পাঁচ বছর ধরে জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদকের পদে ছিলেন সাবেক ছাত্রনেত্রী শিরিন সুলতানা। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তিনি বেশি পরিচিতি পান বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার কাছাকাছি থাকার কারণে। বেশ কয়েকবছর ধরে তাকে সর্বত্র দেখা যেত খালেদা জিয়ার হাত ধরে চলাচলে সহায়তা করতে।
মাঠের রাজনীতিও বেশ সক্রিয় অবস্থান থাকলেও গত মার্চে বিএনপির কাউন্সিলের পর ঘোষিত কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কিছুটা বেকায়দায় পড়েন শিরিন সুলতানা। যা ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি চেয়ারপারসনসহ দলের শীর্ষ পর্যায়। ফলে খালেদা জিয়ার হাত ধরার সুযোগটিও হাতছাড়া হয়ে যায়। পরে তার জায়গায় সুযোগ পান মহিলা দলের ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি সুলতানা আহমেদ।
তখনই বলাবলি হচ্ছিল, চাপের মধ্যে পড়ে গেলো শিরিন সুলতানার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। মহিলা দলের সভাপতি হওয়ার একটা আশা করেছিলেন তিনি। তবে মঙ্গলবার ঘোষিত কমিটিতে জায়গা হয়নি তার।
রাজনীতিতে শিরিনের আগমন
পরিবারের কেউই রাজনীতি না করলেও সাবেক এই ছাত্রনেত্রীর জন্ম ১৯৬৫ সালে রাজধানীর বাসাবোতে। ৮২ সালে মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন ইডেন কলেজে। ৮৫ সালের দিকে ইডেন কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করা হয়। ওই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য ছাত্রলীগের নেতারা প্রস্তাব দেন শিরিনকে। কিন্তু সে প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দেন আর ওই নির্বাচনে ছাত্রদল দেয় শিরিন-বাঁধন প্যানেল। তবে ওই নির্বাচনে হেরে যায় তারা।
পরে ছাত্রদলের ইডেন কলেজের সভাপতি নির্বাচিত হন শিরিন। এরপরই পুরোদস্তর রাজনীতিবিদে পরিণত হন শিরিন। স্বৈরাচারি এরশাদবিরোধী রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
ইডেন কলেজ থেকে অনার্স পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হন শিরিন। উঠেন রোকেয়া হলে। পরে ওই হলের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। ওই সময় ছাত্রদলের ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটিতে একমাত্র নারী হিসেবে স্থান পান শিরিন।
৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সব হল থেকে ছাত্রছাত্রীদের বের দেয় সরকার। শিরিনও চলে যান বাসায়। মহল্লার ছেলেদের সংগঠিত করে এলাকায় মিছিল করেন।
এরশাদ সরকার পতনের দিন মিছিলের সামনের সারিতেই ছিলেন শিরিন। ওইদিন ভোরে কারফিউ ভেঙে তার নেতৃত্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হয়েছিল। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের একটি প্রতীকে পরিণত হয় বাঁশের লাঠি হাতে মিছিলের অগ্রভাগে শিরিনের ছবিটি।
ওয়ান ইলাভেনের সময় খালেদা জিয়া আস্থাভাজন
ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের জমানায় অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন শিরিন। এরপর খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৯ (বাসাবো) আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। পরে তাকে মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন শিরিন। সর্বশেষ ২০১৫ সালের শুরুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে শিরিন সুলতানাও তিন মাস অবরুদ্ধ ছিলেন।
শিরিন সুলতানার স্বামী সাবেক ছাত্রনেতা খায়রুল কবির খোকন বর্তমানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের পদে আছেন।
মহিলা দলের নেতৃত্ব পাওয়ার আশায় বিএনপির পদ ত্যাগ
গত আগস্টে বিএনপির যে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয় তাতে শিরিনকে স্বনির্ভর বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে তিনি পরে ওই পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ঘনিষ্ঠজনদের কথা বলে জানা যায়, মহিলা দলের সভাপতি হওয়ার আশায় এই সিদ্ধান্ত নেন এই নেত্রী।
মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানাকে টপকে ওই সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনকে বরিশাল এবং অপর নারী সদস্য শামা ওবায়েদকে ফরিদপুরের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। এ নিয়ে মহাসচিবের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিরিন সুলতানা ও রেহানা আক্তার রানু। বলা হয়ে থাকে ওই ক্ষোভই কাল হয়ে শিরিন ও রানুর জন্য।
মহিলা দলে অপাঙক্তেয়
এমন যখন অবস্থা তার মধ্যেই ঘোষণা করা হয় মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। যাতে সভাপতি করা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসকে। আর ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি সুলতানা আহমেদকে করা হয়েছে সাধারণ সম্পাদক। একইসঙ্গে ঢাকা মহানগরকে দুইভাগ করে উত্তর ও দক্ষিণেও নতুন কমিটি দেয়া হয়েছে।
আফরোজা আব্বাস এর আগে মহিলা দলের সহ-সভাপতি ছিলেন। এবং কাউন্সিলের পর ঘোষিত বিএনপির কমিটিতে তাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক করা হয়।
এ ছাড়া মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি হয়েছেন নূরজাহান ইয়াসমিন।সহ-সভাপতি জেবা খান এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে হেলেন জেরিন খান।
হেলেন জেরিন বর্তমান বিএনপির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক পদে আছেন।
নতুন কমিটি গঠন করার পর গণমাধ্যমে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় শিরিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন সক্রিয় রাজনীতি করার ফল পেয়েছি।এখন দলের সমর্থক হিসেবে দলে থাকবো।’