প্রকাশ : ১৪ মে, ২০১৬ ০০:০৮:৩৮আপডেট : ১৪ মে, ২০১৬ ১৭:৩৩:৩১
কেন এই সময়
আরিফুর রহমান
যেকোনো নতুন উদ্যোগের জন্য বর্তমান সময়টা বড্ড অনুপযোগী। হরতাল, অবরোধের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কার্যত স্থবির হওয়ার পথে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন পত্রিকা প্রকাশ করা কি ঠিক হবে? শুভাকাঙ্ক্ষীরা বারবার এই প্রশ্ন করেছেন ও করছেন। এই তালিকায় বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কেউ কেউও আছেন। কী করব? পিছিয়ে যাব? সুসময়ের অপেক্ষা করব? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি। শেষমেশ ঠিক করলাম, যত সমস্যাই হোক শুরু করব। সফল হতে পারি, আসতে পারে ব্যর্থতাও। ব্যর্থতা নাকি সাফল্যের পথ দেখায়। এই দুটো মাথায় রেখেই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সাপ্তাহিক ‘এই সময়’ বাজারে এল এমন সময়ে যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। রাজনৈতিক কলহ-কোন্দলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে চলছে শনির দশা। মুক্তিযুদ্ধের পরে এত সহিংসতা আর বাংলাদেশে কখনো হয়নি এমন কথাও বলছেন অনেকে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলদের বক্তব্য, যেকোনো বিনিয়োগই এখন বহুমাত্রিক ঝুঁকিতে পড়বে। আর উদ্যোক্তা যদি হন নিরেট একজন সংবাদকর্মী, তাহলে তাকে অনেক বেশি ভেবেচিন্তেই এই পরিস্থিতিতে এগোতে হবে। একদম খাঁটি কথা। কিন্তু চারদিকে এত ইস্যু, খবরের ছড়াছড়ি। মন যে মানে না। তাই স্বল্প প্রস্তুতিতেই যাত্রা করলাম ‘এই সময়’ নিয়ে।
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শুরু করেছিলাম অনলাইন গণমাধ্যম ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের। আমি তখন দৈনিক ‘আমাদের সময়’-এর নির্বাহী সম্পাদক। পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খানের সঙ্গে বিশিষ্ট শিল্পপতি, ইউনিক গ্রুপের কর্ণধার নুর আলী ভাইয়ের মামলা-মোকদ্দমাজনিত কারণে প্রতিষ্ঠানটির সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। সবাইকে পুরোদমে কাজে নেমে পড়তে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছিলেন প্রিয় নুর আলী ভাই।
তখন ‘আমাদের সময়’-এর সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন (মঞ্জু) ভাই খানিকটা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন। নাছোড়বান্দা এই আমি বেঁধে দেয়া সময়ের আগেই ‘আমাদের সময়’-এর সব সাংবাদিক-কর্মচারী নিয়ে কাজে নেমে পড়ি। এভাবেই ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের জন্ম।
দ্রুতই মামলার ফল নুর আলী ভাইদের অনুকূলে চলে গেলে তিনি ‘আমাদের সময়’ নিয়েই আমাকে পুরো মনোযোগ দিতে বলেন। কিন্তু যে দরদ দিয়ে তত দিনে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাজ করছি, তাতে মন সায় দিল এটি নিয়েই থাকতে। অত্যন্ত সজ্জন এবং এখনো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী নুর আলী ভাইয়ের সঙ্গে সরাসরি কাজের সম্পর্ক ছেদ হলো। হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে শুরু করলাম আমার জন্য ভিন্নমাত্রার সংবাদমাধ্যম, ২৪ ঘণ্টার ওয়েব পোর্টাল ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের। ৪৪ ইস্কাটন গার্ডেনে যখন অফিস নিই, তখন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, মহিউদ্দিন মাহী, জাহিদ আনোয়ারসহ হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিক। এরপর ধীরে ধীরে অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে এখন ৬০ জনের সাংবাদিক-কর্মচারীর এক পরিবার আমাদের। ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম একান্তই আমার নিজের উদ্যোগ। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই প্রথম দিকে বলতেন, ‘প্রথম আলো’তে ১০ বছর সাংবাদিকতা, এরপর বসুন্ধরা গ্রুপের ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ উপসম্পাদক আর ইউনিক গ্রুপ, পিএইচপি আর আমান গ্রুপের মালিকানাধীন ‘আমাদের সময়’-এর উপসম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদক আর মাঝখানে বাংলাভিশনের বার্তা সম্পাদকের পরে অনলাইন সাংবাদিকতা করা ঠিক হচ্ছে কি না! কিন্তু একটু একটু করে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ঠিকই এগিয়ে চলেছে। সেই অর্থে আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয়নি আমাদের। এ বছরের ১৪ মে অফিসের সবাইকে বলেছিলাম, আজ থেকে যাত্রা হলো শুরু। তার মানে ২০১৪ সালের ১৪ মে হবে আমাদের প্রথম বর্ষপূর্তি। এর মধ্যে পাঠকের হৃদয়ে ঢাকা টাইমস বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। নানা স্বল্পতা, সংকটের পরেও আমরা প্রায় প্রতিদিনই নতুন কিছু চিন্তার খোরাক দিতে পারছি পাঠককে। বিভিন্ন ক্ষেত্রের অসঙ্গতিও তুলে ধরছি নিয়মিত। এর মধ্যেই ঢাকাটাইমসের ফেসবুক লাইক প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ছুঁয়েছে।
আগামী দিনগুলো হবে অনলাইন সাংবাদিকতার। গোটা বিশ্বেই এই আওয়াজ। এবং এটাই সত্যি। বাংলাদেশেও এর লক্ষণ পুরোমাত্রায় টের পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইন পোর্টালে বড় বড় মিডিয়া বিনিয়োগকারীরা আসছেন। পার্থক্য শুধু এক জায়গায়। এখনো বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকদের বড় একট অংশের বেশি পছন্দ প্রিন্ট মিডিয়া। বিজ্ঞাপনদাতারা অনলাইন পোর্টালে ঝুঁকছেন ঠিকই, কিন্তু প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মাধ্যমকেই পণ্যের প্রচারে বেশি সহায়ক বলে মনে করেন। তাছাড়া রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে যারা বিশ্লেষণ করেন তারাও প্রিন্ট মিডিয়ায় অনেক বেশি অভ্যস্ত। সব মিলিয়ে অনলাইন গণমাধ্যম দ্রুত এগোচ্ছে ঠিকই কিন্তু ছাপানো কাগজের গুরুত্ব ফুরিয়ে যায়নি। বিশ্ববিখ্যাত ‘নিউজ উইক’ছাপা বন্ধ করে শুধু অনলাইনে ছিল বেশ কিছুদিন।
আবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রিন্টে যাওয়ার। ছোট্ট এই খবরটি হয়তো আমাদের জন্য আপাতত স্বস্তির। কিন্তু এই স্বস্তি দ্রুত মিলিয়ে যাবে নাকি টেকসই হবে তার অনেকখানি নির্ভর করবে আমরা আসলে পাঠকের চাহিদা কতটা মেটাতে পারছি। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া পাঠককে নতুন করে টানতে পারছি কি না। নিঃসন্দেহে এটা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।
অনেক গুণীজনেরই অভিমত, এখনকার দৈনিক পত্রিকাগুলো বর্ধিত কলেবরে এমনভাবে বের হয় যে সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিশেষ কিছু দিতে না পারলে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। এই কঠিন কাজটাই আমরা হাতে নিয়েছি। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন-পুলিশ, দুর্নীতির হাঁড়ির খবর প্রতিনিয়ত বের করে আনাটাই হবে আমাদের কাজ। পাশাপাশি খেলাধুলা, বিনোদন, লাইফ-স্টাইলসহ নিয়মিত আরও অনেক বিভাগেও থাকবে বৈচিত্র্য। সংবাদের গভীরে গিয়ে কাজ করার নিরন্তর চেষ্টা করে যাব আমরা। শুধু সমস্যা নয় সম্ভাবনার কথাও বলতে চাই আমরা। শুধু অতীত আর বর্তমান নয় ভবিষ্যতের কথাও বলবে ‘এই সময়’।
বাংলাদেশে সাপ্তাহিক পত্রিকায় নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক প্রয়াত শাহাদত চৌধুরী। ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’কে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে দৈনিক পত্রিকার কাজ তিনি কঠিন করে দিয়েছিলেন। নিয়মিত অনুসন্ধানী ও বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনের পাশাপাশি উন্নয়ন সাংবাদিকতায়ও নতুন পথ দেখায় বিচিত্রা। একই ধারাবাহিকতা তিনি অব্যাহত রাখেন ‘সাপ্তাহিক ২০০০’- এও। একদল তরুণকে নিয়ে তার এই যাত্রাও যথারীতি নতুন মাত্রা যোগ করে সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের জগতে। শ্রদ্ধেয় শাহাদত ভাইয়ের অকাল প্রয়াণ হয়েছে। খুব কাছ থেকে অসম্ভব মেধাবী, সৃষ্টিশীল মানুষটির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। প্রথমে আমি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন কলকাতা প্রতিনিধি হিসেবে। এরপর ঢাকায় ফিরেই সরাসরি তার তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করি। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন আমি যেন তার সঙ্গ না ছাড়ি। তখন ড. আসিফ নজরুল ছিলেন প্রদায়ক সম্পাদক। তাকে নিয়ে শাহাদত ভাই তার ডিওএইচসের বাসায় আমাকে অনেক বুঝিয়েছেন। কিন্তু আচমকাই ২০০০ সালে যোগ দিই ‘প্রথম আলো’তে।
আজীবন স্রোতের প্রতিকূলে চলেছেন প্রয়াত শাহাদত ভাই। অদ্যম সাহসী মানুষটির কাছ থেকে কিছুটা হলেও শিখেছি কীভাবে মাথানত করতে না হয়। জীবনটা মোটেও ছকে বাঁধা নয়। শাহাদত ভাই প্রায়ই এটা বলতেন। আমি এটি পুরোপুরি বিশ্বাস করি। তথাকথিত ‘ব্রান্ড’প্রীতি আমার নেই। আমি যা বিশ্বাস করি, তা করছি কি না সেটিই আমার কাছে বড় কথা। ‘প্রথম আলো’তে বছর দশেক ভালো পেশাগত জীবন কেটেছে আমার। শুধুই পেশাগত জীবন! কাছ থেকে অনেক কিছু দেখেছি। শিখেছিও। আবার অনেক কিছু দুর্বোধ্যও ঠেকেছে। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে গডফাদারের শুলুকসন্ধানে বছরের পর বছর কাটিয়েছি। বাংলা ভাইয়ের জেএমবি বাহিনীর তাণ্ডবলীলা স্বচক্ষে দেখে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোরের প্রত্যন্ত এলাকায় কাটিয়েছি দিনের পর দিন।
সিডরে সর্বহারাদের অসহায়ত্বের চিত্র পত্রিকার পাতায় তুলে আনতে পটুয়াখালী, বরিশালের অজপাড়াগাঁয়ে আধপেটা খেয়ে নির্ঘুম রাতও কাটিয়েছি। রাজনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে সংশ্লিষ্ট দলের হাঁড়ির খবর অনায়াসে তুলে ধরেছি। লুকোছাপার চেষ্টা করিনি। অনেক মন্ত্রী-সচিবের দুর্নীতির খবর লিখতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও করিনি। আবার সেনাসমর্থিত তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (১/১১) সময় প্রিয় সম্পাদকের ইচ্ছায় আমার অনেক লেখা বিএনপির সংস্কারপন্থীদের পক্ষে গেছে দিনের পর দিন। আমিও অনেকের কাছে সমালোচিত হয়েছি। এই দায় এড়াব কী করে? সেটা ছিল ভুল। সাপ্তাহিক ‘এই সময়’ যেন ঐতিহাসিক ওই ভুলের পথে পা না মাড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখবে সব সময়। অনেক বাধা আসবে। কারণ সত্যকে যারা আড়াল করতে চান তারা অনেক শক্তিশালী। এই বাধা আমরা অতিক্রম করব। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চায় আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন থাকবে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে নিরন্তর কাজ করে যাব আমরা। এ জন্য সবার সাহায্য-সহযোগিতা চাই। পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুধানুধ্যায়ী সবাই ‘এই সময়’-এর যাত্রায় সব সময় পাশে থাকবেন, এই আশাবাদ রাখছি। আমার জীবনের অন্যতম খুশির দিন ৩১ ডিসেম্বর। আমার যমজ কন্যার জন্মদিন। তিন বছরে পা দিল ওরা। কাকতালীয়ভাবে সাপ্তাহিক ‘এই সময়’ বাজারে এল ৩১ ডিসেম্বর। এই আনন্দ ধরে রাখতেই হবে।