বছর ঘুরে আবার ঈদুল আজহা আসছে। তাই কিছুটা আগেভাগেই শুরু হয় পশু কোরবানির প্রস্তুতি। আমাদের দেশে সাধারণত গরু ও খাসি কোরবানির প্রচলন বেশি। তবে গরুর মাংস স্বাস্থ্যসম্মত কি না আজকাল তা নিয়ে জনমনে কিছুটা আতঙ্কও কাজ করে। কারণ ক্ষতিকর ওষুধ খাইয়ে গরু মোটাতাজা করার প্রবণতা আছে। এসব পশুর মাংস মানবদেহের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। তবে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে মোটাতাজা করা গরু স্বাস্থ্যসম্মতও হতে পারে। অনেক খামারি আজকাল এভাবেই গরু মোটাতাজা করছেন। তাই আতঙ্কিত না হয়ে এ ধরনের মোটাতাজা গরু কিনতে পারলে নিরাপদ মাংস নিশ্চয়তা মিলবে।
আমাদের দেশে গরু মোটাতাজাকরণ এখন জনপ্রিয় ও লাভজনক কার্যক্রম। যাদের অজানা তাদের বিশেষ করে খামারিদের জানিয়ে রাখছি গরু মোটাতাজা করার স্বাস্থ্যসম্মত প্রক্রিয়া।
গরু মোটাতাজাকরণ আসলে কী
বাড়ন্ত তথা এঁড়ে গরু অল্প দামে কিনে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (৪-৬ মাস) উন্নত ব্যবস্থাপনায় এবং বিশেষ ধরনের খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে তার শরীরে বেশি পরিমাণ মাংস বা চর্বি বাড়ানোর প্রক্রিয়া হচ্ছে গরু মোটাতাজাকরণ। এতে কম সময়ে বেশি লাভ পাওয়া যায়। খামারিরা এ প্রকল্প হাতে নেয় প্রধানত কোরবানির পশুর বাজার সামনে রেখে।
গরু মোটাতাজা করার শর্তাবলী
বাণিজ্যিকভাবে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য কতগুলো আবশ্যকীয় বিষয়ের ওপর নজর দিতে হয়। তা হলোÑ ১. প্রকল্প চালুর উপযুক্ত সময় নির্বাচন, ২. পশু নির্বাচন ও ক্রয়, ৩. গরুর স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান নির্ধারণ, ৪. নির্বাচিত পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রদান, ৫. সুষম ও পরিমাণ মতো খাদ্য সরবরাহ, ৬. সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক প্রদান, ৭. প্রতি ১৫ দিন অন্তর গরুর দৈহিক ওজন নির্ণয়, ৮. গরুর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ৯. এঁড়ে গরুকে খোজাকরণ, ১০. মোটাতাজাকরণের মেয়াদকাল নির্ধারণ, ১১. গরু বাজারজাতকরণ ও ১২. গরু মোটাতাজাকরণের বিনিয়োগ ও মুনাফার তথ্য রেকর্ডকরণ।
সময় নির্বাচন
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ পরিবার ১-২টি বাড়ন্ত এঁড়ে গরু ক্রয় করে সনাতন পদ্ধতিতে লালনপালন করে স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার পর উপযুক্ত সময় বিক্রি করে দেয়। সাধারণত বেশি বিক্রয়মূল্য পাওয়ার আশায় অধিকাংশ লোক কোরবানির সময়কে পশু বিক্রির উপযুক্ত সময় মনে করেন। বাণিজ্যিকভাবে গরু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রেও পশুর মালিকরা ঈদুল আজহার সময়কে উপযুক্ত সময় বিবেচনা করেন। এ ক্ষেত্রে উপরোক্ত ১২টি কলাকৌশলের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় যে সব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো।
পশু নির্বাচন
গরু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে পশু নির্বাচনে যে সব বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো- বাড়ন্ত এঁড়ে বাছুর গরু এবং বাছুরের বুক চওড়া ও ভরাট, পেট চ্যাপ্টা ও বুকের সঙ্গে সমান্তরাল, মাথা ছোট ও কপাল প্রশস্ত, চোখ উজ্জ্বল ও ভেজা ভেজা, পা খাটো প্রকৃতির ও হাড়ের জোড়াগুলো স্ফিত, পাঁজর প্রশস্ত, বিস্তৃত এবং শিরদাঁড়া সোজা হওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও অতিরিক্ত যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে তা হলোÑ পশু ত্রুটিমুক্ত কি না তার জন্য পশুর মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখে তার শিং ভাঙা কি না, কান কাটা কি না, চামড়ায় কোথাও ক্ষত আছে কি না, পা ভাঙা কি না, লেজ ভালো কি না ইত্যাদি নিখুঁতভাবে দেখে পশু পছন্দ করতে হবে। পশু খোঁড়া কি না তা পরীক্ষা করার জন্য পশুকে হাঁটিয়ে দেখতে হবে এবং পশুর শরীরে কোনো রোগ আছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য পশুর সামনে খাবার দিয়ে পশু মুখে খাবার খায় কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুস্থ পশু নির্বাচন করতে হবে।
পশু সুস্থ ও সবল হওয়ার পাশাপাশি কোরবানির পশুর বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণ মোটাতাজাকরণকারী খামারিরা সাধারণত এক থেকে তিন বছর বয়সের গরু নির্বাচন করেন। বাণিজ্যিকভাবে মোটাতাজাকরণের জন্য আড়াই থেকে তিন বছরের গরু নির্বাচন করে থাকেন। বর্তমানে কিছু কিছু খামারি বয়স্ক গরু যেমন বলদ গরুকে নির্বাচন করেন। কুষ্টিয়া ও যশোর এলাকায় ভারতীয় বুলডার নির্বাচন করে থাকেন। পশুর বয়স বিভিন্নভাবে নির্ণয় বা নিশ্চিত করা যায় যেমন পশুর বয়স, ফার্ম থেকে ক্রয় করলে ফার্মের রেজিস্টার খাতা হতে পাওয়া যায়। এছাড়া পশুর মালিকের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে পশুর বয়স জানা যায়। বাছুর জন্ম গ্রহণের তথ্য রেজিস্টার খাতায় সংরক্ষিত না থাকলে পশুর দাঁত দেখে বয়স নির্ণয় করা যায়। গরুর নিচের পাটিতে দুটি স্থায়ী ইনসিজর দাঁত ওঠে তখন পশুটির বয়স হয় ১৯-২৪ মাস অর্থাৎ গরুর বয়স প্রায় ২ বছর। এর পর প্রতি ৬-৯ মাস অন্তর অন্তর এক জোড়া করে স্থায়ী দাঁত ওঠে। দেখা গেছে ৩.৫-৪.০ বছরের মধ্যে গরুর নিচের পাটিতে প্রতি পার্শে¦ ৪টি করে মোট ৮টি স্থায়ী দাঁত থাকে। গরুর বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় অথবা বাছুরের ১ সপ্তাহ বয়সে সামনে অস্থায়ী দাঁত গজায় এবং ৫-৬ মাসের মধ্যে অস্থায়ী দাঁত সবকটি ওঠে যায়। অস্থায়ী ও স্থায়ী দাঁতের মধ্যে পার্থক্য হলো অস্থায়ী দাঁতগুলো কিছুটা সরু, দুই দাঁতের মাঝে ফাঁকা থাকবে এবং স্থায়ী দাঁত মোটা হয়ে উঠবে এবং দুই দাঁতের গোড়ায় কোনো ফাঁকা থাকবে না।
বেশি দাম ও দ্রুত বৃদ্ধির জন্য মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে জাত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য যেসব খামারি বড় ধরনের এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মোটাতাজাকরণ করতে চান তারা গরুর জাতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যদিও কোরবানির ঈদে দেশি গরুর কদর অনেক বেশি থাকে। তারপরও কোরবানির জন্য বড় ও দেখতে সুন্দর বিদেশি জাতের গরুর বিকল্প নেই। কোরবানিতে বড় গরুর চাহিদা থাকায় মোটাতাজাকরণ গরুর খামারিরা বেশি গুরুত্ব দেন উন্নত জাতের গরুর দিকে। আমাদের দেশে মাংসের জন্য গরুর বিশেষ কোনো জাত ছিল না। তবে বর্তমান সরকার বিগত ৫ বছরে বিদেশ থেকে মাংসল জাতের ব্রাহমান ষাঁড়ের বীজ আমদানি করে কয়েকটি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কৃত্রিম প্রজনন করিয়ে সংকর জাতের মোটাতাজাকরণের গরু তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য অনেকাংশে সফল হওয়ায় বর্তমানে বীফ ব্রিড প্রকল্প নামে একটি কর্মসূচি চলছে। আশা করা যায় কয়েক বছরের মধ্যে মাংসল জাতের গরুর জাত পাওয়া যাবে। তবে মোটাতাজাকরণ খামারিরা বীফ ব্রিড না থাকলেও আমাদের দেশে পাবনা এলাকার ষাঁড়, কৃত্রিম প্রজননের এঁড়ে বাছুর এবং দেশীয় এঁড়ে গরু দিয়ে মোটাতাজাকরণ করে থাকেন। এদেশের ফ্রিজিয়ান ও শাহিওয়াল সংকর জাতের এঁড়ে গরু যদি জন্মের পর ভালো দুধ ও খাবার পেয়ে থাকে তবে এসব এঁড়ে গরুর ওজন ৫০০-৮০০ কেজি হয়ে থাকে এবং কোরবানির সময় খামারিরা এসব গুরু ১ থেকে ৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে থাকেন।
পশুর রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা
বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ গরু কোনো না কোনো কৃমিতে আক্রান্ত। কারণ আমাদের দেশের গরুকে যেভাবে লালনপালন করা হয় তাতে অতি সহজেই বিভিন্ন কৃমি/পরজীবী দ্বারা গরু সংক্রমিত হতে পারে। তাই পশুকে কৃমিমুক্ত না করতে পারলে যতই খাবার সরবরাহ করা হোক না কেন, তার স্বাস্থ্য বৃদ্ধি হয় না। তবে সমস্যা হচ্ছে যে, পশুর মালিকরা সাধারণত ক্রয়কৃত পশুকে পূর্বে কৃমিনাশক প্রদান করা হয়েছে কি না তা জানার প্রয়োজন মনে করেন না বা পশুতে আদৌ কৃমি আছে কি না তা পরীক্ষা করার জন্য নিকটস্থ প্রাণিসম্পদ চিকিৎসালয়ে যান না। চিকিৎসালয়ে গেলে তারা জানতে পারতেন তার পশু কোন ধরনের কৃমি দ্বারা আক্রান্ত এবং তার জন্য কী চিকিৎসা দিতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পশুর মালিকগণ মোটাতাজাকরণের জন্য গরু ক্রয় করার পর পরই নিজেই পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে অথবা নিকটস্থ পশুপাখির ওষুধ বিক্রয়কারী দোকান বা প্রাণিচিকিৎসালয় থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে থাকেন। কৃমিকে ধ্বংস করতে তারা সাধারণত যে ওষুধসমূহ ব্যবহার করে থাকেন তা হলো ব্রড স্পেকট্রাম গ্রুপের ওষুধ যা পাতাকৃমি, ফিতাকৃমি ও গোলকৃমির বিরুদ্ধে কাজ করে। বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন ট্রেড নামে ব্রড স্পেকট্রাম কৃমিনাশক ওষুধ বাজারজাত করছে। কৃমিনাশের জন্য ইনজেকশনও রয়েছে যা বিভিন্ন কোম্পানি বাজারজাত করে থাকে। এসব কৃমিনাশক ওষুধ প্রয়োগ করার পর পশুর খাদ্যের প্রতি রুচি বেড়ে যায় এবং এর জন্য যা খাবার খায় তাই শরীর গঠনে ও ক্ষয় পূরণে সহায়তা করে ও পশুর স্বাস্থ্য ভালো হতে থাকে।
গরুকে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ থেকে মুক্ত রাখার জন্য খামারিরা অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগের ভ্যাকসিন বা টিকা ১ মিলিলিটার করে ঘাড়ের চামড়ার নিচে প্রদান করে থাকেন। পাশাপাশি গরুকে ক্ষুরা রোগের হাত হতে রক্ষার জন্য এফএমডি মনো ভ্যালেন্ট বা বাই ভালেন্ট ভ্যাকসিন প্রতি ৩-৪ মাস পর পর চামড়ার নিচে ৩-৬ মিলিমিটার দিয়ে থাকেন। তবে ক্ষুরা রোগের টিকা সরকারিভাবে ততটা পাওয়া যায় না, তাই খামারিরা বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি যেমন অ্যাডভান্স অ্যানিমেল সায়েন্স কোম্পানির ক্ষুরা রোগের ভ্যাকসিন যেমন এফটোভ্যাক্স এবং এফ অ্যান্ড এফ কোম্পানির বাংলা এফএমডি ভ্যাকসিন ব্যবহার করে থাকেন। আরো যে সব সংক্রামক রোগ আছে সে সব রোগের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়ার তেমন প্রয়োজন হয় না। তবে অনেক এলাকায় গলাফোলা ও বাদলা রোগের টিকাও প্রদান করে থাকেন খামারিরা। নিয়মিত ভ্যাকসিন করার ফলে রোগ-বালাই কম হয় এবং শরীর ও স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
গরুর খাবার-দাবার
গরু মোটাতাজাকরণে গরুকে সুষম ও দানাদার খাদ্য সরবরাহ করার কোনো বিকল্প নেই। শুধুমাত্র ধানের খড়ের ওপর নির্ভর করে গরুকে মোটাতাজা করা সম্ভব নয়। গরু মোটাতাজা হওয়ার জন্য পশুর খাদ্য তালিকায় ৬টি উপাদান সমৃদ্ধ সুষম খাবার থাকা অত্যন্ত জরুরি। যদিও অধিকাংশ পশুমালিক এ বিষয়টি জানেন না তবে প্রত্যেকেই কমবেশি ভালো খাবার সরবরাহ করার চেষ্টা করেন। খাদ্য উপাদানের দিকে তাদের নজর না থাকলেও পশুকে বেশি বেশি খাওয়াতে হবে এটা তারা জানেন। অতি দরিদ্র ও গরিব পশু মালিকরা ক্রয়কৃত গরুকে শুধু ঘাস ও খড় খাওয়ান, কারণ তাদের পক্ষে দানাদার খাদ্য ক্রয় করা সম্ভব হয় না। আবার কিছু কিছু পশুমালিক নিম্নমানের খড় ও চিটাগুড়ের সঙ্গে ইউরিয়া ব্যবহার করে থাকেন। গরুকে দানাদার খাবারের সঙ্গে খড়কে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত করে সরবরাহ করতে হয়। যেমন ১০ কেজি খড়ের সঙ্গে ৪০০ গ্রাম ইউরিয়ার দ্রবণ দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে স্তূপাকারে ১০ দিন রেখে খাওয়ানো যেতে পারে। তবে ইউরিয়া খাওয়ানো ঝামেলার কাজ হওয়ার জন্য খামারিরা এ প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না।
বেশিরভাগ পশুমালিক সাধারণত যেসব খাদ্য পশুকে সরবরাহ করেন তা হলোÑ ভুট্টার আটা/ভাঙা, ধানের কুঁড়া, অ্যাংকর ভুসি, চালের ক্ষুদ যা রান্না করে ছোট ছোট করে কাটা খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়, গমের ভুসি, বিভিন্ন ডাল ভাঙা, ডালের ভুসি, তিলের খৈল, রান্নাভাত, সোয়াবিন মিল, সিদ্ধ ধান ইত্যাদি। নিচে ১০০ কেজি দানাদার খাদ্য প্রস্তুতের তালিকা দেওয়া হলোÑ ১. ভুট্টা ভাঙা/ গম ভাঙা/ গমের ভুসি ৪০ কেজি, ২. চালের কুঁড়া ২৩.৫ কেজি,স৩. খেসারি বা যে কোনো ডালের ভুসি ১৫ কেজি, ৪. তিলের খৈল/ সরিষার খৈল ২০ কেজি ও ৫. লবণ ১.৫ কেজি।
গরু দ্রুত বেড়ে উঠার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ২-৪ কেজি দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। অনেক খামারি সরবরাহ করার জন্য উন্নত জাতের ঘাস যেমন নেপিয়ার, জাম্বু, জার্মান, পারা, ভুট্টা, মাষকলাই ইত্যাদি চাষ করেন। আবার বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির রেডি ফিড, যা পিলেট হিসেবে পাওয়া যায় তা অনেক খামারি তাদের পশুকে খাইয়ে থাকেন। এসব খাদ্যের পাশাপাশি গরুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ খড় ও ঘাস খাওয়ানো হয়।
মোটাতাজাকরণের ওষুধ
খাবার সরবরাহের পাশাপাশি পশুমালিকরা ওষুধ প্রয়োগের কৌশল গ্রহণ করেন। এজন্য তারা স্থানীয় পশুপাখির ওষুধ বিক্রয়ের দোকানদার, মাঠকর্মী, বিশেষজ্ঞ পশু চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয় তা হলোÑ ওরাল ডিবি ভিটামিন যা খুব অল্প পরিমাণে লাগে, কারণ গরুকে যেসব খাবার দেওয়া হয় তাতে অনেক ভিটামিন ও মিনারেল থাকে। সামান্য পরিমাণ যে ঘাটতি থাকে তা পূরণের জন্য বাজারে প্রাপ্ত বিভিন্ন কোম্পানির ভিটামিন ব্যবহার করা যায়। এর ফলে ভিটামিন ও খনিজ লবণের ঘাটতি মিটিয়ে পশুর খাবার শরীরে কাজে লাগে এবং পশম খুব চকচকে হয়।
অতি দ্রুত গরুর শরীরে মাংস বৃদ্ধির জন্য ভিটামিনের পাশাপাশি টনিক জাতীয় ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। যদিও এসব ওষুধের মূল্য একটু বেশি তবে কার্যকারিতা অত্যন্ত চমৎকার।
অনেকে কমদামি ভিটামিন ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন। ক্যালসিয়াম জাতীয় ওষুধে পশু খুব শক্তিশালী হয় এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়। গরুকে ক্যালসিয়াম ইনজেকশন প্রয়োগের পরিবর্তে ওরাল ক্যালসিয়ামও খাওয়ানো হয়। উল্লিøখিত ওষুধ প্রয়োগে পশুর ওজন দ্রুত বাড়ে, পশু দেখতে চকচকে ও রোগমুক্ত থাকে। উল্লেখ্য, উপরোক্ত যে সব ওষুধ খামারিরা ব্যবহার করেন তা গরুর স্বাস্থ্য রক্ষা ও মাংস বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ওষুধ ব্যবহারের ফলে গরুর মাংসের গুণগতমানের কোনো ক্ষতি হয় না বা মাংস খাওয়ার ফলে মানুষের দেহে ক্ষতিকর কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না বরং সুস্থ পশুর মাংস মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় অধিক নিরাপদ।
মোটাতাজা গরুর মাংসে ভয় নেই
কোরবানির জন্য পশু ক্রয় করতে মোটাতাজাকরণ গরু অবশ্যই নির্বাচন করা যাবে, কারণ এসব গরুর মাংসের গুণাগুণ রুগ্ন ও চিকিৎসাবিহীন গরুর চেয়ে অনেক ভালো এবং বিভিন্ন রোগমুক্ত। মোটাতাজাকরণ গরু সব দিক থেকে রোক্তমুক্ত হওয়ার ফলে যে সেব রোগ পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় তা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই এটি নিশ্চিত করে বলা যায় ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজাকরণ গরু মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। কোনো অবস্থাতেই ক্ষতিকর নয় বরং খাঁটি ও ভেজালমুক্ত তাই সংবাদপত্রের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে নিশ্চিন্তে এসব গরু কোরবানির জন্য নির্বাচন করা যাবে এবং মাংস নিঃসন্দেহে খাওয়া যাবে। আর অসৎ ব্যবসায়ীদের স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের ব্যবহার, পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করে, কঠিন আইনের মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করে বন্ধ করতে হবে। যদি কোনো অসাধু খামারি ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার করে গরু মোটাতাজা করে থাকেন তবে অবশ্য পশু জবাইয়ের কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্বে স্টেরয়েড ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করলে সেই সব মোটাতাজাকরণ করা গরুর মাংস মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ততটা ক্ষতিকর হবে না। তারপরও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে গরু মোটাতাজাকরণে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। নতুবা গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না। সেই সঙ্গে জনস্বাস্থ্য পড়বে বিপর্যয়ের মুখে।
স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না
একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী গরু দ্রুত মোটাতাজাকরণের জন্য স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন। তবে খুব কম খামারিই এ কৌশল অবলম্বন করে থাকেন। আমরা জানি স্টেরয়েড জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে পরিচিত। দ্রুত গরুকে মোটাতাজাকরণের জন্য যেসব স্টেরয়েড ড্রাগস ব্যবহার করা হয় তা হলোÑইনজেকশন স্টেরনভেট, ইনজেকশন ডেক্সাভেট, ইনজেকশন হিস্টানল, ইনজেকশন সিয়ামভেট, ইনজেকশন নিরাভেট, ইনজেকশন ডেক্সাকট, ইনজেকশন ডেকাসন, ইনজেকশন ওরাডেক্স, ইনজেকশন প্রিক্সোনল এস, ইনজেকশন প্রিডনিভেট, ইনজেকশন প্রেডনিসলন ইত্যাদি। এসব ইনজেকশন একটি বাড়ন্ত ষাঁড় গরুকে ১০-২০ মিলি প্রতি ৭ দিন পর পর দেওয়া হয়ে থাকে। আবার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে চোরাচালান হয়ে ডেক্সামেথাজন বা ডেকাসন বা ওরাডেক্সন স্টেরয়েড জাতীয় সস্তা কতগুলো ট্যাবলেট আসছে। পশুমালিকরা প্রতিটি পশুকে এর যে কোনো একটির ৫টি বড়ি/ট্যাবলেট প্রতিদিন খাইয়ে থাকেন।
স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের প্রয়োগ মাংসের গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়। তাই মোটাতাজা করার জন্য গরুতে স্টেরয়েডের ব্যবহার মোটেই কাম্য নয়। বিষয়টি কঠোরহস্তে দমনের জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ড. মো. জালাল উদ্দিন সরদার : অধ্যাপক, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি।