা ছিল বড় এক অনুপ্রেরণা।